
সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ের সহিংসতার ঘটনায় মোট ৩১টি মরদেহের সন্ধান পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের 'লং মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঘিরে সোমবার সকাল ১১টার পর থেকেই আগ্নেয়াস্ত্রসহ কঠোর অবস্থানে যায় পুলিশ। পরে দিনভর সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, মঙ্গলবার ঢাকার আশুলিয়া থানাধীন বাইপাইল এলাকায় নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের ওভারব্রিজে কাল সারারাত ধরে ঝুলছিল দুটি মরদেহ। মঙ্গলবার সকালে মরদেহ দুটি নামানো হয়। মরদেহ দুটি পুলিশ সদস্যদের হতে পারে বলে স্থানীয়দের ধারণা। এর বাইরে আশুলিয়া থানার সামনে একটি মরদেহ ও একটি পিকআপে তিনটি মরদেহ পড়েছিল। এই মরদেহ চারটি পুড়ে যাওয়ায় তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এখনো সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পড়ে আছে অজ্ঞাতনামা অনেক মরদেহ।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার ইউসুফ আলী জানান, গুলিবিদ্ধ ৬ জনের মরদেহ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এছাড়া আইসিইউতে ৭ জন মারা গেছে। এছাড়া ৩০০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে হাসপাতালে। পরিচয়হীন একজনের লাশ এখনো পড়ে আছে। থানা পুড়িয়ে দেওয়ায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বলে জানান ইউসুফ আলী।
আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হারুন অর রশীদ জানান, নিহত তিনজনের মধ্যে দুজনের মরদেহ স্বজনরা নিয়ে গেলেও, গতকাল দুপুর থেকে অজ্ঞাতনামা একজনের মরদেহ হাসপাতালে পড়ে আছে। অর্ধশতাধিক গুলিবিদ্ধকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ১০ জনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতালে আনা হয়েছিল। একজনের পরিচয় না মেলায় মরদেহটি এখনো হাসপাতালে পড়ে আছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটিতে ৭২ জন গুলিবিদ্ধ চিকিৎসা নিচ্ছেন। দুইদিনে অন্তত দেড় শতাধিক গুলিবিদ্ধকে চিকিৎসা দিয়েছে হাসপাতালটি। আশুলিয়ার হাবিব ক্লিনিকে দুই জনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ আনা হয়েছিল বলে জানিয়েছে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ।
সবমিলিয়ে মোট ৩১টি মরদেহের সন্ধান পাওয়া গেছে সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ের সহিংসতায়। এদিন সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায় মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের সাংবাদিক সৈয়দ হাসিবুন নবী ও আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় দেশ রুপান্তর পত্রিকার আশুলিয়া প্রতিনিধি খোকা মাহমুদ চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হন।
'লং মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঘিরে আশুলিয়ার বাইপাইল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া জনতার স্রোত লক্ষ্য করে চলে পুলিশ নির্বিচার গুলি করে বলে অভিযোগ গুলিবিদ্ধদের। নির্বিচার গুলিবর্ষণে সাভার এলাকার অলি-গলিতে রক্তাক্ত হয় ছাত্র-জনতা।
পরে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবরে চিত্র পাল্টে যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তারা। নিরাপত্তার সব দায়িত্ব ছেড়ে নিজেদের জীবন নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে পুলিশ সদস্যরা।
বিকেল ৩টার পর পুলিশ থানার দিকে পিছু হটতে থাকলে তাদের পেছনে ছুটতে থাকে জনতার স্রোত। এবার প্রাণ বাঁচাতে শুরু হয় ধামরাই, আশুলিয়া ও সাভারে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ।
এমন পরিস্থিতিতে উন্মুক্ত জনতার ক্রোধ উপড়ে পড়ে থানাগুলোতে। আশুলিয়া, ধামরাই ও সাভার মডেল থানায় দেওয়া হয় আগুন।
জীবন বাঁচাতে থানায় অবস্থানরত পুলিশরা যখন অসহায় হয়ে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হন।
একপর্যায়ে থানা ঘিরে ক্ষুব্ধ জনতা হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে হামলা চালানো শুরু করলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। তখন জনতার স্রোত লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুলিশ সদস্যরা সাভার থানা রোড হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে সাভার সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে এবং ছাত্র-জনতা তাদের পিছু নেয়।
সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই ৩টি থানা ও থানায় থাকা প্রতিটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। রাতভর লুট হয় থানার অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মূল্যবান সামগ্রী।
এদিকে শেখ হাসিনার পতনের পরপর গা ঢাকা দিয়েছেন সাভার-আশুলিয়ার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে গেছেন আত্মগোপনে।
সাভারে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের বাসভবন অফিস ও কার্যালয় ক্ষুব্ধ জনতা ভাঙচুর করেছে।
হেমায়েতপুরে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফকরুল আলম সমরের বাসা, ঋষিপাড়ায় সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের রাজ প্যালেস, ইমান্দিপুরে কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আবু আহমেদ নাসিম পাভেলের বাসা, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিকসহ সভাপতি নিজাম উদ্দিন আহমেদ টিপুর বাড়িতেও আগুন দেয় ক্ষুব্ধ জনতা।
এছাড়াও বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা পুড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। সাংবাদিকরা দেশের ক্রান্তিকালে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদপ্রচার না করার ক্ষোভে প্রেসক্লাব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন বিক্ষুব্ধ জনতা।
অপরদিকে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় সাভারে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। আজ সকালে সাভারের ব্যাংক কলোনির নিজ বাসভবনে নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা-সমাবেশ করেছে বিএনপির সাবেক এমপি ডা. সালাউদ্দিন বাবু। সাভারের জলেশ্বর এলাকার নিজ বাসভবনে নেতাকর্মীদের নিয়ে সমাবেশ করেছেন ঢাকা জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক খোরশেদ আলম।
জানতে চাইলে খোরশেদ আলম বলেন, 'সাভার আমাদের। সাভারকে রক্ষা করতেই আমরা সাভারে এসেছি। নেতাকর্মীদের সহিংসতা ঠেকাতে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।'