
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। আঙুলের এক ক্লিকেই সব কিছু জানা সম্ভব, কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্মার্টফোন, ট্যাব বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে তরুণ-যুবকরা থাই ও কালিয়ানসহ ক্যাসিনো নামে ভার্চুয়াল জুয়ায় জড়িয়ে নিজেদের ধ্বংসের পথে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অনলাইন জুয়া ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের তরুণ-যুবকদের মধ্যে থাই জুয়া, কালিয়ান ও বিভিন্ন লটারিভিত্তিক গেমের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। একদিকে যেমন তারা এতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তেমনি অপরদিকে মাদকাসক্তি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
জানা যায়, অনলাইন জুয়ায় আসক্ত অনেকেই মাদকসেবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, ফলে মাদকাসক্তির সংখ্যা বাড়ছে। এর সঙ্গে একটি প্রতারণার চক্রও জড়িত, যা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব চক্রে থাকা কিশোর-যুবকরা মাদক বেচাকেনা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, যা সমাজে এক নতুন ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
থাই জুয়ায় আসক্ত টনি (ছদ্মনাম) জানান, থাই ও কালিয়ান মূলত লটারিভিত্তিক অনলাইন জুয়া। এই জুয়া খেলার জন্য খেলোয়াড়রা বিভিন্ন প্রকার লটারির টিকেট তৈরি করে, যেগুলোর ওপর বাজি ধরে। যদি নম্বর মিলে যায়, তবে টাকা বিকাশ বা ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়। তবে অনেক সময়, নম্বর দেওয়ার আগে টাকা অগ্রিম নেয়া হয়, এরপর ফোন বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করা হয়।
অন্যান্য গ্রামাঞ্চলের স্থানীয় যুবকদেরও একই ধরনের অভিযোগ। তারা জানান, স্থানীয়ভাবে থাই জুয়া বা কালিয়ান লটারির আদলে টিকেট বানিয়ে থাইল্যান্ডের লটারির নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। এই ধরনের কার্যক্রমের ফলে গ্রামে কিশোর-যুবকদের মধ্যে জুয়া খেলার প্রবণতা বাড়ছে। অভিভাবকরা জানান, “পাড়ার ছেলেরা সারা দিন মোবাইল নিয়ে জটলা করে বসে থাকে, এবং পরে জানা যায়, তারা থাই জুয়া খেলছে। মহল্লার লোকেরা কিছু বলতে ভয় পায়, কারণ ওই তরুণরা সংগঠিত। যারা কিছু বললেই তারা তাকে হেনস্তা করতে ছাড়ে না।”
অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্লাটফর্ম ডিসমিসল্যাব সার্চ করে গত জুলাই থেকে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে ‘বিদেশফেরত পাত্রীর জন্য পাত্র চাই’ -এমন ৪৩০টি পোস্ট পেয়েছে। এদের মধ্যে ৩৯৭টি অর্থাৎ ৯২ শতাংশই জুয়া বা বিদেশী মুদ্রা লেনদেনের সাইটে নিয়ে যায়। পোস্টগুলো শেয়ারের পরিমাণও অবিশ্বাস্য। শুধু ফেসবুক নয়, ইউটিউবে কোনো ভিডিও দেখতে গেলেই হুট করে হাজির হচ্ছে জুয়ার বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশী সংবাদ পাঠিকা, ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যক্তিত্ব, পাকিস্তানি মডেল ও ইনফ্লুয়েঞ্জার, বাংলাদেশের খ্যাতনামা ক্রিকেটারসহ আরও অনেক সেলিব্রেটির ছবি ও এআই ভিডিও তৈরি করে জুয়ার প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। এইআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো ওইসব ভিডিওতে একজন খ্যাতনামা ক্রিকেটারকে বলতে শোনা যায়, তিনি বেটিং করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। নতুন জুয়াড়ি হিসেবে নাম লেখালেই ৪২ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাস দেওয়ার লোভনীয় প্রস্তাবও দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে ওয়েবসাইটগুলোতে জুয়ার বিজ্ঞাপন চলে আসছে। এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের ছবি ব্যবহার করেও প্রচারণা চলে জুয়ার।
গেমিং, স্পোর্টস ও গ্যাম্বলিং বিষয়ক ওয়েবসাইট পেটুডের মতে, অনলাইন ক্যাসিনোতে কোনো খেলোয়াড়কে নিয়ে আসতে পারলে অ্যাফিলিয়েট বা প্রচারকরা প্রতি খেলোয়াড়ের জন্য ৫০ থেকে ৪০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে যে খেলোয়াড়দের নিয়ে আসা হয়, সেসব খেলোয়াড়দের ব্যয় করা অর্থের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকেন এই অ্যাফিলিয়েটরা।
অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে এলাকাভিত্তিক সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজন বলে মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তা ফইম উদ্দিন। তার ভাষ্য, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, এবং গ্রামাঞ্চলে অনলাইন জুয়ার বিস্তার ঘটেছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি, তবে শুধু পুলিশি অভিযান দিয়ে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য এলাকাভিত্তিক সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজন।
অনলাইন জুয়ায় আসক্তি বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ও প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, জুয়া আসক্তদের ফেরাতে প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ। জুয়ার সাইটগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কঠোর অবস্থান নিতে হবে সরকারকে। পরিবারে থাকা কম্পিউটার-মোবাইল ফিল্টারিং করতে হবে। বাবা-মায়ের খেয়াল রাখতে হবে, সন্তান কী করছে। আর আসক্তদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন না করে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক জীবনে। অনলাইন জুয়ায় আসক্ত শিশুদের মনশ্চিকিৎসা নেওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের এই মানসিক অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে বাবা-ছুটছেন মনশ্চিকিৎসকদের কাছে, অনেকেই সুফলও পাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা।