Date: June 07, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / রাষ্ট্রের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় আধ্যাত্মিক শিক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ: ইসলামের মারেফত কী? - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে স...

রাষ্ট্রের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় আধ্যাত্মিক শিক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ: ইসলামের মারেফত কী?

June 06, 2025 04:56:47 PM   অনলাইন ডেস্ক
রাষ্ট্রের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় আধ্যাত্মিক শিক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ: ইসলামের মারেফত কী?

রিয়াদুল হাসান:
মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতো শুধুমাত্র দেহসর্বস্ব জীব নয়। তার দেহ যেমন আছে, তেমনি আত্মাও আছে। দেহের যেমন চাহিদা রয়েছে, তেমনি আত্মারও চাহিদা রয়েছে। দেহ ও আত্মা মিলেই একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তাই আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ রসুলের (সা.) মাধ্যমে যে জীবনব্যবস্থা পাঠিয়েছেন, তা শরিয়াহ (বিধিবিধান) ও মারফতের (আধ্যাত্মিকতা) নিখুঁত ভারসাম্যযুক্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানবরচিত যে কোনো জীবনব্যবস্থার সঙ্গে এর বড় পার্থক্য হল, এতে আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি প্রভৃতি জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মানুষের আধ্যাত্মিক সংকটের সমাধানও রয়েছে।

কালেমা তওহীদ ঘোষণার মাধ্যমে একজন মানুষ তার আত্মা, হৃদয় ও অন্তরে আল্লাহর উপস্থিতি এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের উপলব্ধি ধারণ করেন। তিনি আল্লাহকে একমাত্র জীবনবিধাতা ও ইলাহ হিসেবে সর্বান্তকরণে মেনে নেন। তিনি নিজের সমস্ত আনুগত্য ও ভক্তি একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করেন। পরবর্তীতে, যখন তিনি আল্লাহর বিধানগুলো একে একে মানতে শুরু করেন, তখন শরিয়াহ বাস্তবায়ন শুরু হয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) এই দুইয়ের (শরিয়াহ ও মারফত) সমন্বয়ে একটি বৈষম্যহীন ও শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর ফলে সাহাবিগণ আধ্যাত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি পবিত্র কোর’আনের বিধান মেনে জাগতিকভাবেও সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। তারা আরবের অশিক্ষিত ও বর্বর জাতি থেকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। সমাজ থেকে অন্যায়, অশান্তি ও অবিচার দূর হয়ে গিয়েছিল। মানুষের এতটা আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়েছিল যে, চুরি বা ব্যভিচারের মতো দণ্ডনীয় অপরাধ করার পর তারা অনুতপ্ত হয়ে নিজেরাই রাসুলের (সা.) দরবারে গিয়ে শাস্তি প্রার্থনা করতেন। অর্থাৎ লোকচক্ষুর অন্তরালেও তারা অপরাধ করা থেকে বিরত থাকতেন, কারণ তাদের অন্তরে সর্বদা আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ভয় জাগ্রত থাকত। ইসলামের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘তাকওয়া’।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, উম্মতে মোহাম্মদি যখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, তখন দীনের শরিয়াহ ও মারফতের মধ্যে ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে গেল। বর্তমানে আমরা দেখছি, একদিকে একদল মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে এসে শরিয়তের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন, কিন্তু জাতীয় জীবনে যে আল্লাহর হুকুম চলে না সেদিকে কোনো নজর নেই। অন্যদিকে, মারেফত বা সুফিবাদী ঘরানার একদল বিভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিক তরিকা অবলম্বন করছেন এবং আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের চেষ্টা করছেন। অথচ মানবসমাজ অন্যায়, অবিচার ও অশান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে এক জ্বলন্ত নরকে পরিণত হয়েছে, সেদিকে তাদের কোনো দৃষ্টি নেই। এটাই হল ভারসাম্যহীন সুফিবাদ যা পারস্য বিজয়ের পর সেখান থেকে অপরাপর মুসলিম ভূখণ্ডে বিস্তার লাভ করেছিল।

আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর উম্মাহর চরিত্রে শরিয়াহ ও মারফতের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুতরাং, প্রকৃত ইসলামে আধ্যাত্মিকতা বলতে বুঝায় অন্তরে, আত্মায় আল্লাহর উপস্থিতি এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহকে একমাত্র বিধানদাতা হিসেবে মানা। তিনি আমার সব কার্যাবলী দেখছেন এবং হাশরের দিন তাঁর সামনে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে - এ অনুভূতিকেই বলা হয় জিকির বা স্মরণ। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে আল্লাহর উপস্থিতিকে গণ্য করে নিজেকে যাবতীয় অন্যায় ও অপকর্ম থেকে দূরে রাখার পাশাপাশি, নিজের জীবন ও সম্পদের, পুত্র-পরিবারের মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর হুকুম-বিধান মানবজীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যাওয়া হচ্ছে ইসলামের মারেফত বা আধ্যাত্মিকতা।

কিন্তু একটি গোষ্ঠী মুসলিম জাতির জীবন থেকে সংগ্রামকে বাদ দেওয়ার জন্য অসংখ্য জাল হাদিস রচনা করেছে যেমন ‘আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদ হচ্ছে জেহাদে আকবর (বড় জেহাদ)’। হাফেজ ইবনে হাজারের মতো বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ এ সংক্রান্ত হাদিসগুলোকে হাদিস বলেই স্বীকার করেননি, বরং বলেছেন এটি একটি আরবি প্রবাদ বাক্য মাত্র। আর হাদিসটি যে সত্য নয় তার বড় প্রমাণ সুরা ফোরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: ‘কাফেরদের কথা শুনো না, মানো না এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর, চূড়ান্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।’ অর্থাৎ আল্লাহ নিজে বলেছেন, জেহাদে আকবর বা বড় জেহাদ হচ্ছে সত্য অস্বীকারকারী ও অন্যায়কারী কাফেরদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম করা।

আজ দুনিয়াময় মানবতার চরম বিপর্যয় ঘটেছে। আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেই শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষ মানুষ দুরাচারী জীবে পরিণত হচ্ছে। এ সময় প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা এবং শরিয়াহ- দুটোই জরুরি। এই দুইয়ের সমন্বয়ে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা তুলে ধরছে হেযবুত তওহীদ যা একদিকে মানুষকে করবে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন, আত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ, অকপট মো’মেন; অপরদিকে তাকে বানাবে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বত্যাগী, দুর্র্ধর্ষ, শাহাদাত-পিপাসু যোদ্ধা। ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে হাজার বছর আগে বাংলায় আগত শাহজালাল (রহ.), শাহ পরান (রহ.), শাহ মাখদুম (রহ.) প্রমুখ ব্যক্তিগণ যাঁদেরকে আমরা সুফি-সাধক, পীর-দরবেশ, ওলি-আউলিয়া এবং বুজুর্গ বলে জানি, তাঁরা আসলে আধ্যাত্মিক জগতেও যেমন কামেল ছিলেন, তেমনি রণজয়ী যোদ্ধা ছিলেন। এটাই দীনের ভারসাম্যের প্রকৃত উদাহরণ। পক্ষান্তরে যাঁরা সমাজের যাবতীয় সমস্যার প্রতি উদাসীন থেকে দরবার খানকার নির্জনতা বেছে নিয়েছেন তাঁরা কখনো আল্লাহর কুরবিয়াত হাসিল করতে পারবেন না।

[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৬২১৪৩৪২১৩, ০১৭১১২৩০৯৭৫]