Date: May 13, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / সারাদেশ / চট্টগ্রাম / ফেনীতে মাটি’র সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

ফেনীতে মাটি’র সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক

April 28, 2024 08:04:57 PM   জেলা প্রতিনিধি
ফেনীতে মাটি’র সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক

এইচএম আনোয়ার:
পশ্চিমা অপসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে রক্ষা এবং সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে নবজাগরণ সৃষ্টির এক বিপ্লবী চেতনা নিয়ে দেশব্যাপী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তুলে দেশ, জাতি, মানবতার স্বার্থে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করতে সারাদেশে ঘুরে ফিরছে মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী।

তারই ধারাবাহিকতায় রবিবার (২৮ এপ্রিল) বিকাল ৩ টায় ফেনী শিল্পকলা একাডেমিতে ‘সংস্কৃতিচর্চার হাত ধরে আসুক নবজাগরণ’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সংগঠনটি। মাটি’র ফেনী জেলা সভাপতি মঞ্জুর বিন সুলতানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন ফেনী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল। প্রধান আলোচক ছিলেন মাটি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি রিয়াদুল হাসান।

DP 2-5-2024 1-8, 2-7
প্রধান আলোচক তার বক্তব্যে বলেন, জাতি আজ নানামুখী সংকটের মুখে পতিত। সমাজের এমন কোন স্তর নেই যা দুর্নীতি গ্রাস করে নি। দেশের অর্থ-সম্পদ আদজ গুটিকয়েক লোকের হাতে পুঞ্জিভূত। বাকিরা অর্থনৈতিক ব্যায়ামের মধ্য দিয়ে কোনোপ্রকারে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। পশ্চিমাদের অনুকরণে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লড়াই আমাদের দেশকে সব সময় অস্থিতিশীল করে রাখছে। স্বাধীনতার পর একটি দিনের জন্যও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় নি। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা, অপরাজনীতি, ধর্মের অপব্যবহার করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমানকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে চলেছে আরেকটি গোষ্ঠী।

এভাবে একটি একটি করে সংকট আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। আমাদের বাঁচার আর কোন পথ নেই। জাতির এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আরেকটি বিপ্লবের, আরেকটি রেনেসাঁর। এই বিপ্লব সৃষ্টির অন্যতম একটি মাধ্যম হতে পারে সংস্কৃতি। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, এখানে সেই পরিবেশ নাই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ধর্মীয় অন্ধত্ব, কুপমণ্ডুকতা, মিথ্যা ফতোয়াবাজি। ভুল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে গুম করে দেওয়া হয়েছে। গান, নাটক, সিনেমাকে একচেটিয়া হারাম সাব্যস্ত করা হচ্ছে। অথচ আল্লাহ কোরআনে কী কী হারাম করেছেন তার তালিকা সুস্পষ্ট। সেখানে কি আল্লাহ গানকে হারাম করেছেন? করেন নি। আল্লাহ হারাম করেছেন অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, আল্লার নাফরমানি।

আমাদের এখানে সাংস্কৃতিক বিপ্লব আমরা এজন্যই আশা করি, কারণ মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে গান, কবিতা, অভিনয়। একটা মানুষ দশ মিনিটও বসে বক্তব্য শুনতে চায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাদুকরী বক্তৃতার জালে মানুষকে বন্দী করে রাখবে, সে ধরনের বক্তাও আজকাল আমাদের নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শুনছে, সারারাত ধরে গান শুনছে। কাজেই এখন গানের মধ্য দিয়ে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব সৃষ্টি করতে হবে। মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সেই বিপ্লবের ডাক দিয়েছে। একটি জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রধান অতিথি শুসেন চন্দ্র শীল তার বক্তব্যে বলেন, এদেশের মূল চেতনার একটি বড় অংশ হচ্ছে সংস্কৃতি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আজকের বাংলাদেশ। জাতির জনকের হাত ধরে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূল্যবোধকে বিশ্বাস করে সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যারা এগিয়ে যাবে তাদের চিন্তাধারা এমনই হবার কথা ছিল। দুর্ভাগ্য আমাদের স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের উন্নয়ন ও সংস্কৃতিচর্চাকে ধূলিসাৎ করে দিতে চেয়েছিলো একটি গোষ্ঠী।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি তার আপন গতিতে চলতে পারতো যদি যদি সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে মুক্তচিন্তার মানুষগুলো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারতো তাহলে আজকের ৫২ বছরের বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করতো। সেই জায়গাগুলো পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, বই মেলা করতে একটা গোষ্ঠী বাধা দিচ্ছে। লেখক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়, সংস্কৃতিমনা মানুষদের আজকে বিভিন্ন ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে। যে সমাজে সংস্কৃতিচর্চা হয় না, যেখানে মুক্ত আলোচনার কোন পরিবেশ থাকে সেখানেই উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়ে। মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী যে বিপ্লব সাধন করতে মাঠে নেমেছে তা সময়োপযোগী। তিনি মাটি’র এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান এবং মাটি’র উত্তোরত্তর সাফল্য কামনা করেন।

Feni 2-2

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংগঠনটির সাধারণ সম্পদক মেজবাউল ইসলাম বলেন, মাটি সংস্কৃতিক গোষ্ঠী একটি মহান উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি বিপ্লবের বিপ্লবীদের রসদ যুগিয়েছে শিল্প-সংস্কৃতি। আজকে জাতির এই সংকটকালে একটি রেনেসাঁর প্রয়োজন, একটি নবজাগরণের প্রয়োজন। মাটি মানুষের চেতনার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে। এই কর্মকাণ্ড আরও বেগবান হবে। এই সংগঠনের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সমগ্র দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।  

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এড. প্রিয় রঞ্জন দত্ত বলেন, কোন একটি জাতি কোন, একটি  গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের যদি বিকাশ বা জাগরণ ঘটাতে হয় তবে তা সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই হবে এর বিকল্প কোন কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই।

তিনি আরও বলেন, যদি বাঙালি জাতিকে গান, কবিতা, নাটক চর্চা করতে দেওয়া হয় তবে বাঙালি জাতি সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে। যে কারণে এ জাতিকে সংস্কৃতির দিক দিয়ে পিছিয়ে রাখতে কম চেষ্টা করা হয়নি।

ইতিহাস টেনে তিনি বলেন, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী সাংস্কৃতিকভাবেও বাঙালি জাতিকে কোণঠাসা করে রাখতে চেষ্টা করেছিল। কারণ তারা জানতো কোন জাতিকে যদি পিছিয়ে রাখতে হয় তবে সে জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে কোণঠাসা করে রাখতে হবে।

সংস্কৃতিচর্চার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার অন্যতম মাধ্যম হতে পারে সংস্কৃতি। আর এর জন্য অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সুস্থধারার সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই।

সারাদেশের প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়েও মাটি’র এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে, এই বিপ্লবকে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। মাটি’র এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনই মানুষের সামনে ধর্ম-অধর্ম, সত্য-অসত্য ও আলো-আধারের পার্থক্য তুলে ধরতে পারবে বলে তিনি মনে করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কবি উত্তম দেবনাথ বলেন, সংস্কৃতি সংস্কারে অন্ধকার দূর হয়। সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষ সভ্য হয়, সমাজ আলোকিত হয় মানবিকতার বিকাশ ঘটে মূল্যবোধ ফুঁটে ওঠে। মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আজ যে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দেশের সর্বত্র ছুটে বেড়াচ্ছেন তার প্রশংসার দাবি রাখে।

বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত থেকে আরো বক্তব্য রাখেন মাটি’র ফেনী জেলা উপদেষ্টা নুরুল আবসার সোহাগ, জাগরণী সাংস্কৃতিক একাডেমির পরিচালক রাজীব দাস বাবলু, ফেনী জেলা জজ কোর্টের জি. পি এডভোকেট সমীর চন্দ্র কর প্রমুখ।

বক্তারা প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর আলোচনা করেন এবং মাটি’র এই উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানান। মাটির এই শক্তিশালী চেতনা দেশ ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর শিল্পীরা। তাদের পরিবেশনার মধ্যে ছিল- জাগরণমূলক গান, দেশাত্মবোধক গান, জারি গান, নৃত্য, আবৃত্তি, একক অভিনয়, নাটক ইত্যাদি। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর চাষীরহাট নুরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাটি’র ক্ষুদে শিল্পীদের পরিবেশিত জারি গান ও নাটক ‘বৃদ্ধাশ্রম’ দর্শকদের মুগ্ধ করে।

সবশেষে সমাপণী বক্তব্য রাখেন- মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অন্যতম উপদেষ্টা সাইফুল ইসলাম। এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন- মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর ফেনী জেলা সভাপতি মঞ্জুর বিন সুলতান।

অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধান অতিথি, প্রধান আলোচক ও বিশেষ অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সদস্য ডা. তুহিন মাহমুদ। অনুষ্ঠানের সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সদস্য রুবেল হোসেন।