Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / আসাদের সাম্রাজ্যে বসন্ত: সংঘাতের শেষ নাকি নতুন করে শুরু? - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

আসাদের সাম্রাজ্যে বসন্ত: সংঘাতের শেষ নাকি নতুন করে শুরু?

December 09, 2024 12:38:09 PM   শাহাদৎ হোসেন
আসাদের সাম্রাজ্যে বসন্ত: সংঘাতের শেষ নাকি নতুন করে শুরু?

সিরিয়ার 'স্বৈরশাসক' প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং সিরিয়া এখন মুক্ত বলে ঘোষণা করেছে দেশটির বিদ্রোহীরা। আলেপ্পো, হামার পর ক্ষীপ্র গতিতে রাজধানী দামেস্ক দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহীরা। দখলের পরপরই দেশটির সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সামরিক বাহিনীকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএসের প্রধান আবু মোহাম্মেদ আল-জোলানি।

গন্তব্যের উদ্দেশ্যে দামেস্ক ত্যাগ করেছেন। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) জানিয়েছে, একটি ব্যক্তিগত বিমানকে দামেস্ক বিমান বন্দর থেকে উড়ে যেতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিমানটিতে প্রেসিডেন্ট আসাদ ছিলেন। গুজব উঠেছিল বিমানটি ভূপাতিত হয়ে আসাদ মারা গেছেন। তার গন্তব্য নিয়ে এই ধোঁয়াশার মধ্যেই এ বিষয়ে নতুন তথ্য দিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাশার আল-আসাদ এখন সিরিয়ায় নেই। তিনি সিরিয়া থেকে বের হয়ে গেছেন। তবে তাদের এই দাবি কতটা সত্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমনকি বাশার রাশিয়ার দিকে গেছেন কি না, তা-ও স্পষ্ট করেরি রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ইরান, রাশিয়া অথবা আরব আমিরাতে অবতরণ করতে পারেন তিনি।

সিরিয়ার পরিস্থিতি গত এক দশক ধরেই ছিল একাধারে ভয়াবহ, সংকটপূর্ণ ও অস্থির। ২০১১ সালে আরব বসন্তের প্রভাবে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভগুলি এক পর্যায়ে গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। এরপর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া হয়ে ওঠে এক বৃহৎ রণক্ষেত্র, যেখানে নানা আন্তর্জাতিক শক্তি নিজেদের স্বার্থের জন্য একে অপরকে সমর্থন ও বিরোধিতা করে আসছিল। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ৫ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে, ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ। তবে ২০২০ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় সংঘটিত যুদ্ধবিরতি পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল করতে সক্ষম হয়। এরপর দীর্ঘ ৪ বছর পর গত নভেম্বরের শেষের দিকে বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলোর হঠাৎ আক্রমণে সাঙ্গ হয় ৫৪ বছরের আসাদ পরিবারের রাজত্ব।

ইরান দীর্ঘদিন ধরে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে বাশার আল-আসাদ ও তাঁর পরিবারকে ভূরাজনৈতিক ও মতাদর্শিক কারণে সমর্থন দিয়ে আসছে। তবে হঠাৎ করেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। একদিকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত, অন্যদিকে ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা সামাল দেওয়া ও হিজবুল্লাহকে সমর্থন দিতে গিয়ে জটিলতায় পড়েছে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা হঠাৎ করে তীব্র আক্রমণ চালিয়েছে। বিদ্রোহীদের এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণে বাশার আল-আসাদ দেখতে পান, তাঁর মিত্ররা কার্যত মাঠ থেকে সরে গেছে। রাশিয়া ও ইরানের অনুপস্থিতিতে বিদ্রোহীরা ক্ষীপ্র গতিতে আলেপ্পো, হামা শহর দখল করে রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করে। বাধ্য হয়ে বাশার ব্যক্তিগত বিমানে চেপে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান। তবে তিনি কোথায় গেছেন, তা এখনো অজানা। তবে ধারণা করা হচ্ছে রাশিয়া, ইরান অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঢুকবেন তিনি।

বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে থাকা হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এর নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি ঘোষণা দিয়েছেন, সিরিয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি আল-জালালির তত্ত্বাবধানে। বিদ্রোহীরা প্রতিশোধ না নিয়ে সংযম প্রদর্শনের অঙ্গীকার করেছে। বিদ্রোহীরা বলছে, তারা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা গঠন করবে এবং দেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে ফিরে আসার সুযোগ দেবে।

এইচটিএস নেতা জোলানি যখন আল কায়দার প্রতিনিধিত্ব করতেন তখন আল জাজিরার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সিরিয়া দখলের পর সেখানে শিয়া, কুর্দি, খ্রিস্টানসহ কোনো সংখ্যালঘুদের স্থান হবে না। কিন্তু পরর্বতীতে এইচটিএস গঠনের পর তার লেবাসের সাথে মানসিকতারও চেঞ্জ লক্ষ করা যায়। জোলানি বলেন, আগের অবস্থান থেকে সে সরে এসেছে। সে শুধু শুধু মানুষ হত্যার দায় নিতে নারাজ। সিরিয়া দখলের পর সেখানে ইসলামী শাষণ কায়েম করা হবে যেখানে সংখ্যালঘুরা তাদের অধিকার পাবে।

সিরিয়ার পরিস্থিতি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভূত্থান এবং শেখ হাসিনার বাংলাদেশ থেকে পলায়নের সাথে কিছুটা মিল রয়েছে। জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যান হাসিনা। এই ঘটনা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে পারে, যারা বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাদের আন্দোলনকে আরও তীব্র ও সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা হয়তো ‘স্বৈরাচারী’ আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তবে, সিরিয়ায় অভ্যুত্থান ছিল উভয়পক্ষের মধ্যে সহিংসতা, যেখানে সরকার এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী উভয়েই প্রাণঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়েছিল, আর বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে সহিংসতা মূলত সরকারের পক্ষ থেকে ছিল। বাংলাদেশে আন্দোলনকারীরা প্রধানত শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দাবিগুলি উত্থাপন করলেও, সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর দমন-পীড়ন এবং সহিংসতা ছিল প্রকট।

সিরিয়া ২০১৮ সাল থেকে কার্যতঃ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে, যেখানে বাশার আল-আসাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন, কুর্দি বাহিনী এবং ইসলামি বিদ্রোহীরা বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। সিরিয়ায় সম্প্রতি হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে সুন্নী ইসলামপন্থী বিদ্রোহী সশস্ত্রগোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। এ সংগঠনটির সিরিয়ার ইতিহাস ও সংকটে জড়িত থাকার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কসহ অনেক দেশে এইচটিএস সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইসরায়েল ও তাদের মিত্ররা এর সমর্থক। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার সময় এ গোষ্ঠীটির নাম ছিলো জাবাত আল নুসরা, যা ছিলো সরাসরি আল-কায়েদা জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সংযুক্ত। এর গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কথিত আইএস গ্রুপের নেতা আবু বকর আল বাগদাদী। এই গোষ্ঠীটিই প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ও প্রাণঘাতী ছিলো বলে অনেকে মনে করেন। তবে, এটি বিপ্লবের চেয়ে জিহাদি আদর্শকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে করা হয়। ফ্রি সিরিয়া নামে বিদ্রোহীদের যে জোট হয়েছিলো সেখানে তাদের মধ্যে ভিন্নতা দেখা দিয়েছিলো। অপরদিকে বাশার আল আসাদের সমর্থক হচ্ছে শিয়াপন্থী হিজবুল্লাহ, ইরান, রাশিয়া ও এদের মিত্ররা।

বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের প্রাক্কালে বাশার আল আসাদ পালিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন নাকি দেশের অভ্যন্তরে রয়েছেন তা এখনও জানা যায় নি। তবে বিদ্রোহীদের আক্রমণে আপাতদৃষ্টিতে আসাদ পালিয়ে গেলেও সংঘাত বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। কেননা সরকারি বাহিনী দেশটির কেন্দ্রীয় ও উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরে জানা যাচ্ছে। ফলে যৌথ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর আকস্মিক আক্রমণ এ সিরীয় সংঘাতকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। উত্তরের বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর নতুন আক্রমণ এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশটিতে সামনে ভয়াবহ সংঘাত শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে সিরিয়ার ক্ষমতার পট পরিবর্তন শুধু সিরিয়ার জনগণের জন্যই নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্ব রাজনীতির জন্য এক বড় সংকট হিসেবে দেখা দিবে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো, যারা মূলত আল-কায়েদা এবং আইসিসের সমর্থনপুষ্ট, সিরিয়ার ক্ষমতায় চলে আসার ফলে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হতে পারে। এই পরিবর্তনের ফলস্বরূপ সিরিয়ার ভবিষ্যত রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলো আরও কঠিন হতে চলেছে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ২০১১ সালে শুরু হয় যখন সরকারবিরোধী বিক্ষোভগুলি প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পদত্যাগের দাবিতে শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং বিভিন্ন শহরকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ (ঋঝঅ) হিসেবে সংগঠিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এরপর থেকে দেশটি এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পতিত হয়, যে যুদ্ধে পাঁচ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আরব বসন্তের প্রভাবে সিরিয়ার বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নামেন, তারপর থেকে দেশে শুরু হয় এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। এদিকে, বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় রেখে রাশিয়া এবং ইরান তার সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরায়েল, তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং আরব লিগের দেশগুলি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছিল। এসব শক্তির সমর্থন নিয়ে সিরিয়ার এই গৃহযুদ্ধ এক বৈশ্বিক মহাযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। একদিকে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার শাসক দলকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে, আর অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর দমন-পীড়ন চলে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এসে সিরিয়ার পরিস্থিতি একেবারে নতুন এক মোড় নিলো। বিদ্রোহী গোষ্ঠী দামেস্ক দখল করে এবং আসাদ সরকারকে উৎখাত করে। বাশার আল আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে বিদ্রোহীদের শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। তবে বিদ্রোহী গোষ্ঠী জয়ী হওয়ার পর তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে এবং ইতোমধ্যে তারা বিজয়ের উল্লাসও করছে। তবে এই বিদ্রোহী এইচটিএস গোষ্ঠীর সরকার সিরিয়ার সাধারণ জনগণের জন্য নতুন সংকট সৃষ্টি করবে নাকি বহুল কাক্সিক্ষত শান্তি ফিরিয়ে আনবে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এই পরিস্থিতি কেবল সিরিয়া নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিসরে গভীর উদ্বেগের কারণ হতে পারে। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পতন, আসাদের পলায়ন এবং বিদ্রোহীদের উত্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক বিপজ্জনক দিক পরিবর্তনের লক্ষণ হতে পারে। সিরিয়া একসময় মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল, আজ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। সিরিয়ার এখনকার পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি অস্থির এবং বিভক্তের দিকে যাবে। সিরিয়া যদি শীঘ্রই একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তবে এটি শুধু সিরিয়ার জন্য নয় পুরো মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিবিসির একটি রিপোর্টে সিরিয়ার সংঘাত বন্ধ না হওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশি স্বার্থ, অর্থনৈতিক ধস ও মানবিক সংকট, কর্তৃত্ববাদী শাসন, বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থা তথা শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও ব্যর্থ আন্তর্জাতিক কূটনীতি। সিরিয়া এখন এক বৈশ্বিক দাবা বোর্ডে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য মিত্রদের সাহায্য করার ভান ধরে আসছে। তুরস্ক, সৌদি আরব এবং মার্কিন সমর্থিত বিকেন্দ্রীভূত সশস্ত্র বিরোধী দলগুলো আসাদকে চ্যালেঞ্জ করছে। তবে ইরান ও রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সমর্থনের কারণে আসাদের শাসন এখনও টিকে আছে। সংঘাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং আল-কায়েদার মতো চরমপন্থী জিহাদি সংগঠনগুলোর যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশের ফলে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। এদিকে মার্কিন সমর্থিত সিরিয়ার কুর্দিরা স্ব-শাসন চাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। আসাদের ক্ষমতা রক্ষায় রাশিয়া ও ইরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, অন্যদিকে উত্তরে নিজস্ব সীমানা রক্ষা করতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে আসছে তুরস্ক। ২০২০ সালে রাশিয়া এবং তুরস্ক ইদলিবে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে। এর মাধ্যমে নিরাপত্তা করিডোর স্থাপন করে যৌথ টহল দেয়া শুরু হয়, তারপরও কিছু লড়াই অব্যাহত ছিল। এতে করে বড় আকারের সংঘর্ষ কমে এলেও সিরিয়ার সরকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়নি। এখন বিদ্রোহীরা দুর্বল হয়ে পড়া সরকারের সুযোগ নিচ্ছে, কারণ আসাদ সরকারের প্রধান মিত্ররা অন্য সংঘাতে ব্যস্ত।

অপরদিকে বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধ সিরিয়াকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একইসাথে দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু, অবকাঠামোকে ধ্বংস এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে চরম দুর্দশায় ফেলেছে। এটি এমন একটি মানবিক সংকট তৈরি করেছে যেখান থেকে পুনরুদ্ধারের কোনো সুস্পষ্ট পথ নেই। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সিরিয়ায় যুদ্ধের আগের দুই কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া ৬৮ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ লাখেরও বেশি লোক সীমিত সুবিধা নিয়ে ভিড়ে উপচে পড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। এর বাইরে আরও প্রায় ৬০ লাখ মানুষ দেশটি ছেড়ে পালিয়েছে, যার বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছে লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্কে। এসব দেশে সবমিলিয়ে ৫৩ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী রয়েছে। তাছাড়া তেলক্ষেত্র এবং মূল বাণিজ্য রুটগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনৈতিক স্বার্থগুলোও এই উত্তেজনা জিইয়ে রেখেছে, যা মানবিক সংকটের সাথে মিলে দেশটিতে অসন্তোষ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়াতে পারে।

আসাদকে আপাতত অদৃশ মনে হলেও তার অনুসারীরা চাইবে কর্তৃত্ব পুনঃরুদ্ধার করতে। এতে করে সংঘাত আগামীতে আরও বাড়তে পারে। গত একদশক ধরে ক্ষমতা ধরে রাখতে আসাদ সরকার সহিংসতা ও দমনপীড়নের উপর নির্ভর করেছে। এটি অসন্তোষ উসকে দিয়েছে এবং সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করছে। ২০২১ সালের জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে সিরিয়ান সরকার কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন নৃশংসতা নথিভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রাসায়নিক হামলা, জনবহুল এলাকায় বিমান হামলা, বেসামরিক মানুষদের ক্ষুধার্ত রাখতে দেয়া অবরোধ এবং মানবিক সাহায্যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ।

সিরিয়ার বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে। বিশেষ করে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে পারে। কুর্দি, বিদ্রোহী এবং সরকারপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলতে থাকবে। সাম্প্রদায়িক প্রবাহ এবং আইএস-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সক্রিয়তা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে। পূর্বদিকে কুর্দি-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো যুদ্ধের প্রথম বছর থেকেই সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। এদিকে সিরিয়ার বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে আইএস-এর টিকে থাকা একটি অংশ নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে ট্রাফল নামের মাশরুম সংগ্রহের মৌসুমে স্থানীয়রা যখন লাভজনক খাবারের সন্ধান করে। যুদ্ধের সময় ঠেলে দেয়া উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ইদলিব সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জন্যে একটি শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। আর কার্যত প্রদেশটির শাসক হিসেবে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এই বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। তুরস্ক সমর্থিত বাহিনীসহ কিছু গোষ্ঠী কুর্দি যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। তুরস্ক এসডিএফের মূল গোষ্ঠী পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটসকে (ওয়াইপিজি) একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।
সিরিয়ার যুদ্ধে মূল অংশীদারদের পরস্পরবিরোধী এজেন্ডা থাকার কারণে জাতিসংঘের নেতৃত্বে আলোচনাসহ শান্তি আলোচনার প্রচেষ্টা ইতোপূর্বে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধান দলগুলো প্রায়ই সমঝোতার চেয়ে তাদের কৌশলগত লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, ফলে টেকসই সমাধানের সুযোগ খুব কম। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে মতবিরোধ টেকসই সমাধানকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সময় এসেছে এই সংকটের মোকাবিলা করার এবং সিরিয়ার জনগণের জন্য শান্তির পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করার। তবে, সিরিয়ার ভবিষ্যত এতটাই অনিশ্চিত যে, কেবল সময়ই বলবে- দেশটি শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে এগোবে, না কি আরো বড় সংকটে নিমজ্জিত হবে।

লেখক: সাংবাদিক।