
জাবের হোসেন:
পটুয়াখালীর বাউফলে আলোচিত মরণফাঁদ ‘সেবা ক্লিনিকের’ চরম অনিয়ম ও ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় নিহত প্রসূতি আখিনুর বেগমের পিতা-মাতাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বিষয়টি রফাদফা করেছে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। পাঁচ লাখ টাকা পাওয়ার পর নিহতের পিতা জালাল প্যাদা ও তার পরিবার অভিযোগ তুলে নিয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে বাউফল উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বাহাদুর বয়াতির স্ত্রী ও দাসপাড়া ইউনিয়নের দাসপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. জালাল প্যাদার মেয়ে আখিনুরের প্রসব বেদনার পর ১৪ মে বাউফল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এসময় কর্তব্যরত নার্স নরমাল ডেলিভারি করার উদ্যোগ নেন। এরই মধ্যে এক দালাল ও হাসপাতালের এক নার্স আখিনুর ও তার স্বজনকে ভয় দেখিয়ে দ্রুত সেবা ক্লিনিকে নিয়ে সিজার করার নির্দেশ দেন। ওইদিন সন্ধ্যার পর সেবা ক্লিনিকের অপারেশন থিয়েটারে ডা. সোলায়মান নামের এক চিকিৎসক আখিনুরের সিজার করে একটি কন্যা সন্তানের জম্ম দেন। দীর্ঘক্ষণ পরেও আখিনুরের জ্ঞান ফিরে না আসায় অপারেশন থিয়েটারে থাকা টিম নিশ্চিত হন তার মৃত্যু হয়েছে। পরে তড়িঘড়ি করে সেবা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অখিনুরের লাশ উন্নত চিকিৎসার নামে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। এরই ফাঁকে চিকিৎসক ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ গা ঢাকা দেয়। পরে আখিনুরকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকরা স্বজনদের জানান অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।এদিকে মেয়ের মৃত্যুর পর হত্যার বিচারের দাবি করে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষসহ ডাক্তার ও নার্সের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা করার উদ্দেশ্যে লিখিত অভিযোগ দেন বাবা জালাল প্যাদা। কিন্তু সপ্তাহ পার না হতেই বিষয়টি মাত্র ৫ লাখ টাকায় রফাদফা করে জালাল অভিযোগ তুলে নিয়েছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে সম্প্রতি অলৌকিক শক্তির বলে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রসূতি আখিনুরের মৃত্যুর একদিন পরই গত ১৬ মে নরায় ব্যবসার উদ্দেশ্যে খুলে বসেন মরণফাঁদ নামক সেবা ক্লিনিক। সেই সংবাদ প্রশাসনের নজরে আসলে ওইদিনই দুপুরের দিকে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জরিমানাসহ অনির্দিষ্টকালের জন্য সিলগালা করে দেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ক্লিনিক বন্ধ হওয়ায় উপায়ান্ত না পেয়ে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ নিহতের বাবা জালাল প্যাদা ও তার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে গত ১৮ মে গোপন বৈঠক করে পাঁচ লাখ টাকায় বিষয়টি রফাদফা করে। ওইদিনই সই-স্বাক্ষর নিয়ে পরিবারটিকে ৫ লক্ষ টাকা বুঝে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রফাদফার বিষয়টি প্রথমে নিহতের স্বামী ও শ্বশুর বিষয় জানতে না বলে দাবি তাদের। তবে রফাদফার টাকা নবজাতকের নামে ব্যাংকে ডিপোজিট করে না রাখা হলে তারা পুনঃরায় হত্যা মামলা দায়ের করার হুমকি দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে বিষয়টি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের কানে গেলে তারা নিহতের বাবা ও পরিবারের লোকজনকে নিহতের স্বামী ও শ্বশুরের সাথে দেওয়া টাকা নিয়ে মীমাংসা করতে বলেন। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার (২৮ মে) নিহতের রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া মিলাদ করে বাবা জালাল প্যাদা তার স্থানীয় মেম্বারকে ডেকে নিহতের স্বামী ও শ্বশুরকে নিয়ে ওই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে সবাই বিষয়টি মেনে নেন।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বুধবার (২৪ মে) জেলা সিভিল সার্জন কর্তৃক একটি ৪ সদস্যের টিম তদন্তে এসে প্রথমে সেবা ক্লিনিকে সার্চ চালায়। সে সময় তারা সিজার অপারেশনের কাজে ব্যবহার করতে ডেট ওভার ৫টি ইনজেকশন সহ একাধিক ঔষধ ও ফ্রিজে রাখা পচা মাছ মাংস উদ্ধার করেন। পরে তদন্তের স্বার্থে নিহতের বাবা-মা ও স্বামী-শ্বশুর, ক্লিনিক কর্তৃপক্ষসহ ডাক্তার নার্সদের ডাকা হয়। সেখানে সবাই উপস্থিত হলেও অভিযুক্ত চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন না।
তদন্ত টিম প্রধান ডাক্তার কেননং জানান, সেবা ক্লিনিক ও ডাক্তারের অনিয়ম ও ভুল চিকিৎসার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর নিহতের বাবা মা জানিয়েছেন তাদের নাকি কোনও অভিযোগ নেই। তবে স্বামী ও শ্বশুর এ ব্যাপারে বিচার দাবি করতে পুনরায় হত্যা মামলা দায়ের করবেন জানিয়েছেন। তবে তদন্ত চলমান রয়েছে শেষে সিভিল সার্জন কর্তৃক উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন।
ভুক্তভোগী ওই পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, বিচার চাইতে গেলে আমাদের বছরের পর বছর আদালত চত্ত্বরে ঘুরতে হবে। আমাদের মেয়ে তো বেঁচে নাই, তার জন্ম দেওয়া সন্তানের কথা চিন্তা করে আমরা রফাদফায় সম্মত হয়েছি। ক্লিনিক মালিকরা বড়লোক। আমরা বিচার চাইতে চাইতে এক সময় তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আবার ক্লিনিক চালু করবেই।
তবে বিষয়টি রফাদফার জন্য সেবা ক্লিনিকের মালিক পক্ষ কিংবা চিকিৎসকদের থেকে কোনো হুমকি-ধামকি দিয়েছে কিনা এ ব্যাপারে জালাল প্যাদা বা তার পরিবারের কেউ মুখ খোলে নি।