
মোতালেব হোসেন:
ঢাকার আব্দুল্লাহপুর ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ হেঁটে যায়। কেউ ব্যস্ত কর্মস্থলে, কেউবা স্কুল বা বাজারে। এই শহরের কোলাহলে, যানজট আর শব্দের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক কিশোর। তার ঠেলাভর্তি বাদাম, মাথার ওপরে খোলা আকাশ, আর চোখে ভবিষ্যতের জন্য একরাশ স্বপ্ন। তার নাম আব্দুল্লাহ।
তার সাথে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল্লাহর বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। খুব অল্প বয়সেই তাকে বুঝে নিতে হয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতা। মা বেঁচে থাকলেও অনেক আগেই তাদের ফেলে চলে গেছেন। বাবা থাকলেও সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই। বড় এক বোন আছে, কিন্তু তারও বয়স কম। তাই পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে এবং ছোট ছোট প্রয়োজন মেটাতে একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে আব্দুল্লাহ নিজেই।
সে জানায়, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে ২/৩ কেজি বাদাম নিয়ে চলে আসে ঢাকায়। ফ্লাইওভারের এক কোণে দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করে সারাদিন। গরমে, বৃষ্টিতে, ধুলায় -সব কিছুর মাঝেও সে মাথা নিচু করে না। কাস্টমারদের ডাকে, হাসিমুখে কথা বলে। দিনে যা রোজগার হয়, তার পুরোটাই নিয়ে যায় বাসায়- বোনের জন্য।
আব্দুল্লাহ বলে, “জানি, স্কুলে যাওয়া দরকার। আমিও চাই পড়াশোনা করতে। কিন্তু এখন সংসার চালানোই আগে। মা নেই, বাবা কিছু করেন না। যদি আমি না করি, তাহলে আমরা খাব কী?”
তার সাথে কথা বলে জানা যায়, এই কিশোরের জীবনে নেই কোনো ছুটি, নেই আনন্দের ঈদ, নেই শিশুবেলার খেলা। সে যে বয়সে খেলাধুলায় মেতে উঠার কথা, সে বয়সেই তাকে রোজগারের জন্য শহরের রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে। অথচ, তার চোখে নেই হেরে যাওয়ার ছাপ। বরং আছে এক ধরনের মাটি-কামড়ানো দৃঢ়তা, যা অনেক বড় মানুষের মাঝেও দেখা যায় না।
সে জানে না কীভাবে বইয়ের পাতা উল্টাতে হয়, জানে না কেমন লাগে স্কুলের বেঞ্চে বসে পড়াশোনা করতে। কিন্তু তার বুকভরা সাহস, মায়াভরা মন আর অক্লান্ত পরিশ্রম তাকে দিয়েছে আলাদা এক পরিচয়। শহরের হাজারো মানুষের ভিড়ে আব্দুল্লাহ এখন একটি পরিচিত মুখ-নীরব এক যোদ্ধা, যে রোজ হেরে যেতে যেতে জয় করার স্বপ্ন দেখে।
আব্দুল্লাহ আমাদের চোখে দেখিয়ে দেয়- মানুষের বয়স নয়, দায়িত্বই মানুষকে বড় করে। অভাব আর ত্যাগ তাকে কঠিন করেছে, কিন্তু মনটাকে করেনি রুক্ষ। সে এখনো হাসে, এখনো স্বপ্ন দেখে -একদিন হয়তো ভালো কিছু হবে। হয়তো কোনো দয়ালু মানুষ পাশে দাঁড়াবে। হয়তো সে আবার স্কুলে ফিরতে পারবে।
এই সমাজ কি পারবে আব্দুল্লাহদের পাশে দাঁড়াতে? একটু ভালোবাসা, একটু সহানুভূতি কি বদলে দিতে পারে এমন একটি জীবন?