
শামীমা আক্তার:
রসুলাল্লাহর (সা.) হাদিসে বর্ণিত দাজ্জাল, ইয়াজুজ-মাজুজ, মালহামাত, কেয়ামতের লক্ষণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার পূর্বে গত এক বছর ধরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধটি ক্রমশ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে গড়াচ্ছে কিনা তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে গুঞ্জন চলছে সেদিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হল। এ উপলক্ষে দুই দেশের দুই প্রেসিডেন্টের প্রদত্ত জ্বালাময়ী ভাষণে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু পায়নি বিশ্ব।
লেখক ব্রান্ডন জে উইচার্ট এশিয়া টাইমস-এ প্রকাশিত তার এ সংক্রান্ত লেখায় উল্লেখ করেন যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট যে ভাষণ দিয়েছেন, সেই ভাষণই এই সংঘাতকে বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। (তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখনই শুরু হয়ে গেছে!- দৈনিক প্রথম আলো, ০২ মার্চ ২০২৩)। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিষয়টির সঙ্গে মহানবীর বলা আখেরি যামানা সংক্রান্ত বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণীর সাযুজ্য পাওয়া যায়। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর অনবদ্য গবেষণাকর্ম ‘দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’! বইটি পাঠকের সামনে এ বিষয়ে চিন্তার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। তবে যে কোনো গবেষণা নিয়েই দ্বিমত থাকতেই পারে।
রসুলাল্লাহ (সা.) যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে আল্লাহর পক্ষ হতে মুক্তির পথ নিয়ে আগমন করেছিলেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সমগ্র আরব উপদ্বীপে ইসলাম (শান্তি) প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমগ্র বিশ্বে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি উম্মাহ গঠন করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর থেকে কেয়ামত পর্যন্ত কী কী বড় সংকট আসতে পারে সে সম্পর্কেও তিনি বহু সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন, যা বিভিন্ন হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি। এ সকল ভবিষ্যৎ সংকটের মধ্যে দাজ্জাল, ইয়াজুজ-মাজুজ, মালহামা, দাব্বাতুল আরদ ইত্যাদি অন্যতম। তিনি বলেছেন ঈসা (আ.) ও মাহদি (আ.) এর নেতৃত্বে এ সকল সংকটের সমাধান ঘটবে এবং দুনিয়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে। এ বিষয়গুলো বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থের ‘কিতাবুল ফিতান’ অধ্যায়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে। আমরা সংক্ষেপে সেগুলোর সঙ্গে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করব।
প্রথমেই দাজ্জাল। রসুলাল্লাহ বলেছেন যে আখেরি যামানায় বিরাট বাহনে চড়ে এক চক্ষুবিশিষ্ট মহাশক্তিধর দানব (দাজ্জাল) পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে পদদলিত করবে। মহানবী (সা.) দাজ্জালের আবির্ভাবকে আদম (আ.) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য সবচেয়ে গুরুতর ও সাংঘাতিক ঘটনা বলে চিহ্নিত করেছেন, এমনকি তিনি নিজেও এ মহাবিপদ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। রসুলাল্লাহ দাজ্জালের ভয়াবহতা বোঝাতে ‘আকবর’ (অতি বড়) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ নুহের (আ.) সময়ে মহাপ্লাবনে সমস্ত পৃথিবী ডুবে যাওয়া, দুটি বিশ্বযুদ্ধে কমপক্ষে ১৪ কোটি মানব হতাহত হওয়ার নৃশংসতাকেও ছাড়িয়ে যাবে দাজ্জালের আর্বিভাব। বর্তমান মুসলিম জাতি যদি রসুলাল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সম্পর্কে তাদের সংকীর্ণ ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসে এবং এগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে, তাহলে তারা দেখতে পাবে যে সমস্ত মানবজাতির মহাবিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে ইতোমধ্যেই মানবতার মহাশত্রু, ইবলিসের চূড়ান্ত রূপ দাজ্জাল পৃথিবীতে এসে গেছে এবং পুরো পৃথিবীকে তার করায়ত্ব করে নিয়েছে। কয়েকটি হাদিস সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেই ভবিষ্যদ্বাণীর একচক্ষু দানব দাজ্জাল যে বর্তমানের পাশ্চাত্য বস্তুবাদী যান্ত্রিক ‘সভ্যতা’-র রূপক বর্ণনা তা আশা করি পাঠকের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আল্লাহর রসুল বলেছেন, “দাজ্জাল জুম’আর সালাহ কায়েম করতে যে সময় লাগে সে সময়ের মধ্যেই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারবে।” আজকে ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ যান্ত্রিক প্রগতি অর্জনের মাধমে মহাকাশে যে উপগ্রহগুলো (Satellite) প্রেরণ করছে সেগুলো ১৮,০০০ (আঠারো হাজার) মাইল গতিতে মাত্র ৯০ থেকে ৯৫ মিনিটে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে। এই উপগ্রহগুলোর মধ্যে মানুষ মাসের পর মাস অবস্থান করছে। দাজ্জালের দ্রুতগতি সম্পর্কে রসুলাল্লাহ আরো বলেন, ‘দাজ্জাল বায়ুতাড়িত মেঘের মতো আকাশ দিয়ে উড়ে চলবে (নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে মুসলিম, তিরমিযি)। এটা যে আজকের পাশ্চাত্য যান্ত্রিক ‘সভ্যতা’র তৈরি এরোপ্লেনেরই রূপক বর্ণনা, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। রসুলাল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, দাজ্জাল পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে কী হচ্ছে শুনতে পাবে, কী হচ্ছে দেখতে পাবে। বর্তমানে স্যাটেলাইট থেকে গোটা পৃথিবীই দেখতে পাওয়া যায়, ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর সকল প্রান্তের খবর পাওয়া যায়, কথা বলা ও শোনাও যায়।
তিনি আরো বলেন, ‘দাজ্জালের আদেশে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হবে’। বর্তমান ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’র বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি আকাশে হালকা মেঘের ওপর এ্যারোপ্লেন দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ ছিটিয়ে বৃষ্টি নামাতে পারে। চীন, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইসরায়েল, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বুলগেরিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া, জার্মানি, স্লোভেনিয়া, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার মালি, নাইজার, মরক্কো, বুরকিনা ফাসো এবং সেনেগাল ইত্যাদি দেশে নানা সময়ে বৃষ্টি নামাতে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
তথ্যাভিজ্ঞ প্রতিটি লোকই জানেন যে পাশ্চাত্য জগতের বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষে গবাদি পশুর (Cattle) আকার অনেক বড় হয় এবং প্রাচ্যের পশুগুলোর চেয়ে চার-পাঁচগুণ বেশি দুধ দেয়; ঠিক যেমনটা রসুল (সা.) বলেছেন, দাজ্জালের গবাদি পশু আকারে বড় বড় হবে এবং তাদের প্রচুর পরিমাণে দুধ হবে (মুসলিম, তিরমিযি)। পশ্চিমা যান্ত্রিক ‘সভ্যতা’ তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির নিচ থেকে খনিজ সম্পদ উত্তোলন করছে এবং নিজেদের স্বার্থে সেগুলো ব্যবহার করছে। হাদিসেও এ কথাটি এসেছে যে দাজ্জালে আদেশে মাটির নিচের সম্পদ আদেশ উঠে আসবে এবং তার অনুসরণ করবে (মুসলিম, তিরমিযি)। এভাবে সহিহ হাদিসের বর্ণনাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে রসুলাল্লাহ যে ভয়াবহ দানবের আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন সেটা ইতোমধ্যেই এসে গেছে। মুসলিমসহ সমগ্র মানবজাতি তাকে ইতোমধ্যেই প্রভুর (রব) আসনে স্থান দিয়েছে, তার প্রতিটি আদেশ নিষেধ মেনে চলছে অর্থাৎ তাকে সেজদাহ করছে। আজকে সমগ্র বিশ্ব সেই পাশ্চাত্য সভ্যতার করতলগত। এ কথাও রসুলাল্লাহ বলে গেছেন যে, সমস্ত পৃথিবী চামড়া দিয়ে মোড়ানো একটি বস্তুর মত দাজ্জালের করায়ত্ব হবে। সত্যিই তাই। পৃথিবীর এক ইঞ্চি জমি নেই, এক ইঞ্চি পানি নেই যেখানে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার সার্বভৌমত্ব নেই।
একটি মালার সুতো যখন ছিঁড়ে যায় তখন সবগুলো পুঁতিই একটার পর একটা খসে পড়ে। আখেরি যামানার ফেতনাগুলোর আবির্ভাব বোঝাতে রসুলাল্লাহ এমন উপমা দিয়েছেন। দাজ্জালের আগমনের পরপর ইয়াজুজ মাজুজ, মাহদি (আ.) ও ঈসা (আ.) এর আবির্ভাব, মালহামা বা মহাযুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনাগুলোও একটার পর একটা ঘটতে থাকবে। নিকট অতীতের দু দুটি মহাযুদ্ধ ছাড়াও তারপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ছোটবড় যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু আমরা হাদিসে পাই যে মালহামার (Armagideon) ধ্বংসযজ্ঞ অতীতের সব ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাসকে ছাড়িয়ে যাবে। মালহামা পৃথিবীর সকল মানুষকে কয়েকবার হত্যা করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মহাযুদ্ধের নাম। বাস্তবে আমরা দেখছি মালহামা বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বহু সামরিক বিশেষজ্ঞ, রাশিয়া, ব্রিটেন ও ন্যাটোর দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এই যুদ্ধকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন প্রেসিডেন্ট পুতিনের এক সাবেক মুখপাত্র, সের্গেই মারকভ, যিনি এখন মস্কোর ইন্সটিটিউট অব পলিটিক্যাল স্টাডিজের একজন পরিচালক, বিবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। ইউক্রেনে এখন যে যুদ্ধ, সেটি তার ভাষায়, আসলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেটোর যুদ্ধ। তার মতে, ইউক্রেনের এই হাইব্রিড যুদ্ধ কার্যত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। (ইউক্রেন সংকটকে ঘিরে কি এক বছর আগে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই শুরু হয়েছে? --বিবিসি, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইতালির গণমাধ্যম লা রিপাবলিকাকে বলেছেন, রাশিয়াকে যদি চীন অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে, তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে (দৈনিক যুগান্তর ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)।
বিজ্ঞানীদের মতে যখন পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের হাতে থাকা পারমাণবিক বোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটাবে তখন কী নারকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। একটি মোটামুটি শক্তিশালী এটম বোমা বিস্ফোরণের সাথে সাথেই চারপাশে ৫০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে একটি অগ্নিগোলক তৈরি হবে এবং এর সামনে যা কিছু পড়বে, তার সবই বাষ্পীভূত হয়ে যাবে, ৩০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে যা কিছু পাবে সব আগুনে পুড়ে যাবে। আর বিস্ফোরণটি শোনা যাবে পুরো পৃথিবী জুড়ে! পারমাণবিক যুদ্ধের ফলে সারা পৃথিবীর আকাশ কালো ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়বে। সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারবে না। বোমার তেজস্ক্রিয়তায় বড় বড় শহরগুলো তাদের অধিবাসীসহ জনমানবশূন্য ধ্বংসপুরী হয়ে যাবে। জীবিত মানুষ যেন মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করবে। সুরা দুখানে আল্লাহ সমস্ত পৃথিবী ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার একটি ঘটনা বলেছেন। অনেকের ধারণা এটি মালহামার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, আপনি সেই দিনের অপেক্ষা করুন, যখন আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যাবে। যা মানুষকে ঘিরে ফেলবে। এটা এক যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা। আমাদের উপর থেকে শাস্তি প্রত্যাহার করুন, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করছি। (সুরা দুখান ১০-১২)।
রসুলাল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক, এই মালহামায় অংশ নেবে প্রচণ্ড শক্তিশালী দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী যাদেরকে বলা হয়েছে ইয়াজুজ মাজুজ (Gog-Magog)। দাজ্জাল সংক্রান্ত ভাষণে রসুলাল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা’আলা ঈসা (আ.) এর প্রতি এ মর্মে অহি নাযিল করবেন যে, আমি আমার এমন কিছু বিশেষ বান্দা আবির্ভূত করেছি, যাদের সাথে কারোই যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই। সুতরাং তুমি আমার বান্দাদের তূর পর্বতে সমবেত কর। তখন আল্লাহ ইয়াজুজ ও মাজুজ সম্প্রদায়কে প্রেরণ করবেন। তারা প্রতি উঁচু ভূমি হতে ছুটে আসবে। (নাওয়াস বিন সামান রা. থেকে মুসলিম)।
এদের বিশাল সেনাবাহিনী সমুদ্রের তরঙ্গের মতো প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে সমগ্র পৃথিবী চষে বেড়ানোর বিষয়ে কোর’আনেও বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, যে ইয়াজুজ ও মাজুজ (মানব জাতিকে ধ্বংস করার জন্য) প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে (সুরা আম্বিয়া ৯৬)। বিশিষ্ট ইসলামি ইসলামিক পণ্ডিত, লেখক এবং দার্শনিক ইমরান নজর হোসাইন তার ‘জেরুজালেম ইন দ্যা কোর’আন’ বইতে বলেন, উচ্চভূমি বলতে উন্নত দেশগুলোকে বোঝানো হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, ইয়াজুজ মাজুজ প্রকাশিত হলে মূলত ব্যাপক খাদ্যে সংকট সৃষ্টি হবে, কারণ তারা সমস্ত পৃথিবীর সম্পদ শোষণ করে ফেলবে। আমরা রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চিন, উত্তর কোরিয়া, ব্রিটেন ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলোর অকল্পনীয় সামরিক শক্তির কতটুকু জানি? আমরা কি জানি সামরিক খাতে তারা জাতীয় বাজেটের কত শতাংশ অর্থ ব্যয় করে থাকে আর সেটা বাংলাদেশের বাজেটের কতগুণ? ২০২৪ অর্থবছরের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন তাতে দেশটির বার্ষিক সামরিক ব্যয় ৮৪২ বিলিয়ন ডলার ধার্য করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ৭৪ বিলিয়ন। অর্থাৎ আমাদের জাতীয় বাজেটের এগারো গুণ বেশি অর্থ তারা ব্যয় করবে কেবল সামরিক খাতে। তাদের এই বিপুল যুদ্ধব্যয় কার্যত আমাদের মত দরিদ্র দেশের মানুষদেরকে বহন করতে হচ্ছে। আজ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং আমরাও তার ভুক্তভোগী। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে যা রসুলাল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
রসুলাল্লাহর করা ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে আলেম-ওলামাদের মধ্যে মতভেদ থাকতে পারে। তবে আমাদের সামনে মূর্তিমান বাস্তবতা হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে বাহন হিসাবে ব্যবহার করে বস্তুবাদী দাজ্জালীয় জীবনদর্শন বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে এবং দেশে দেশে সৃষ্টি করেছে মানববিধ্বংসী বিশাল বিশাল সেনাবাহিনী। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রয়ের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। বাইবেলে বর্ণিত গগ-মেগগ (Gog-Magog) শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে আগুনের তেজ। ইয়াজুজ মাজুজ দুটি শব্দও মূলত সমার্থক, যার বাংলা অর্থ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উত্তাপ। উদাহরণ দিয়ে বললে দাজ্জালীয় সভ্যতার ভোগবাদী আদর্শ Software হলে, এর বাহনরূপী Hardware হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর পরাশক্তিগুলো। বর্তমান বিশ্বে পারস্পরিক বিবাদমান পরাশক্তিধর দুটি পক্ষ তথা গণতান্ত্রিক ব্লক ও রাশিয়া কেন্দ্র্রিক সমাজতান্ত্রিক ব্লকও বস্তুবাদী দাজ্জালীয় আদর্শের অনুসারী এবং উভয়ের হাতে থাকা পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা দিয়ে পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা যাবে। এরা উন্নত দেশ থেকে ধেয়ে এসে অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সম্পদ শোষণ করে নিচ্ছে।
রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, মালহামার যুদ্ধের পর মানুষের লাশে ভূমি ছেয়ে যাবে। বায়ু দূষিত হয়ে যাবে। দাউ দাউ আগুনে পুড়বে নগর-বন্দর-জনপদ। জমিনে আধহাত জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে মানুষের লাশ ও দুর্গন্ধ নেই। মানুষকে এমনই একটি ভয়াবহ মুহূর্তের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে আজকের পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতা, দাজ্জাল। এজন্যই দাজ্জালের ভয়াবহতা অতীতের সমস্ত সংকটকে ছাড়িয়ে যাবে বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
হাদিসে বলা আছে এই মহা সংকটের মুহূর্তে পৃথিবীতে একদল মো’মেন থাকবে। ইমাম মাহদি (আ.) তাদেরকে সংগঠিত করবেন। আর ঈসা (আ.) তাদেরকে নিয়ে এই সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিরাপদ কোনো স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিবেন। এই বিরাট ঘটনাপ্রবাহের সমাপ্তি হবে ঈসা (আ.) এর মাধ্যমে পাশ্চাত্য সভ্যতা তথা দাজ্জালের চূড়ান্ত পতন ও এবং সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর আল্লাহ প্রদত্ত জীবন-ব্যবস্থা তিনি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যার ফলে শান্তি, ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা হবে। রসুলাল্লাহ বলেন, ইতোপূর্বে যে রকম অভাব হয়েছিল, সে রকম প্রাচুর্য্য হবে, যে রকম খুনাখুনি-রক্তপাত হয়েছিল, ঠিক সে রকম ঐক্য হবে, যে ধরনের শত্রুতা হয়েছিল, ঠিক বিপরীত ভ্রাতৃত্ব হবে।
কিন্তু এখন আমাদের এখন করণীয় কী? আমরা কী কেবল ধ্বংসের প্রহর গুনব আর বসে বসে মাহদি (আ.) ও ঈসা (আ.) এর জন্য অপেক্ষা করব? না, আমাদেরকে মো’মেন হতে হবে। আমাদেরকে উম্মতে মোহাম্মদী হিসাবে যে দায়িত্ব রসুলাল্লাহ আমাদের উপর অর্পণ করে গেছেন সেই দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। মো’মেন না হলে আমরা তো দাজ্জালকেও চিনতে পারব না। কারণ রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, দাজ্জালের কপালে কাফের লেখা থাকবে। কেবল মো’মেনরা নিরক্ষর হলেও সেই লেখা পড়তে পারবে। আমরা মো’মেন না হলে আমাদের মাঝে মাহদি (আ.) বা ঈসা (আ.) এলেও তাঁদেরকে চিনে নিতে পারব না, আর তাদের অনুসরণও করতে পারব না। আল্লাহর রসুলকে কি তাঁর নিজ পরিবারের কাফেররা চিনতে পেরেছিল? পারেনি। আবু জাহেলরা জাহেল অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেছিল। তাই আমাদের আশু কর্তব্য হলো আল্লাহর দেওয়া সংজ্ঞা মোতাবেক মো’মেন হওয়া। সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে আমরা সেই সংজ্ঞাটি পাই। আল্লাহ বলেন, “মো’মেন শুধু তারাই যারা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি ঈমান আনে, অতঃপর কোনো সন্দেহ পোষণ করে না এবং নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম, জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।” এখানে আল্লাহ রসুলের (সা.) প্রতি ঈমান বলতে কেবল তাদেরকে বিশ্বাস করা বোঝানো হয় নাই, বরং সার্বিক জীবনে তাঁদের হুকুম-বিধান মেনে নেওয়াকে বোঝানো হয়েছে। হুকুম না মানলে বিশ্বাসের কী মূল্য?
[লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; যোগাযোগ: ০১৭১১-০০৫০২৫, ০১৭১১-৫৭১৫৮১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]