
দেশজুড়ে ডেস্ক:
সন্ধ্যার নরম আলোয় যখন চারদিক ডুবে যায় ম্লান রঙের ছায়ায়, তখন জামালপুরের ছনকান্দা হরিপুরের কড়ই গাছের নিচে পড়ে থাকেন এক বৃদ্ধা- ফাতেমা বেগম। সাত দশক পেরিয়ে আসা এই জীবন এখন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, হাঁটতে তো দূরের কথা। দুই পা একেবারে অচল, একটি হাত ভাঙা, আরেকটিতে কেবল স্মৃতি হয়ে থাকা সামান্য শক্তি। ছোট্ট একটা ঝুপড়ি, যা নিজেরও নয়- পরের জমিতে। সেই কুড়েঘরের মাটিতে যেন মিশে গেছে ফাতেমার সমস্ত জীবনযাপন। দুই বছর ধরে নড়াচড়া করতে পারেন না। চারপাশের শূন্যতা আর নীরবতাই তার চিরসঙ্গী।
দুই দশক আগে স্বামী মহির মারা গিয়েছিলেন। সন্তান ছিল না, আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই। তেমনই একা একা কেটে গেছে দিন, মাস, বছর। এখন আর কারও কাছে সাহায্য চাওয়ার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। প্রতিবেশীরা মায়ায় ভর করে খাবার দেন যখন পারেন, না পারলে ফাতেমার জন্য রাতটা হয়ে ওঠে এক টুকরো দীর্ঘ উপবাস।
ঈদগাহ মাঠের পাশের কড়ই গাছ- আজ যেন তার পৃথিবীর একমাত্র ছায়া। মাটির গায়ে হেলে থাকা তার কাঁপা শরীর, চোখের গভীরে জমে থাকা একরাশ অতৃপ্তি -সব মিলিয়ে এক নিঃশব্দ আকুতি।
প্রতিবেশীরা বলেন, আগে কখনো সাহায্য চাইতেন, এখন সেটাও পারেন না। মাসে একবার গোসল করানো আর ঘর পরিষ্কার করাও তাদের পক্ষে নিয়মিত সম্ভব হয় না। ফলে ঘরের ভেতরেই মলমূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন ফাতেমা বেগম, যা আরও অবনতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে তার শরীর।
মো. মোফাজ্জল হোসেন, এক প্রতিবেশী, বলেন, “দেখলে বুক ফেটে যায়। কতটুকু আমরা পারি, তা-ই করি। কিন্তু তাতে তার কষ্ট কমে না।”
কল্পনা বেগম নামের আরেকজন বলেন, “আমরা তো গরিব মানুষ, সাধ থাকলেও সাধ্য কম।”
এলাকাবাসীর করুণ আবেদন- ফাতেমা বেগমকে যেন একটি বৃদ্ধাশ্রমে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে যত্নের ছায়ায় অন্তত জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে পারেন একটু মানবিক সম্মানে।
এই খবর পেয়ে জামালপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিন্নাত শহীদ পিংকি ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন কিছু খাবার আর আর্থিক সহায়তা। ইউএনও জানান, ফাতেমার জন্য চিকিৎসা ও নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজন হলে একটি ভালো মানের বৃদ্ধাশ্রমেও পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ফাতেমা বেগমের চুপ করে থাকা কাহিনি হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। কিন্তু রেখে যাবে এক অবিনশ্বর প্রশ্ন- কেন এত মানুষের ভিড়ে, এত উন্নয়নের শহরে, একটা মানুষের বাঁচার জন্য জায়গা হলো না?