
ঝালকাঠি সংবাদদাতা:
বাটিতে সিরায় ভেজা গরম রসগোল্লা, টাটকা ছানার ননির ঘ্রাণ, তুলতুলে নরম আর ঘন দুধের স্বাদ—চামচে তুলে মুখে দিতেই যেন চোখ বন্ধ হয়ে আসে। একবার খেলে মন ভরে না, নিজের অজান্তেই হয়তো আট-দশটি খেয়ে ফেলা যায়। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার অরুনের দোকানের রসগোল্লার স্বাদ এমনই মোহনীয় যে, লোকে একে বলে নেশা ধরানো মিষ্টি। এক বসায় অনেকে আধা কেজিও খেয়ে ফেলেন।
রাজাপুর উপজেলার পুরাতন বাজারে অবস্থিত এই অরুন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বিশেষত্ব চোখে পড়ার মতো নয়, কিন্তু স্বাদে অনন্য। সামনের কাচের বাক্সে সাজানো রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, জিলাপি আর বাতাসা থাকলেও সবচেয়ে জনপ্রিয় রসগোল্লাই। চার দশকের বেশি সময় ধরে কাঁচাগোল্লা, রসগোল্লার স্বাদে শহরবাসীর মন জয় করে টিকে আছে এই দোকান। পুরোনো বেড়ার টিনশেডের দোকানে আটটি নড়বড়ে টেবিল, কিছু চেয়ার ও বেঞ্চ থাকলেও মোহনীয় রসগোল্লার ঘ্রাণ সব ছাপিয়ে মন কেড়ে নেয়। দোকানের সামনে সব সময় ভিড় লেগে থাকে।
গরুর খাঁটি দুধের ছানা দিয়ে তৈরি এই রসগোল্লার স্বাদ অতুলনীয় বলে জানান নিয়মিত ক্রেতারা। কেউ বলেন, এক কামড়ে মুখে দিলেই পুরো রসগোল্লা গলে যায়। সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অরুন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে মিষ্টি বিক্রি হয়। মিষ্টির পাশাপাশি সকাল ১০টা পর্যন্ত পাওয়া যায় পরোটা-ভাজি। দুপুর-বিকেলে সিঙ্গারা, পুরি, চটপটি ও খাঁটি গরুর দুধের চা পাওয়া যায়।
নিরঞ্জন রায়ের হাত ধরে এই দোকানের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর বড় ছেলে অরুন রায় ব্যবসার হাল ধরেন। বর্তমানে তাঁর সঙ্গে মেজ ভাই তপন রায়ও কাজ করছেন। চার ভাইয়ের মধ্যে সেজ ভাই মারা গেছেন চার বছর আগে। বর্তমানে অরুনের দোকানে সাতজন কর্মচারী কাজ করেন। প্রতিদিন গড়ে ২৫০-৩০০ কেজি দুধ ব্যবহার করা হয়। তবে পয়লা বৈশাখ, ঈদ, দুর্গাপূজার মতো উৎসবে প্রায় ৩০০-৪০০ কেজি দুধ লাগে।
এই দোকানের রসগোল্লার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে রাজাপুর ছাড়িয়ে ঝালকাঠি, এমনকি পাশের পিরোজপুর জেলাতেও। অনেকেই অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখেন। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে রসগোল্লা কিনতে আসেন। কেউ বোনের বাড়ি যাচ্ছেন, তাই উপহার হিসেবে কিনছেন, আবার কেউ পরিবারের আবদার মেটাতে আসছেন।
সকালবেলার নাস্তার জন্যও অরুন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার জনপ্রিয়। স্থানীয়রা ভোরের হাঁটাহাঁটি শেষে এখানে নাস্তা করতে আসেন। কারও পছন্দ রসগোল্লা, কেউবা ছানার জন্য আসেন। কেউ বাড়ির লোকজনের জন্য নিয়ে যান পরোটা আর ছানা।
কারখানায় দেখা গেল, গৌতম নামে এক কারিগর প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। তিনি বলেন, দুধ থেকে ছানা কেটে মিষ্টি তৈরি করা হয়, কোনো রং বা রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না। ৭ কেজি দুধ থেকে এক কেজি ছানা তৈরি হয়। রসগোল্লার প্রতিটি পিস ১০ টাকা, রসমালাই ২০ টাকা, টক দই ২০০ টাকা, মিষ্টি দই ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন প্রায় ৫-৬০০ কেজির বেশি রসগোল্লা বিক্রি হয়। বিশেষত বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার ভিড় আরও বেড়ে যায়।
দুধ, চিনিসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বাড়ায় ব্যবসা চালিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানান অরুন রায়। তবে তিনি বলেন, দুই পুরুষের এই অরুন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ঐতিহ্য শত বছর টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন তিনি দেখেন। বাকিটা ভগবানের ইচ্ছা।