Date: October 19, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / মানবরচিত জীবনব্যবস্থা কী দিয়েছে আমাদের? - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

মানবরচিত জীবনব্যবস্থা কী দিয়েছে আমাদের?

September 28, 2025 09:00:27 PM   শাহাদৎ হোসেন
মানবরচিত জীবনব্যবস্থা কী দিয়েছে আমাদের?

জনগণের শাসন’ গণতন্ত্রের নামে এই মোহনীয় শব্দযুগল আমাদের পাঠ্যপুস্তক ও রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চে যতটা আবেদন তৈরি করে, বাংলাদেশের নিষ্ঠুর বাস্তবতা তার থেকে শত যোজন দূরে। সুদীর্ঘ সময় ধরে এই ভূখণ্ডে গণতন্ত্র নামক ব্যবস্থার যে চর্চা হয়ে আসছে, তা কি আদৌ জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে? নাকি এটি কেবল শাসকের খোলস বদলের এক পঞ্চবার্ষিকী উৎসবে পরিণত হয়েছে? ঔপনিবেশিক শাসনের যে জনবিচ্ছিন্ন উত্তরাধিকার আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি, তা স্বাধীন বাংলাদেশেও জনগণকে শাসনের অধিকার দেয়নি, দিয়েছে শুধু ভোটদানের এক মৌসুমী অধিকার।

সাদা চামড়ার ব্রিটিশরা তাদের শাসনব্যবস্থার আদলে যে গণতন্ত্রের বীজ এ মাটিতে বপন করেছিল তার শিকড় কখনোই সাধারণ মানুষের গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি। এটি ছিল ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এক ব্যবস্থা এবং শাসনের নামে শোষণকে দীর্ঘায়িত করার এক অভিনব কৌশল। ফলে জনগণ বরাবরই ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থেকেছে; তাদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ থেকেছে কেবল করদাতা আর ভোটদাতা হিসেবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শাসকের গায়ের রং বদলেছে, কিন্তু শাসনের শোষণমূলক চরিত্রের কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি বাংলাদেশে যা দিয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের উত্থান। এই রাজনৈতিক ব্যর্থতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এর অর্থনৈতিক দর্শন পুঁজিবাদ। গণতন্ত্র এখানে এক ধরনের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে, যার ছায়াতলে একটি ক্ষুদ্র পুঁজিপতি শ্রেণি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। এর দুটি নগ্ন উদাহরণ হলো ব্যাংকিং খাত ও মেগা প্রকল্প।

এই ব্যবস্থার অর্থনৈতিক শোষণের সবচেয়ে স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে দেশের ব্যাংকিং খাতে। এখানে প্রভাবশালী খেলাপিরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। জনগণের আমানতের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেলেও তাঁদের জবাবদিহি করতে হয় না। অন্যদিকে, মাত্র কয়েক হাজার টাকার ঋণের জন্য যখন একজন সাধারণ কৃষককে কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে তোলা হয়, তখন এই ব্যবস্থার দ্বৈত চরিত্র উন্মোচিত হয়। এটি প্রমাণ করে, আইন এখানে সবার জন্য সমান নয়; বরং এটি একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
একইভাবে, উন্নয়নের নামে গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলো প্রায়শই দুর্নীতির মহোৎসবে পরিণত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে একই ধরনের প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় কয়েকগুণ বেশি দেখানো হয়। রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ঠিকাদারদের এক অশুভ আঁতাত জনগণের করের টাকাকে স্ফীত বাজেটের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে। এই তথাকথিত উন্নয়ন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন না করে, বরং একটি দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রকে আরও ধনী বানানোর মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্যকে তীব্রতর করে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি ধারণা সূচকও এই বাস্তবতার সাক্ষ্য দেয়। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। ২০২৩ সালের সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০০ এর মধ্যে মাত্র ২৪। পরের বছর ২০২৪ সালে তা আরও বেড়ে দাড়িয়েছে ১০০ স্কোর এর মধ্যে ২৩। অর্থাৎ তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৪তম। ২০২৩ সালে এই অবস্থান ছিল ১০ম।

এই সীমাহীন দুর্নীতি জন্ম দিয়েছে এক বিচারহীনতার সংস্কৃতি, যা এই মানবসৃষ্ট ব্যবস্থার সবচেয়ে বিষাক্ত ফসল। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতো বহু আলোচিত ঘটনার এক দশক পেরিয়ে গেলেও যখন তদন্ত শেষ হয় না, কিংবা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটা হত্যাকাণ্ডের আসামিরা ক্ষমতার ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়, তখন সাধারণ মানুষ রাষ্ট্র ও আইনের শাসনের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে। এই আস্থাহীনতা সমাজে জন্ম দেয় চরম নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা। যখন নাগরিকেরা বোঝে যে ক্ষমতাধরদের জন্য বিচার এক জিনিস আর তাদের জন্য আরেক, তখন খুন, ধর্ষণ ও রাহাজানির মতো সামাজিক অপরাধ লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে।

এই ব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি বহু আগেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন বিশ্বসেরা দার্শনিকেরা। প্লেটো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য রিপাবলিক’-এ গণতন্ত্রকে ‘মূর্খদের শাসন’ বলে অভিহিত করতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর মতে, রাষ্ট্র পরিচালনার মতো জটিল কাজের জন্য প্রয়োজন জ্ঞানী ও যোগ্য নাবিক, জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভেসে আসা অদক্ষ মাঝি নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্লেটোর এই প্রশ্নটি আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এখানে অর্থ, পেশিশক্তি আর পারিবারিক পরিচয়ের জোরে যখন কেউ সংসদে প্রবেশ করে, তখন রাষ্ট্রের জাহাজ যে বিপথগামী হবে, তা-ই তো স্বাভাবিক।

বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, মানবসৃষ্ট কোনো জীবনব্যবস্থাই নিখুঁত নয়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের মতো ব্যবস্থাগুলো মানুষের সীমিত জ্ঞান, লোভ এবং প্রবৃত্তির দ্বারা কলুষিত হতে বাধ্য। যখন মানবসৃষ্ট সকল মতবাদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন অনিবার্যভাবে সেই প্রশ্নটি সামনে আসে তবে কি সমাধান নিহিত আছে মানুষের ঊর্ধ্বে কোনো সত্তার বিধানে?

মানুষ তার নিজের জন্য আইন তৈরি করতে গিয়ে বারবার ভুল করেছে, সৃষ্টি করেছে অবিচার আর অসাম্য। অন্যদিকে যিনি এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা, যিনি মানুষের দুর্বলতা ও প্রয়োজন সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত, তাঁর দেওয়া জীবনব্যবস্থাই হলো একমাত্র ত্রুটিমুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান। স্রষ্টার বিধানে যোগ্যতার মাপকাঠি হয় নৈতিকতা ও প্রজ্ঞা, ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়। সেখানে আইনের শাসন হয় নিরপেক্ষ এবং বিচার হয় নিখুঁত, কারণ তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে রচিত নয়।

সুতরাং গণতন্ত্রের মরীচিকার পেছনে ছুটে ক্লান্ত এই জাতির জন্য এখন সময় এসেছে বিকল্প নিয়ে ভাবার। যে মানবসৃষ্ট ব্যবস্থা আমাদের সীমাহীন দুর্নীতি, অনাচার আর বিচারহীনতা উপহার দিয়েছে, তা আঁকড়ে ধরে রাখার মধ্যে কোনো মুক্তি নেই। প্রকৃত শান্তি, নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের ফিরতে হবে সেই চিরন্তন উৎসের দিকে স্রষ্টার দেওয়া নিখুঁত ও শাশ্বত জীবনবিধানের ছায়াতলে। সেখানেই নিহিত আছে মানবজাতির প্রকৃত সাফল্যের চাবিকাঠি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট