
মুখলেছুর রহমান সুমন:
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টির আশায় নবী ইব্রাহিম (আ.) নিজের শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তিনি পুত্রের গলায় ছুরি চালনা করলে আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ইসমাইল (আ.) এর পরিবর্তে একটি দুম্বা জবাই হয়ে যায়। পিতা কর্তৃক নিজের পুত্রকে কোরবানি করার এই ঘটনা নিঃসন্দেহে বিরল ও বিস্ময়কর। কিন্তু আজকে আমি ইসলামের ইতিহাসের এক মহিয়সী নারীর কথা বলবো, যিনি এমন এক কোরবানির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যা পয়গম্বর ইব্রাহিম (আ.) এর কোরবানির চেয়েও অধিক বিস্ময়কর। তিনি নিজের এক পুত্রকে নয়, বরং চারজন পুত্রকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করেছিলেন। আল্লাহর সত্যদীন ইসলামকে দুনিয়াতে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করতে কত মানুষকে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে, নিজের সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করতে হয়েছে, ওই নারীর হৃদয়বিদারক ঘটনা জানার পর আপনি তা কিছুটা হলেও ধারণা করতে পারবেন।
দশম হিজরীতে মদীনায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)। তাঁর ওফাতের পর মুসলিম জাতির অভিভাবক হিসেবে খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন হযরত আবু বকর (রা.)। আবু বকরের খেলাফতকালে আরবের সীমানা ছাড়িয়ে দিকে দিকে ইসলামের বিজয়যাত্রা শুরু হয়। সত্যদীনের বিজয় নিশান উড়াতে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে পরেন রাসুলুল্লাহর (স.) সাহাবীরা। তারা একই সাথে তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমণ করেন। ইরাক ও সিরিয়ায় সমান তালে চলতে থাকে দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধ। এরই মধ্যে হযরত আবু বকর (রা.) ইন্তেকাল করলে নতুন খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন হযরত উমর ফারুক (রা.)। তিনিও বিরতিহীনভাবে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার এই অভিযান অব্যাহত রাখেন।
খলিফা উমরের শাসনামলে হিজরী চতুর্দশ সনে ইরাকের কাদিসিয়ায় মুসলিম ও পারস্য বাহিনীর মধ্যে একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা কাদিসিয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে পারস্য বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল দেড় লাখেরও বেশি। বিপরীতে মুসলিমরা ছিলেন মাত্র ৩২ হাজার। এর আগেও তারা একাধিক যুদ্ধে পারসিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু এত বড় বাহিনী তারা কখনো দেখেন নি। পারসিকরাও অতীতে কখনো কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে এত বিশাল সৈন্যসমাবেশ ঘটায় নি।
তবে মুসিলমরা সংখ্যায় অনেক কম হলেও তাদের আত্মবিশ্বাসে কোনো ঘাটতি ছিল না। মুসলিম সৈনিকরা জানতেন, মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের সাথে বিজয় দানের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য যতটা রক্ত দেয়ার প্রয়োজন, যতটা আত্মত্যাগের প্রয়োজন, তা দিতে প্রস্তুত ছিলেন মুসলিম জওয়ানরা।
কেবল পুরুষ যোদ্ধারা নয়, তাবুতে অবস্থানকারী নারীরাও সে দিন আল্লাহর সত্যদীনের বিজয়ের স্বার্থে নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগের শপথ নিয়েছিলেন। তারা জানতেন, আজকের দিনে তাদের স্বামী, সন্তান আর ভাইয়েরা যারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, দিনশেষে তাদের অনেকেই ফিরে আসবে না। কিন্তু এই বলিদানে তাদের এতটুকু আফসোস কিংবা আপত্তি ছিল না। বরং নিজের পরিবারের পুরুষদের মনে প্রতিনিয়ত সাহস আর উদ্দীপনা জুগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা।
মুসলিম শিবিরের এই আত্মত্যাগী নারীদের একজন ছিলেন খানসা বিনতে আমর (রা.)। খানসা ছিল তাঁর ডাকনাম, যার অর্থ ‘হরিণী’। সাহাবীরা এই নামেই তাকে ডাকতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন কবি। তাঁকে আরব সাহিত্যের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
রসুল (স.) এর ইন্তেকালের চার বছর পর কাদিসিয়ার যুদ্ধে নিজের পুত্রদেরকে নিয়ে উপস্থিত হোন খানসা (রা.)। সেখানে ৩২ হাজার মুসলিম যোদ্ধার বিপরীতে যখন দেড় লাখেরও বেশি পারস্য সৈনিক দাঁড়িয়ে গেল, তখন এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হলো। তবে মুসলিম সৈনিকরা ভেঙে পড়েন নি। বরং আল্লাহ পাকের উপর ভরসা করে তারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর নারীরা এগিয়ে আসেন তাদের স্বামী, পিতা, পুত্র আর ভাইদের মনোবল বৃদ্ধি করার জন্য।
যুদ্ধের প্রাক্কালে হযরত খানসাকে (রা) দেখা যায় তার পুত্রদের সাথে কথা বলতে। তিনি নিজের সন্তানদের উদ্দেশে বলেন, “হে আমার পুত্রগণ! তোমরা খুশি মনে ইসলাম গ্রহণ করেছ। ইসলাম গ্রহণ করতে তোমাদেরকে কেউ বাধ্য করে নি। তোমরা স্বেচ্ছায় হিজরত করেছ। অতএব আজকে আল্লাহর এই দীনকে হেফাজত করা তোমাদের দায়িত্ব।”
খানসা (রা.) বলেন, “আল্লাহ তাআলা জিহাদের বিনিময়ে তাঁর বান্দাদেরকে এত বেশি সম্মানিত করেন, যা অন্য কোনো কাজের বিনিময়ে করেন না। সুতরাং শত্রুর বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য কামনা করবে। যখন যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠবে, শত্রুর সামনে দ্রুত অগ্রসর হবে।”
তিনি আরো বলেন, “আগামীকাল প্রভাতে সুস্থ মনে শয্যা ত্যাগ করে সাহসের সাথে যুদ্ধে যোগদান করবে। শত্রুর সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গায় প্রবেশ করবে, সবচেয়ে সাহসী শত্রুর মোকাবেলা করবে। প্রয়োজন হলে নির্ভীক চিত্তে শহীদ হবে।”
পরদিন সকালে যুদ্ধ শুরু হলে হযরত খানসার পুত্ররা তাদের মায়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তারা চারজনই ছিলেন বয়সে যুবক। তারা যুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশে প্রবেশ করেন। সেখানে সাহসী ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করেন আর বীর বিক্রমে লড়াই করেন। তারা আবেগ-উচ্ছ্বাসে উদ্দীপ্ত রণসংগীত গেয়ে একে অপরকে উৎসাহিত করেন। তাদের এক ভাই কবিতা আবৃত্তি করলেন -হে আমার ভাইয়েরা! রাতের বেলায় আমাদের পরম শুভাকাক্সক্ষী মা আমাদেরকে ডেকে নসিহত করেছিলেন। তার সেই স্পষ্ট নসিহত তোমাদের মনে আছে কি? যদি মনে থাকে তাহলে, ধ্বংসাত্মক ও আকৃতি বিকৃতিকারী ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়।
এই রণকবিতা আবৃত্তি করতে করতে তিনি পূর্ণ সাহসে উদ্দীপিত অবস্থায় যুদ্ধ করে শহীদ হন। একই ভাবে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাইটিও শহীদ হয়ে যান।
তিন ভাইয়ের শাহাদাতের পর চতুর্থ ভাই আবৃত্তি করেন, “খানসার পুত্র বলে পরিচয় পাওয়ার আমার কোনো অধিকার নেই; যদি না আমার ভাইদের মতো আমিও পারস্যবাহিনীর সাথে চরম যুদ্ধে মুখোমুখি হই। যদি না আমি পারস্যবাহিনীর সারিতে প্রবেশ করতে পারি। যদি না বিজয় কিংবা শাহাদাত লাভ করতে পারি।” অতঃপর তিনিও বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান।
এটা ছিল চারদিন ব্যাপী চলমান কাদিসিয়ার যুদ্ধের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় দিবসের ঘটনা। ওই দিনের সংঘর্ষ শেষে মুসলিম যোদ্ধারা যখন তাঁবুতে ফিরে আসছিলেন, তখন খানসা (রা.) তাদের মধ্যে নিজের পুত্রদেরকে খুঁজে বেড়ান। কিন্তু যুদ্ধফেরত সৈনিকদের মধ্যে তাদেরকে দেখা গেল না। কেউ তাদের সন্ধানও দিতে পারলো না। অবশেষে যেখানে শহীদদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেখানে গিয়ে নিজের পুত্রদের মরদেহ খুঁজে পান খানসা (রা.)। তাদের লাশ যখন কবরে নামানো হয় তখন তিনি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এতটুকু বিলাপ করেন নি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করেন নি, কিংবা কোনো আক্ষেপও করেন নি। তিনি বলেন, আমার পালনকর্তা অসন্তুষ্ট হয় এমন কোনো কথা আজ আমি বলবো না। পুত্রদের শাহাদাতের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবো না, হৃদয়েও কোনো কষ্ট পুষে রাখবো না। বরং আমি মহান আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করবো, যিনি আমাকে শহীদ সন্তানদের মা হওয়ার সম্মান ও সৌভাগ্য দান করেছেন। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট আশা করি, তিনি আমাকে তাদের সাথে তাঁর রহমতের ঠিকানা জান্নাতে সাক্ষাৎ করাবেন।
সুধী পাঠক, কাদিসিয়ার যুদ্ধ ছিল তৎকালীন বিশ্বপরাশক্তি পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে দেড় লাখ সেনাসজ্জিত পারসিক বাহিনীকে পরাজিত করে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী। কিন্তু এই বিজয়ের পেছনে কত বাবা-মায়ের কোরবানি, কত সন্তানের বলিদান লুকিয়ে আছে, তার কয়টা ঘটনাই বা আমরা জানি! ইসলামের সোনালি যুগে সেই মানুষেরা যদি তাদের জীবন-সম্পদকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ না করতেন, তাহলে আরবভূমিতে আগত ‘ইসলাম’ নামক এই আদর্শ আমাদের পর্যন্ত কখনোই পৌঁছাতো না।
আজকে চৌদ্দশ বছর পরে এসে আমরা বিশ্বের প্রায় দুইশ’ কোটি মুসলিম ধর্মকর্ম পালন করে যাচ্ছি। কোরবানির নামে কোটি কোটি পশু জবাই করছি। এক বাংলাদেশে প্রতি বছর কম-বেশি এক কোটি পশু জবাই করা হয়। কিন্তু আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে কোরবানি করার জন্য কতজন মানুষ প্রস্তুত, এই প্রশ্নটা কিন্তু থেকে যায়।