
রিয়াদুল হাসান:
খলিফা উমর (রা.) রসুলাল্লাহর নারী সাহাবি শিফা বিনতে আবদুল্লাহকে (রা.) মদিনার বাজার নিয়ন্ত্রক নিযুক্ত করেন। তিনি তলোয়ার হাতে নিয়ে মদিনার দোকানগুলোতে টহল দিতেন।
যে কোনো রাষ্ট্রের একটি কার্যনির্বাহী বিভাগ থাকতেই হয়- এর কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিবর্তিত হলেও আমলা বা সরকারি কর্মকর্তারা চাকরির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত থেকে যান। ফলে দেখা যায়, অনেক সময় জনগণ তো বটেই, এমনকি সরকারগুলোও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। তারা অতিরিক্ত নিয়ম-কানুনের জটিলতা দেখিয়ে জনসেবার কাজে দীর্ঘসূত্রতা করেন এবং এ সুযোগে ঘুষ আদায় করে থাকেন। বহু পুরাতন ও রক্ষণশীল নিয়মকানুন আঁকড়ে থাকার প্রবণতা তাদের মাঝে প্রকট, যার ফলে তারা নতুন ধারণা বা উদ্ভাবনী চিন্তা সহজে গ্রহণ করতে পারেন না। এতে করে উন্নয়নের গতি ব্যাহত হয়। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো, গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় অনেক সময় আমলারা রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন, যার ফলে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও সরকারি কর্মকর্তার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। তাহলে ইসলাম কীভাবে প্রশাসনিক কাঠামোকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে রক্ষা করতে পারে? সেটাই আমরা আজকের আলোচনায় তুলে ধরব।
কঠোর আইন ও তাকওয়া:
রাষ্ট্রীয় কার্যনির্বাহের জন্য বিভিন্ন নির্বাহী বিভাগ গঠন করা হবে। এসব বিভাগের দায়িত্বে নিযুক্ত হবেন দেশের সবচেয়ে যোগ্য, শিক্ষিত, বিশ্বস্ত, আমানতদার, বিনয়ী, ভদ্র, সাহসী এবং তাকওয়ার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ ব্যক্তিরা। নির্বাহী কার্যক্রমে ঘুষ বা দুর্নীতির কোনো সুযোগ থাকবে না এর প্রথম কারণ- দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে অপরাধীকে আল্লাহর আইন অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে। কোনো অবস্থাতেই অপরাধীকে তার সামাজিক অবস্থান বা প্রভাবের কারণে ছাড় দেওয়া হবে না। এই সুশাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে দুর্নীতি ও অন্যায় থেকে মুক্ত রাখার পাশাপাশি শান্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।
দ্বিতীয় কারণ আল্লাহর দেওয়া দীনে ব্যক্তিগত সততার মূল স্পিরিট বা চেতনা থাকবে তাকওয়া। জাতির প্রত্যেকে এই কথার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে যে, আল্লাহ যেটা হালাল করেছেন আমরাও সেটা হালাল করব, আল্লাহ যেটা হারাম করেছেন আমরাও সেটা হারাম (নিষিদ্ধ) করব। ফলে প্রত্যেকটি মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। ইসলাম কী, ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ কী, ইসলামের উদ্দেশ্য কী, মানুষের প্রকৃত এবাদত কী, মানব জীবনের সার্থকতা কীসে, তার পার্থিব ও পরকালীন জীবনের তাৎপর্য কী - এ সকল বিষয়ে যখন মানুষ সঠিক জ্ঞান লাভ করবে তখন সে স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর প্রতিনিধিরূপে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণে অনুপ্রাণিত হবে। তারা বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান, তিনি সব দেখেন, সব শোনেন। তাই অতি সংগোপনেও যদি দুর্নীতি বা অপরাধ করা হয়, সেটার পরিণতি তাকে পরকালে হলেও অবশ্যই ভোগ করা লাগবে। মানুষের চোখ ফাঁকি দেওয়া গেলেও আল্লাহর চোখ ফাঁকি দেওয়া যাবে না। তাই একদিকে শরিয়াহর শাস্তি, অপরদিকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয়, এই দুই দিক বিবেচনা করে মানুষ সৎ থাকবে। সর্ব অবস্থায় তাদের মনে এই বোধ জাগ্রত থাকবে যে তারা পৃথিবীর বুকে আল্লাহর প্রতিনিধিমাত্র (সুরা বাকারা ২:৩০, সুরা আনআম ৬:১৬৫, সুরা বনি ইসরাইল ১৭:১৭০)।
পৃথিবীর অন্যতম সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন আল্লাহর নবী দাউদ (আ.)। তাঁকে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) বানিয়েছি, অতএব তুমি মানুষের মধ্যে সত্য অনুযায়ী বিচার কর এবং তোমার স্বার্থকে অনুসরণ কোরো না, কারণ তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করবে। যারা আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত হয়, তাদের জন্য কঠোর শাস্তি আছে, কারণ তারা সত্যকে অস্বীকার করে।’ (সুরা সাদ ৩৮:২৬)। কাজেই শাসক সর্বাবস্থায় একজন সর্বশক্তিমান মহাপ্রভুর কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। ফলে কোনোদিন কোনো শাসক স্বৈরাচার, উদ্ধত একনায়কে (ঋধপরংঃ, অঁঃড়পৎধঃব, উরপঃধঃড়ৎ) পরিণত হতে পারবে না। তারা সবাই কোর’আনে দেওয়া রাষ্ট্রপরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। সেগুলো হচ্ছে- তারা যে কোনো কাজের আগে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে পরামর্শ করবে (সুরা শুরা ৪২:৩৮), স্বজনপ্রীতি করবে না (সুরা নিসা ৪:১৩৫), পক্ষপাতমূলক আচরণ করবে না (সুরা মায়েদা ৫:৮), অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ গ্রাস তথা দুর্নীতি করবে না (সুরা নিসা ৪:২৯), রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে আল্লাহর আমানত হিসাবে বিবেচনা করবে (সুরা নিসা ৪:৫৮)। তওহীদভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র আল্লাহর হুকুম ও নীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর করবে এবং কোনোভাবেই এর বিচ্যুতি ঘটতে দেবে না।
সিভিল সার্ভিসের ইতিহাস:
বর্তমান সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর ইতিহাস বহু পুরোনো। ব্রিটিশরা যখন যুগপৎ ছলচাতুরি ও সামরিক শক্তিবলে ভারতবর্ষ দখল করেছিল, তখন প্রশাসনিক ও সাচিবিক কাজ চালানোর জন্য তাদের প্রচুর সরকারি কর্মচারী প্রয়োজন ছিল। এত কর্মচারী ব্রিটেন থেকে আনা সম্ভব ছিল না, তাই তারা ভারতের লোকদেরকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করল। এর উদ্দেশ্য লর্ড ম্যাকলে’র Minute on Education (১৮৩৫) নীতিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে, ‘এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে একটি ইংরেজি-শিক্ষিত ‘দ্বিভাষিক শ্রেণি’ (Bilingual class) তৈরি করা হবে, যারা ব্রিটিশ শাসক এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে।’ যেমন আদালতে স্থানীয় লোকদের ভাষা ব্রিটিশ বিচারককে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের প্রয়োজন পড়ত একজন দোভাষীর। তাই ব্রিটিশ সরকার ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়দের মূলত কর সংগ্রহ, ভূমি ব্যবস্থাপনা সেক্টরে নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের প্রশাসনিক এবং দাপ্তরিক কাজে নিযুক্ত করত। আর ব্রিটিশ-ভারত প্রশাসনে উচ্চস্তরের পদগুলোতে কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য ১৮৫৩ সাল থেকে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) পরীক্ষা চালু করা হয়। এই পরীক্ষা নেওয়া হত লন্ডনে আর সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ২২ বছর। আরো নানারকম নিয়ন্ত্রণের কারণে ভারতীয়দের পক্ষে এই পরীক্ষায় পাশ করে আইসিএস অফিসার হওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন। তাই সরকারের উচ্চপদ যেমন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, বিচারক, সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, ডেপুটি কমিশনার, মিলিটারি ও উচ্চ সামরিক পদগুলোতে ব্রিটিশ নাগরিকদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হত। ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ভারতীয়দের উচ্চপদে প্রবেশের কিছু সুযোগ তৈরি করলেও তা ছিল সীমিত। এই উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তারা যৎসামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশই আমাদের দেশের লোকদেরকে বর্বর, মেধাশূন্য মানুষ হিসাবে ঘৃণার চোখে দেখত এবং তাদের সঙ্গে ক্রীতদাসের মত আচরণ করত। এমনকি ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় জনগোষ্ঠীও ব্রিটিশ প্রভুদের আদর্শ অনুসরণ করে নিজেদেরকে ব্রিটিশ সমাজের অংশ মনে করতে শুরু করেছিল। ব্রিটিশরা যখন ভারতের শাসন শেষ করে এবং উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের কাঠামো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় এবং দেশীয় নাগরিকরা সমস্ত স্তরে প্রশাসনিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হন। বাংলাদেশ হওয়ার পরে এর নামই হয় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)।
এই ইতিহাস বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মনস্তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির উৎস অনুসন্ধান করা। এটি আমাদের শাসন ব্যবস্থা এবং সামাজিক মনোভাবের একটি গভীর দিককে তুলে ধরে। ব্রিটিশ শাসনামলে আইসিএস পরীক্ষায় পাশ করে ভারতে আগত ব্রিটিশ কর্মকর্তারা নিজেদেরকে ভারতীয় নেটিভদের দণ্ডমুণ্ডের মালিক মনে করতেন। দেশভাগ এবং স্বাধীনতার পর সেই জায়গায় বসে পড়েন আমাদের সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা। সিস্টেম ও কাঠামোর এক তিল পরিমাণও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। ফলে তাদের মধ্যেও সেই একই সাহেবিয়ানা প্রকাশ পেতে থাকে। অফিসারদেরকে ‘স্যার/ম্যাডাম’ সম্বোধন করতে জনগণকে একপ্রকার বাধ্য করা হয়, আর এ নিয়ে বহু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে (প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের স্যার বলার বিধান নেই- দৈনিক যুগান্তর ১ এপ্রিল ২০২৩)। অথচ সংবিধান অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। তাই জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করা কতটা যৌক্তিক? তাহলে তাদের এমন বিপরীত আচরণের কারণ কী? কারণ হিসাবে কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার ত্রুটি-বিচ্যুতি তো আছেই, মূল কারণ তো সেই ব্রিটিশদের মানসিক দাসসৃষ্টির শিক্ষাব্যবস্থা যা তাদের মননকে বস্তুবাদী জীবনদর্শনের ছাঁচে গড়ে তুলেছে। তাদের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে এই আধ্যাত্মিকতাহীন (মারেফতহীন) বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা। তাদের গন্তব্যকে শৈশবেই বস্তুর প্রতি নিবদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে - লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে। অর্থাৎ জীবনযাত্রার মান-উন্নয়নই শিক্ষার উদ্দেশ্য। এখানে আধ্যাত্মিকতা বা চরিত্রের উৎকর্ষের কোনো শর্ত নেই। এই শিক্ষাব্যবস্থা জীবনের নীতি নির্ধারণে স্রষ্টা, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদিকে কোনো বিবেচনায় নেয় না। এ শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাছে ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড আল্লাহ নন। কোনো চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষের প্রতি তারা তাদের কোনো কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আধ্যাত্মিক বা নৈতিক দায়বদ্ধতা লালন করেন না। তারা দেশের আইন ও চাকুরি বিধির প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন। তাই অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে হাতে রাখতে পারলে বা আইনের ফাঁক ফোকর ব্যবহার করতে পারলেই তারা অর্থপিশাচে পরিণত হন। আল্লাহ তাদের সব কর্মকাণ্ড দেখছেন, তাদেরকে এর জন্য পরকালে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়াতে হবে এমন কোনো চিন্তা তাদেরকে পুকুরচুরি করা থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। অথচ আল্লাহ ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়কে অভিশাপ দিয়েছেন (তিরমিজি:৬/৩১৫)। এই আমলারা কী পরিমাণ দুর্নীতি করতে সক্ষম তার উদাহরণ আমরা সাম্প্রতিক সময়ে লাভ করেছি। আমাদের কথা হচ্ছে, তাদের এই চারিত্রিক অধঃপতনের গোড়া শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত।
ইসলামের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ইতিহাস:
ইসলামের প্রথম যুগে রসুলাল্লাহ (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদার আমলেও বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেগুলোতে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হতো। পাশাপাশি উম্মাহর জন্য তাদের ত্যাগ, ব্যক্তিগত চরিত্র, সদাচার, মো’মেনের গুণাবলি বিচার করে তাদের এসব দায়িত্ব অর্পণ করা হত। যেমন খলিফা উমরের (রা.) সময় রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দায়িত্বে ছিলেন আবু ওবায়দাহ (রা.) যাঁকে স্বয়ং আল্লাহর রসুল আমিনুল উম্মাহ বা উম্মতের মধ্যে বিশ্বস্ত ব্যক্তি বলে উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর দায়িত্বের প্রতি কতটা বিশ্বস্ত ছিলেন সংক্ষেপে তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। এক ঈদের আগের দিন খলিফা উমর (রা.) এর স্ত্রী তাঁর সন্তানের জন্য ঈদের নতুন জামা কেনার আবদার জানালেন। অর্ধ পৃথিবীর খলিফা উমর বললেন, ‘নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য আমার নেই।’ পরে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দায়িত্বশীল আবু ওবায়দাকে এক মাসের অগ্রিম বেতন চেয়ে চিঠি লিখেন। চিঠি পেয়ে আবু ওবায়দা (রা.) খুবই ব্যথিত হলেন এমনকি তিনি কান্না করলেন। কিন্তু তিনি খলিফাকে চিঠির জবাবে অগ্রীম বেতন দেওয়ার বিষয়ে অপরাগতা প্রকাশ করলেন। তিনি লিখলেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আগামী মাসের অগ্রিম বেতন বরাদ্দের জন্য আপনাকে দুটি বিষয়ে ফয়সালা দিতে হবে- আগামী মাস পর্যন্ত আপনি বেঁচে থাকবেন কি-না? আর বেঁচে থাকলেও দেশের জনসাধারণ আপনাকে আগামী এক মাস খেলাফতের দায়িত্বে বহাল রাখবেন কি-না?
খলিফা উমর (রা.) আবু ওবায়দার (রা.) চিঠি পড়ে এর কোনো জবাব দিলেন না। শুধু দু’হাত তুলে আবু ওবায়দার (রা.) মত এমন একজন যোগ্য ব্যক্তিকে জাতির বায়তুল মালের রক্ষক করার জন্য আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানালেন। (ফাতহুল বারি, তাবারি)।
বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৪২ জন সাহাবি রসুলাল্লাহর কাতেবে ওহি (Scribes of revelation) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন জায়েদ বিন সাবিত (রা.)। তারা রসুলাল্লাহর পক্ষ থেকে সরকারি চিঠিপত্র লিখে দিতেন। আবু বকরের (রা.) আমলে তিনি বিভিন্ন স্থানে লিখিত কোর’আনের পাণ্ডুলিপিগুলোকে একত্রিতভাবে লিপিবদ্ধ করে জায়েদ (রা.) এই দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। উসমান (রা.)-এর শাসনামলে বায়তুল মাল (অর্থ দপ্তর) পরিচালনার জন্য আলাদা হিসাবরক্ষক নিয়োগ করা হয়, যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আলী (রা.)-এর আমলে তিনি একজন দক্ষ বিচারক হিসেবে কাজ করতেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতেন। উমর (রা.) শিফা বিনতে আবদুল্লাহকে (রা.) মদিনার বাজার নিয়ন্ত্রক (Market Controller) এবং সামারা বিনতে নাহিক-কে (রা.) মক্কার ‘বাজার নিয়ন্ত্রক’ পদে নিয়োগ দেন। উমর (রা.)-এর আমলে সেনাবাহিনী ও অস্ত্রাগারের জন্য পৃথক বিভাগ গঠিত হয়, যা সামরিক ব্যবস্থাপনা এবং জাতীয় নিরাপত্তা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করত। রুফায়দাহ (রা.) চিকিৎসা সেবা ও যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদের যত্নের মাধ্যমে প্রশাসনিক কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। দক্ষতা ও চরিত্রের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হলে অনেক অমুসলিম নাগরিকও সরকারি বিভাগগুলোতে নিয়োগলাভ করেছেন। যেমন উমরের (রা.) সময় সিরিয়ার দামেস্কে জাবাল নামে একজন খ্রিষ্টানকে হিসাবরক্ষণের কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল।
আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোনো ব্যক্তির ভৃত্য স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বোখারি ও মুসলিম)।
অন্যায় সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে সব ধরনের সুবিধা ও আর্থিক লেনদেনকেই ঘুষের অন্তর্ভুক্ত করে ইসলাম, তা যে নাম ব্যবহার করেই করা হোক না কেন। রসুলাল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে যাকাত আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। কাজ শেষে তিনি ফিরে এসে কিছু দ্রব্য আলাদা করে বলেন, ‘এটা বায়তুল মালের সম্পদ এবং এটি আমাকে হাদিয়া (উপহার) দেওয়া হয়েছে।’ রসুলাল্লাহ (সা.) তখন মিম্বরে উঠে বললেন, ‘এক ব্যক্তি বলছে যে এই সম্পদ তাকে হাদিয়া হিসাবে দেওয়া হয়েছে। তাহলে কেন সে তার মা-বাবার ঘরে বসে থাকল না, তখন দেখতে পেত, কেউ তাকে হাদিয়া দেয় কি না! আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, সে যদি কোনো জিনিস অন্যায়ভাবে গ্রহণ করে, তবে কিয়ামতের দিন তা নিজের ঘাড়ে বহন করবে।’ (সহীহ বুখারি ৬৯৪৭, সহীহ মুসলিম ১৮৩২)।
আমাদের প্রস্তাব:
আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তাদেরকে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক প্রভুদের মানসিক দাসত্ব থেকে বের করে আনতে হবে। তারা যেন প্রকৃতপক্ষেই জনগণের সেবক হন ও মানুষের ভালোবাসা লাভ করেন, সরকারি দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে যেন আখেরাতেও পুরস্কৃত হন এ ধরনেরই একটি সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা সাজানোর প্রস্তাব আমরা করছি। স্বভাবতই সাচিবিক কার্যাদি সম্পাদনের জন্য একটি শক্তিশালী সেক্রেটারিয়েট থাকবে। এই ব্যবস্থার নীতিগুলো হবে এমন-
উদ্দেশ্য: সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের দায়িত্বপালনের উদ্দেশ্য হবে প্রশাসনিক কার্যাদি সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে নাগরিক সেবা প্রদান করা। তাদের মনে রাখতে হবে, তারা জনগণের প্রভু নন, বরং জনগণের সেবক। তারা এমন একটি জাতির দায়িত্ব নিয়েছেন যে জাতির অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যপীড়িত, ক্ষুধার্ত, অস্থিচর্মসার, কৃষক ও শ্রমজীবী। তাদেরই রক্তপানি করা খাজনা ও করের টাকায় কর্মকর্তাদের বেতন চলে। তাই ব্রিটিশ সাহেবদের মত রাজকীয় জীবনযাপন তাদের মানায় না।
চরিত্র: এখানে যারা কাজ করবেন তাদেরকে শুধু দুনিয়াবি জ্ঞানের অধিকারী ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী হলে চলবে না বরং তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতি নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন। তাদের বিশ্ব পরিস্থিতি, আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি সম্পর্কে জানাশোনা যেমন থাকতে হবে, তেমনি তাদেরকে সচেতন হতে হবে দেশের সংস্কৃতি ও মানুষের চাহিদা সম্পর্কে। এগুলো হচ্ছে তাদের জাগতিক জ্ঞানের পরিসীমা। সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য তাদেরকে অবশ্যই চারিত্রিক মানদণ্ডেও উত্তীর্ণ হতে হবে এবং সেটা যাচাইয়ে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হবে। চরিত্রের মাপকাঠি হচ্ছে তারা হবেন মুত্তাকি, সত্যবাদী, আমানতদার ও ওয়াদা রক্ষাকারী।
প্রশিক্ষণ: নির্বাচিত তরুণদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে। প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকবে প্রশাসনিক কার্যক্রম, মাঠপর্যায়ে কাজ করার দক্ষতা, নেতৃত্ব প্রদানের কৌশল, বক্তব্য প্রদান ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, যোগাযোগে পারদর্শিতা, সংকট মোকাবিলার কৌশল এবং সর্বোপরি নৈতিকতা ও জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধতা। প্রশিক্ষণের মেয়াদ ও বিষয়বস্তু পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন অনুসারে নির্ধারণ করা হবে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব ও চাহিদার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণের কাঠামো তৈরি করা হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতি, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং প্রশাসনিক লক্ষ্য অনুযায়ী নতুন বিষয়বস্তু প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
সুযোগ সুবিধা: তাদেরকে রাষ্ট্র থেকে সেবার বিনিময়ে গ্রহণযোগ্য হারে এবং সমতার ভিত্তিতে সম্মানজনক জীবিকা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। তাদেরকে দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পোষ্যানুপাতে বেতন, বোনাস, পেনশন, বাসস্থান, যাতায়াত, চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
জবাবদিহিতা ও শাস্তি: ঘুষ, দুর্নীতি, ক্ষমতা ও প্রকল্পের অর্থের অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, মিথ্যা তথ্য প্রদানসহ যেকোনো অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। এ ক্ষেত্রে তারা সাধারণ নাগরিকদের মতোই একই ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হবেন। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার কারণে তারা কোনো বাড়তি আইনি সুবিধা পাবেন না, বরং তাদের উপর আরও বেশি স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার দায় আরোপিত থাকবে।
অবৈতনিক সেবা: বিনা বেতন-ভাতায় স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে সেবা দিতে আগ্রহীদের মধ্য থেকে যোগ্যতা অনুপাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের বিধান থাকবে।
[যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৬২১৪৩৪২১৩, ০১৭৮৩৫৯৮২২২]