
হেলাল উদ্দিন:
বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশের আয়োজনে জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরাম খাঁ হলে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার সকাল ১০টায় শুরু হওয়া এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান।
সংস্থার চেয়ারম্যান ও পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুমের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন (কায়কোবাদ), বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এএসএম আবদুল হালিম, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মোঃ সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, এবি পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জনতা ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক ওবায়দুল হক, দৈনিক দেশেরপত্র-এর সম্পাদক রূফায়দাহ পন্নী এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচালক ইমাম জাফর শিকদার।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, “দেশে চলমান সংকট সমাধানে গণতান্ত্রিক উত্তরণই একমাত্র পন্থা। এই মুহূর্তে শুধু সরকার বা রাজনৈতিক দল নয়, দেশের সাধারণ জনগণকেও সচেতন থাকতে হবে। ২০২৪ সালের জুলাই এবং ৫ আগস্টে যেসব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিল, তার ৯ মাস পর দেশের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা গভীরভাবে ভাবার বিষয়।”
ড. মঈন খান আরও বলেন, “গণতন্ত্র নিঃসন্দেহে একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা হতে পারে, কিন্তু এর বিকল্প ব্যবস্থা আরও ভয়াবহ। গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনও ব্যবস্থাই টেকসই নয়। ৭১ সালে মানুষ গণতন্ত্র ও অধিকার রক্ষার জন্যই যুদ্ধ করেছিল। আজ আমরা যদি গণতন্ত্রকে ভুল পথে চালিত করি, তবে তা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে।”
তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ঠিকভাবে চর্চা হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতি পাঁচ বছরে জনগণের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। এই নির্বাচনই রাজনীতিবিদদের জবাবদিহির মাধ্যম। কিন্তু যদি নির্বাচনে কারচুপি হয়, তবে সেটি প্রকৃত অর্থে পরীক্ষা নয়। আমি বলতে চাই, গত ১৫ বছরে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি, আর দায় নির্বাচনের নয়, বরং দায় নির্বাচনের আয়োজকদের।”
সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই একমাত্র পথ। তবে শুধু নির্বাচন নয়, তার আগে প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হলে এই সংস্কারগুলো অপরিহার্য।”
তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে, যারা নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করবে।” মান্না বলেন, “দেশের জনগণ পরিবর্তন চায়, তারা আর এই দুঃশাসন মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তাই সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিতে হবে, যাতে করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়।”
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন দৈনিক দেশেরপত্রের সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী। তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর বহুবার বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও, সত্যিকার অর্থে এসব নির্বাচনের মাধ্যমে কি দেশের মানবাধিকার রক্ষা পেয়েছে -এ প্রশ্ন থেকেই আজকের আলোচনার সূচনা হওয়া উচিত।”
তিনি বলেন, “আমার পরিবার টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী জমিদার পন্নী পরিবার। এ পরিবার পাকিস্তান আমল থেকেই শিক্ষা, জনকল্যাণ ও রাজনীতিতে ভূমিকা রেখে এসেছে। দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনি প্রচারণায়ও পন্নী পরিবারের অবদানের কথা বারবার উঠে এসেছে।” মানবাধিকারের প্রকৃত অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “মানবাধিকার মানেই মানুষের অধিকার- যা তার সৃষ্টিগত ও জন্মগত অধিকার। আমরা মুসলমান হিসেবে আল্লাহর হুকুমে বিশ্বাস করি। আল্লাহর কোরআনই মানবাধিকার রক্ষার মূল সনদ।”
আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ব্যর্থতার দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন ঘটছে ফিলিস্তিনে। কিন্তু জাতিসংঘসহ বিশ্ব শক্তিগুলো নিরব। কারণ তারা নিজেরাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব, ওআইসি কিংবা আরব লীগও কার্যকর কোনো অবস্থান নিচ্ছে না।”
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার রক্ষায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও দলীয় হানাহানিকে দায়ী করে রুফায়দাহ পন্নী বলেন, “বাংলাদেশে বিরোধী দলে থাকলে পিটিয়ে দেশছাড়া করা হয়, ক্ষমতায় গেলে তারাই আবার একই কাজ করে। এটা কোনো মানবাধিকার সম্মত রাজনীতি নয়।” তিনি দাবি করেন, “যদি সত্যিকার অর্থে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তবে আমাদের আল্লাহর দেওয়া বিধান মেনে চলতে হবে। কুরআন স্পষ্ট বলেছে- সকল মানুষ এক জাতি, সবাই আদম সন্তান। শ্রেষ্ঠ সেই, যে সত্যভাষী, ন্যায়পরায়ণ ও মুত্তাকী।”
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে যদি ফেয়ার অ্যান্ড ফ্রি ইলেকশন হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে -এই নির্বাচন মানবাধিকার রক্ষায় কতটা কার্যকর হবে? রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে যেসব প্রস্তাবনা আসছে, তার প্রকৃত রূপ এখনও অজানা।”
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চাপ ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন বিশ্বরাজনীতির একটি ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চীন, আমেরিকা, ভারতসহ বহু দেশের স্বার্থ এখানে জড়িত। আমরা আজ কোটি কোটি টাকার ঋণে জর্জরিত। এখন প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।”
সবশেষে রুফায়দাহ পন্নী বলেন, “মানবাধিকার রক্ষা করতে হলে, রাজনীতিতে সত্য, ন্যায় ও তওহিদ ভিত্তিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা না করে, কেবল মানুষের ইচ্ছায় রাষ্ট্র পরিচালনা করলে মানবাধিকার কখনোই প্রতিষ্ঠা পাবে না।”
তিনি এই তওহিদ ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রস্তাবনাটি ইন্টারিম সরকারকেও দিয়েছেন বলে জানান এবং সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও দায়িত্বশীল মহলকে এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার আহ্বান জানান।