
শাহাদৎ হোসেন:
‘বাসচাপায় অটোরিকশার ৬ জন নিহত’, ‘অটোরিকশা-ট্রাকের সংঘর্ষে একই পরিবারের চারজন নিহত’, ‘ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশার ৫ যাত্রী নিহত’, ‘মাইক্রোবাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে দুইজন নিহত’, ‘বেপরোয়া অটোরিকশার চাপায় শিশুর মৃত্যু’ -এরকম শিরোনামের খবর এখন প্রতিদিনের পত্রিকার কমন খবরে পরিণত হয়েছে। যদি হিসাব করা হয় বর্তমানে সড়কে সংগঠিত দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যার দিক থেকে বাস বা অটোরিকশার চাপায় অটোরিকশার যাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনা বেশি পাওয়া যাবে। সারাদেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলায় হত্যাকাণ্ড যতটা না ঘটছে তার চেয়ে বেশি নিহত হচ্ছে মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল ও দুর্ঘটনার কারণে।
বাংলাদেশে ২০১৫ সালে মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। তবে নিষিদ্ধ করা হলেও গত এক দশকে মহাসড়কে অটোরিকশা কমে যাওয়ার পরিবর্তে সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। ব্যাটারি বা সিএনজিচালিত এসব অটোরিকশার কারণে যে মানুষগুলো মারা যাচ্ছে তার দায়ভার সরকার, অবৈধ অটোচালক, এসবের কর্তৃপক্ষের উপরই বর্তায়। মহাসড়কে অটোচালকদের ভাবসাব দেখলে মনে হয় তারা যেন রাস্তার একমাত্র দাবিদার। আগে পৌঁছানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে বেপরোয়া গতিতে চালানো হয় অটোরিকশাগুলো। আয়তনে ছোট হওয়ায় চিপাচাপা, বাস-ট্রাকের পাশ দিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে অটোরিকশা চালানোর ঘটনা ঘটে হরহামেশা।
গতকালই শেরপুর সদর উপজেলায় শেরপুর-ঢাকা মহাসড়কে বাসের সঙ্গে অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে ৬ জন মারা যায়। তাদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ৫ জন। এর দুই-তিনদিন আগে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার ময়মনসিংহ-নেত্রকোণা মহাসড়কে অটোরিকশা ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু ঘটে। বিভিন্ন পত্রিকার খবর অনুযায়ী চলতি ডিসেম্বর মাসেই মহাসড়কে অটোরিকশা ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ মারা যায়।
সমাজে সাধারণত কোনো অপরাধ বেড়ে গেলে তা থামাতে রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। যেমন- জঙ্গি হামলার সম্ভাবনা কিংবা মাদক বেড়ে যাওয়ায় ইতিপূর্বে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন বাহিনীর সহায়তায় কঠোর অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। বাংলাদেশে অটোরিকশার কারণে প্রতি মাসে যত মানুষ মারা যাচ্ছে বিগত কয়েক যুগের জঙ্গি হামলায়ও এত মানুষ মারা যায়নি।
মহাসড়কে বাস, মোটরসাইকেল কিংবা অটোরিকশার যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো কারও কাম্য নয়। তবে নিষিদ্ধ অটোরিকশা চলাচলের কারণে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো কোনোভাবেই কারও কাম্য নয়।
অপরদিকে অল্প পুঁজি দিয়ে অটোরিকশা সড়কে নামাতে পারলে প্রতিদিন একটা হ্যান্ডসাম ইনকামের আশায় অনেকে অটোরিকশা কিনে মহাসড়কে তুলে দিচ্ছে। অধিকাংশ অটোরিকশা চালকদের না আছে প্রশিক্ষণ, না আছে কোনো লাইসেন্স। ছোট এসব যানবাহনের মালিক কিংবা চালক সবাই বলা যায়, দিন-দুনিয়ার খবরও রাখেন কিনা সন্দেহ আছে। মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচলের কারণে সারাদেশে যে নীরব হত্যাকাণ্ড ঘটছে তা হয়তো তারা জানেনও না।
আমাদের দেশের সরকার-প্রশাসন তথা উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত একটা সাধারণ সমস্যা হচ্ছে, কোনো কিছু ঘটলে হয় সেটার লাইসেন্স ছিল না, অথবা কোনো পক্ষকে দায়ী করে দায়সারা গোছের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মহাসড়কে অটোরিকশা দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটলে বিষয়টি কোনো এক পক্ষকে দোষ দিয়েই শেষ। এসব ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে সে ব্যাপারে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
মহাসড়কে অটোরিকশার কারণেই যে শুধু মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে তা না। আরও অনেক কারণে বাস, ট্রাক, মাইক্রো বা অন্যান্য বড় যানবাহনও প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। সেখানে মহাসড়কে অবৈধভাবে চলাচলের কারণে অটোরিকশার কারণে মৃত্যুর খাত একটা বেড়ে গেছে। পূর্বে বলেছিলাম, দেশের ইতিহাসে জঙ্গি হামলায় যত না মানুষ মারা গেছে অটোরিকশার কারণে প্রতি মাসেই তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে বা অটোরিকশার কারণে মহাসড়কে তার চেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। তাই দায়িত্ব এড়িয়ে না গিয়ে অটোরিকশা চালিত এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রোধে সরকারকে কঠোর থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে জঙ্গি রোধে যে রকম বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়েছে এবং যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, সড়কে মানুষ হত্যা রোধে সেরকম বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। এছাড়াও মালিক ও চালকদেরকে মহাসড়কে অটোরিকশা না চালিয়ে অন্য সাধারণ সড়কে চালানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া এবং কাউন্সিলিং করা যেতে পারে।
অপরদিকে মহাসড়কে অটোরিকশা জনিত হত্যাকাণ্ডরোধে অটোরিকশা নিষিদ্ধ করার আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ; মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা; অটোরিকশা চালক বা মালিকদের বিরুদ্ধে আইন অমান্য করলে জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিল; অটোরিকশার জন্য মহাসড়কের পরিবর্তে বিকল্প গ্রামীণ বা শহরের ভেতরের রাস্তা নির্ধারণ; শহরের কাছাকাছি এলাকায় ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লেন তৈরি; অটোরিকশা চালকদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের আওতায় আনা; ট্রাফিক আইন ও নিরাপত্তা এবং মানুষের জীবনের গুরুত্ব সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের কাউন্সেলিং করা, সাধারণ মানুষকেও বোঝাতে হবে যে মহাসড়কে অটোরিকশায় যাতায়াত করা কতটা বিপদজনক; একজন মানুষ নিজের জন্য এবং তার পরিবার ও আশেপাশের মানুষের জন্য বেঁচে থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝানো; মহাসড়কে অটোরিকশা চালালে যে দুর্ঘটনা হতে পারে এবং তা কতটা ভয়াবহ, তা চালকদের দেখিয়ে সচেতন করা; ব্যাটারি বা সিএনজি চালিত ছোট যানবাহনগুলোর জন্য অনুমোদন সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় আনা; স্থানীয় প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশ কিংবা বিশেষ টাস্কফোর্সের মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালানো এবং মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল রোধে ব্যবস্থা নেওয়া; স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাকে এই ব্যাপারে নজরদারি করার দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদি।