
শামীমা অবন্তী:
আমরা সকলেই জানি যে, আল্লাহর রসুল (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে আখেরি যামানায় বিরাট বাহনে চড়ে এক চক্ষুবিশিষ্ট মহাশক্তিধর দানব (দাজ্জাল) পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে নিজেকে মানবজাতির ‘রব’ বা প্রভু বলে দাবি করবে। সে সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে পদদলিত করবে। এই দাজ্জাল শব্দটি ইংরেজি শব্দ ‘উধুুষব’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো চোখ ধাঁধানো, চমকপ্রদ প্রতারণা। রসুলাল্লাহর সময়ের নিরক্ষর আরবদের যান্ত্রিক সভ্যতার প্রযুক্তিগত কৌশলের ওপর ভিত্তি করা মহাশক্তিশালী সভ্যতা সম্বন্ধে বোঝাবার চেষ্টা অবশ্যই অর্থহীন হতো, তাদের পক্ষে তা বোঝা মোটেই সম্ভব ছিলো না। তাই আল্লাহর নবী এটাকে তাদের কাছে রূপকভাবে (Allegorically) বর্ণনা করেছেন। চৌদ্দশ’ বছর আগের নিরক্ষর আরবদের পক্ষে সম্ভব না হলেও বর্তমানে দাজ্জাল সম্বন্ধে মহানবীর ভবিষ্যদ্বাণীগুলি যাচাই করলে সন্দেহের কোন স্থান থাকে না যে মহাশক্তিধর পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতাই হচ্ছে আল্লাহর রসুল বর্ণিত সেই নির্দিষ্ট দাজ্জাল। যেমন:
১. আল্লাহর রসুল বলেছেন, দাজ্জালের শক্তি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি পৃথিবীর সমস্ত মাটি ও পানি (ভূ-ভাগ ও সমুদ্র) আচ্ছন্ন করবে। সমস্ত পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ চামড়া দিয়ে জড়ানো একটি বস্তুর মতো তার করায়ত্ত হবে (মুসনাদে আহমদ, হাকীম, দারউন নশুর)। বর্তমানের ইহুদি-খ্রিস্টান যান্ত্রিক সভ্যতাই যে দাজ্জাল, এটি সিদ্ধান্ত যারা অস্বীকার করবেন বা এতে সন্দেহ করবেন, তারা দয়া করে আমাদের বলে দেবেন, তাহলে রাসুলাল্লাহ এই হাদিসে কাকে বা কী বোঝাচ্ছেন? সমস্ত পৃথিবীর মাটি ও পানি, অর্থাৎ পুরো পৃথিবীকে আজ কোন মহাশক্তি আচ্ছন্ন করে রেখেছে? তারা একটু চিন্তা করলেই দেখতে পাবেন যে, সেই শক্তি অবশ্যই পাশ্চাত্যের ইহুদি-খ্রিষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতা। সমগ্র পৃথিবীতে আজ এর শক্তি অপ্রতিরোধ্য।
২. আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন- দাজ্জালের কাছে রেযেকের বিশাল ভাণ্ডার থাকবে। সেখান থেকে সে যাকে ইচ্ছা তাকে দেবে। যারা তার বিরোধিতা করবে তাদের সে ঐ ভাণ্ডার থেকে রেযেক দেবে না। এইভাবে সে মুসলিমদের অত্যন্ত কষ্ট দেবে। যারা দাজ্জালকে অনুসরণ করবে তারা আরামে থাকবে আর যারা তা করবে না তারা কষ্টে থাকবে। [বুখারী ও মুসলিম]
পৃথিবীর সম্পদের সিংহভাগই বর্তমানে পাশ্চাত্যের ইহুদী-খ্রিষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার দখলে। এই সম্পদ থেকে দাজ্জাল শুধু তাদেরকেই দেয় যারা তাকে মেনে নিয়েছে, তাকে স্বীকার করেছে, স্রষ্টার দেয়া জীবন-বিধান ত্যাগ করে দাজ্জালের সৃষ্ট তন্ত্রমন্ত্র, বাদ, নীতি গ্রহণ করেছে। পৃথিবীর যে কোন দেশ বা জাতি দাজ্জালের একটু অবাধ্যতা করলেই তাকে সব রকম সাহায্য দেয়া বন্ধ (ঊপড়হড়সরপ ঝধহপঃরড়হ) করে দেয়, তার ওপর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক অবরোধ (Embargo) স্থাপন করে। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক সাহায্য তহবিল (Consortium) ইত্যাদি, এক কথায় দাজ্জালের অধীনে যত কিছু আছে তার কোন কিছু থেকেই কোন সাহায্য পাওয়া যায় না।
৩. দাজ্জালের ডান চোখ অন্ধ হবে (আব্দুলাহ বিন ওমর (রা.) থেকে বোখারী ও মুসলিম)। পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার ডান চোখ অন্ধ, অর্থাৎ এ সভ্যতায় কেবল বস্তুকেই চূড়ান্ত সত্য বলে মানা হয়, আধ্যাত্মিক জগত, পরকাল, স্রষ্টা, মালায়েক ইত্যাদির অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।
৪. রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, দাজ্জাল এত দ্রুতগতির হবে যে জুমার সালাত আদায়ের সময়ের মধ্যেই পুরো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারবে। আজকের যুগে উপগ্রহ (satellite) প্রযুক্তি এবং মহাকাশ অভিযানের অগ্রগতি এই হাদিসের তাৎপর্য বুঝতে সাহায্য করে। বর্তমানে বিভিন্ন উপগ্রহ ঘণ্টায় ১৮,০০০ মাইল গতিতে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এবং মানুষেরা দীর্ঘ সময় ধরে মহাকাশ স্টেশনে অবস্থান করতে পারে।
৫. রসুলাল্লাহ বলেছেন, দাজ্জালের গতি হবে অতি দ্রুত। সে বায়ুতাড়িত মেঘের মতো আকাশ দিয়ে উড়ে চলবে [নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে মুসলিম, তিরমিযি]। দাজ্জাল, অর্থাৎ পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতার তৈরি অ্যারোপ্লেন যখন আকাশ দিয়ে উড়ে যায়, তখন সেটাকে বায়ুতাড়িত, অর্থাৎ জোর বাতাসে চালিত মেঘের টুকরোর মতো দেখায় - তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন কি?
৬. আল্লাহর রসুল আরও বলেছেন, দাজ্জাল পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কী হচ্ছে তা শুনতে ও দেখতে পাবে। আধুনিক ইলেকট্রানিক ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন পুরো বিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে।
৭. রসুলাল্লাহ বলেছেন, দাজ্জালের আদেশে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হবে (মুসলিম, তিরমিযি)। ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি আকাশে হালকা মেঘের ওপর অ্যারোপ্লেন দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ ছিটিয়ে (ঈষড়ঁফ ংববফরহম) বৃষ্টি নামাতে পারে। চীন, ইন্দোনেশিয়া, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ঐ প্রক্রিয়ায় কৃষি কাজের জন্য বৃষ্টি নামানো হচ্ছে।
৮. দাজ্জালের গবাদি পশু আকারে বড় হবে এবং প্রচুর পরিমাণে দুধ দেবে (মুসলিম, তিরমিযি)। আধুনিক genetic engineering Ges selective breeding প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পশ্চিমা বিশ্বে গবাদি পশুর আকার বড় হচ্ছে এবং তারা চার-পাঁচগুণ বেশি দুধ উৎপাদন করছে।
৯. রসুলাল্লাহ দাজ্জালের আরেকটি বৈশিষ্ট্য বলেছেন যে, তার আদেশে মাটির নিচের সম্পদ উঠে আসবে এবং সেগুলো তাকে অনুসরণ করবে (মুসলিম, তিরমিযি)। আজকের যুগে Oil drilling ও Mineral extraction প্রযুক্তির মাধ্যমে মাটির নিচের সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে এবং পশ্চিমারা এটি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে।
এই হাদিসগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রসুল (সা.) যে এক ভয়ঙ্কর শক্তির আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেটি বর্তমান পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার সাথে হুবহু মিলে যায়। আজ মুসলিমসহ সমগ্র মানবজাতি দাজ্জালকে (পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা) প্রভুর (রব) আসনে স্থান দিয়েছে এবং তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলছে, অর্থাৎ তাকে সেজদাহ (আনুগত্য) করছে। এই সভ্যতার সামরিক শক্তি, শক্তিশালী মিডিয়া এবং অর্থনৈতিক শক্তি এত ব্যাপক এবং শক্তিশালী যে, মুসলিম বিশ্বের কেউ পশ্চিমা জীবনদর্শন থেকে বেরিয়ে বিকল্প ঐশী বা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান গ্রহণ করার হিম্মত করছে না। ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসাবে জানা সত্ত্বেও একে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখছে। সুতরাং, মুসলিম জাতির মধ্যে আল্লাহর দেওয়া বিধান বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ হচ্ছে:
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মুসলিম বিশ্বকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমরা দাজ্জালের অনুসরণ করব, নাকি নিজেদেরকে দাজ্জালের প্রভাব থেকে মুক্ত অর্থাৎ স্বতন্ত্র করব? যদি আমরা মানুষের তৈরি জীবনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই, তবে আমাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে এবং একটি বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অনেকে মনে করেন, এই যুগে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব বলয়ের বাইরে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বস্তুত, এটি এক প্রকার মানসিক দাসত্ব, যা বিগত কয়েক শতাব্দী থেকে অন্ধভাবে তাদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করার ফলে আমাদের চিন্তা-চেতনায় ঠাঁই গেড়ে বসেছে। এখন আল্লাহর উপর ভরসা করে এই অকারণ পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠে ইসলামের মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের সময় এসেছে।
[লেখক: শামীমা অবন্তী, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]