রিপন হাসান, গাইবান্ধা:
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. সাকা মিয়া। ইউপি সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ব্যাটারিচালিত অটোভ্যান চালিয়ে সংসার চালান তিনি। শুধু সংসার নয়, তার ওয়ার্ডের ভোটারদের সুখ-দুঃখের খবর জানতে তিনি ভ্যান চালিয়ে বাড়ি বাড়ি যান এবং তাদের সাহায্য করেন।
সাকা মিয়া সাদুল্লাপুর উপজেলার ভাতগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। বয়স ৪৩ বছর। এলাকার মানুষের কাছে তিনি ‘ভ্যানওয়ালা সাকা মেম্বার’ নামেই পরিচিত। ভ্যান চালাতে চালাতে মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শুনে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা জাগে সাকা মিয়ার। ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ভ্যান চালানো বাদ দেননি। ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান, পাশাপাশি ভোটারদের সুখ-দুঃখের খবর জানতে নিজের ভ্যানেই সবার বাড়ি বাড়ি যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে সাকা মিয়াকে এলাকার ভোটাররা দাঁড় করিয়ে দেন। সেবার মাত্র ৪ ভোটে হেরে যান সাকা মিয়া। এরপর ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সাকা মিয়া ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। নিজে একজন ভ্যান চালক হওয়ায় ভ্যান গাড়ি প্রতিক নিয়ে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন৷ পোষ্টার ছাপানো থেকে শুরু করে নির্বাচনের যাবতীয় খরর বহন করেছে এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। ভোটারদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে ভোটযুদ্ধে লড়াই করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন ভ্যান চালক সাকা মিয়া।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সাকা মিয়া ভাতগ্রাম ইউনিয়নের গঙ্গা নারায়ণপুর গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিম ও মৃত জমিলা বেগম দম্পতির ছেলে। ১ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারান। বাবা-মাকে হারানো শিশু সাকা মিয়াকে এক প্রতিবেশি লালন-পালন করেন। পরে সেই প্রতিবেশি তাকে স্থানীয় এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরুতেই তিনি জীবিকার তাগিদে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ভ্যান, রিকশা চালানো শুরু করেন। প্রায় ২৫ ধরেই তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। প্রায় ২০ বছর আগে বিয়ে করে শুরু করেন জীবন সংসার। স্ত্রী ও দুই মেয়ে সন্তান নিয়েই তার
স্থানীয়রা জানান, বর্তমান সময়ে কারি কারি টাকা খরচ করে যারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়, তারা চোখের ফলকে পাল্টে যায়। তাদের স্বভাব চরিত্র কথাবার্তার ধরনের রাতারাতি পরিবর্তন হয়। কিন্তু সাকা মিয়ার ক্ষেত্রে তা ব্যাতিক্রম। এদেশের প্রতিটি এলাকায় সাকা মিয়ার মতো লোকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলে ভোটাররা সব সময় ভালো সেবা পাবে।
সুফলভোগী নুরিনা বেগম বলেন, অনেক মেম্বার-চেয়ারম্যান গেইছে, কেউ টাকা ছাড়া কোন কার্ড করে দেয়নাই। সাকা ভাই মেম্বার হওয়ার পর থেকে সব সহায়তা পাচ্ছি। এখন বিনে পয়সায় প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল পাচ্ছি।
মোন্নাফ মিয়া নামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, সাকা মিয়া ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। সবার ভালোবাসায় সে মেম্বার হয়েছে। মেম্বার হওয়ার পর তার কোন পরিবর্তন হইনি। যেকোনো সময় তাকে ডাকলেই পাওয়া যায়। সাকা মিয়ার মতো জন প্রতিনিধির দরকার।
ইউপি সদস্য সাকা মিয়ার মেয়ে আলিফা আকতার বলেন, আমার বাবা গরীব হলেও তার মনটা অনেক ভালো। এলাকার লোকজন তাকে ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছে। বাবা যেভাবে কাজ করতেছে মানুষের জন্য, আগামীতেও বাবাকেই তারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।
সাকা মিয়ার স্ত্রী আসমা বেগম বলেন, স্বামীর পড়াশুনা ও টাকাপয়সা নেই। কিন্তু তিনি গরিবের সেবা করার জন্য ইউপি সদস্য হয়েছেন। মানুষের কাজ করতে গিয়ে আয় রোজগার কম হয়, সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাতে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই। মানুষ যে আশা নিয়ে তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন তিনি যেন সেই মর্যাদা রাখতে পারেন।
ইউপি সদস্য সাকা মিয়া বলেন, ভ্যানে গ্রামের মানুষকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পথে গল্প হয়। গল্প করতে করতে এলাকার দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। অনেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে ভোটের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেন না বলে অনেকের অভিযোগ। সেসব দেখে ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা জাগে। ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে সদস্যপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ৪ ভোটে হেরে যাই। পরে ২০২১ সালের অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ভ্যান গাড়ি মার্কা নিয়ে নির্বাচন করলে ভোটাররা বিপুল ভোটে আমাকে নির্বাচিত করেন।
তিনি আরও বলেন, চেষ্টা করছি সাধ্যমতো মানুষের পাশে থাকতে। জনপ্রতিনিধি হয়েছি, মানুষের অধিকার আদায়ে পাশে থাকছি। কিন্তু নিজের পরিবারকে তো বাঁচাতে হবে। তাই আয় করার জন্য ব্যাটারিচালিত অটোভ্যান চালাই। ভ্যান চালানো ছেড়ে দিলে সংসার চলবে কীভাবে?’
ভাতগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাহফুজার রহমান মাফু বলেন, সাকা মিয়া সরকারি বিভিন্ন বরাদ্দ সমুহ সঠিকভাবে বন্টন করছেন। তার কার্যক্রমে ওই ওয়ার্ডের মানুষরা সন্তুষ্ট। নিজের ভ্যান নিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের খোঁজ নেন তিনি। তার মতো জনপ্রতিনিধি দরকার।
এ বিষয়ে সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কাওছার হাবীব বলেন, আমি এ উপজেলায় নতুন এসেছি। তবে ইউপি সদস্য সাকা মিয়ার সম্পর্কে শুনেছি। সত্যি উনি একজন সাদা মনের মানুষ। সাকা মিয়ারাই সমাজের জন্য এক বড় দৃষ্টান্ত।