
আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) তখন মাতৃগর্ভে। পিতা আব্দুল্লাহ মারা গিয়েছেন। মা আমিনা গর্ভের সন্তানকে আকড়ে বেঁচে আছেন। দাদা আব্দুল মোত্তালিব ছিলেন কাবা ঘরের মুতওয়াল্লি। চাচা আবু তালেব তখন টগবগে যুবক।
কোরায়েশদের এই পরিবারটি ছিল মিল্লাতে ইব্রাহিমের অনুসারী। পবিত্র কাবা আর জমজম কূপের দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল তাদের হাতে। ফলে কোরায়েশ তো বটেই, গোটা আরবেই তারা সম্মানিত ছিলেন।
কাবার অবস্থান মক্কায় হওয়ার কারণে সেখানে এই সর্বজন সম্মানিত গৃহকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে চমৎকার একটি নগরী। কোরায়েশ ছাড়াও শত শত পরিবার সেখানে বসবাস করতো, আর হজ্ব ও বিভিন্ন মেলা উপলক্ষে হাজার হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করতো। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক।
হঠাৎ একদিন হৈ-চৈ শোনা যায়। কি এক সংবাদে মক্কার মানুষেরা পাগলের মতো ছুটতে শুরু করে। ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল ফেলে পালাতে থাকে। বাচ্চারা আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। দোকানীরা দোকান বন্ধ করে ছুটে পালায়। ভীত-বিহ্বল মানুষের চিৎকার, চেচামেচি আর ক্রন্দনে মক্কায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের পায়ে চাপা পড়ে মানুষ মারা যাওয়ার অবস্থা!
এক ব্যক্তি ছুটে এসে রসুলের চাচা আবু তালেবকে জানায়, ইয়েমেনের অত্যাচারী শাসক আব্রাহা মক্কার নিকটে তাঁবু ফেলেছে। তার সেনারা আব্দুল মোত্তালিবের সমস্ত উট ছিনিয়ে নিয়েছে। আর কয়েকজন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে। সে এই নগরী আক্রমণ করে কাবা ঘর ধ্বংস করে দিতে এসেছে। এই সংবাদ শুনে আবু তালিব আঁতকে উঠেন। তিনি সাথে সাথে ছুটে যান পিতা আব্দুল মোত্তালিবের কাছে।
আব্দুল মোত্তালিব তখন কাবা ঘরের ভেতরে অবস্থান করছিলেন। বাদশা আব্রাহার তৎপরতার ব্যাপারে তিনি অবগত ছিলেন। তথাপি তার মুখে উদ্বেগের কোনো ছাপ দেখতে পেলেন না আবু তালিব। নিজের পিতাকে নিরুদ্বেগ দেখে খানিকটা ক্ষোভের সাথেই আবু তালিব বললেন, ‘আপনি কেন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না? তারা আমাদের সবগুলো উট ছিনিয়ে নিয়েছে, আর লোকদেরকে বন্দি করে নির্যাতন করছে। আমাদের সেই শক্তি নেই, যে আমরা এই বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব।’
আব্দুল মুত্তালিব বলেন, ‘এত উদ্বিগ্ন হয়ো না। মানুষকে অভয় দাও, আর আমিনার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করো।’
অতঃপর প্রাথমিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পুত্রকে নিয়ে আব্দুল মুত্তালিব নগরীর বাইরে যান, যেখানে ঘাঁটি গেড়েছিল আব্রাহার বাহিনী।
পিতা-পুত্র যখন ঘাঁটির নিকটে পৌঁছেন, তখন মক্কার সর্বোচ্চ নেতাকে গ্রহণ করতে ন্যূনতম ভদ্রতাও দেখায় না আব্রাহার সেনারা। তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। আব্দুল মুত্তালিবের কাছে আব্রাহা জানতে চায়, ‘আমাকে বলো, কী এই কাবার রহস্য? কেন অগণিত মানুষ এখানে ছুটে আসে আর তোমরা তাদের সাথে ব্যবসা করে লাভবান হও? আমি ইয়েমেনে প্রাসাদতুল্য এক গির্জা গড়ে তুলেছি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য। কিন্তু তারা সেখানে না যেয়ে কেন কাবায় ছুটে আসে?’
আব্দুল মুত্তালিব বলেন, আমি জানি না কি এই গৃহের মাহাত্ম। আমি কেবল জানি, এটা পাথরে নির্মিত একটি ঘর মাত্র।
আব্রাহা বলে, আমি পাথরের এই গৃহ ভেঙে ফেলতে এসেছি। তবে তোমরা যদি এই কাজে বাধা না দাও তাহলে তোমাদের কোনো ক্ষতি আমি হতে দেব না।
আব্দুল মুত্তালিব বলেন, আমি এই গৃহের ব্যাপারে চিন্তিত নই। বরং আমি আমার সেই সব উটের ব্যাপারে চিন্তিত, যা তোমার লোকেরা ছিনিয়ে এনেছে। তাছাড়া আমি নিরীহ নগরবাসীর ব্যাপারেও চিন্তিত, যাদেরকে তোমার লোকেরা ধরে এনে নির্যাতন করছে। তুমি তাদেরকে ছেড়ে দাও, আর আমার সম্পদ আমাকে ফিরিয়ে দাও।
আব্দুল মুত্তালিবের এমন কথা শুনে চটে যায় আব্রাহা। সে চিৎকার করে বলে, তুমি কাবার তত্ত্বাবধায়ক। এর নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল তোমার উপর। কিন্তু সে ব্যাপারে তুমি এতটুকু বিচলিত নও! অথচ নিজের উটের ব্যাপারে তুমি কতই না উদ্বিগ্ন! মক্কার মানুষের দুর্ভাগ্য যে, তারা তোমার মতো স্বার্থপর ব্যক্তিকে তাদের নেতা বানিয়েছে।
আব্দুল মুত্তালিব দৃঢ়তার সাথে উত্তর দেন, তোমার লোকেরা যা ছিনিয়ে এনেছে, আমি আব্দুল মুত্তালিব তার মালিক। তাই আমি সেগুলোর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। কিন্তু যে কাবায় তুমি আক্রমণ করতে যাচ্ছ, তার মালিক আমি নই। যাঁর ঘর তিনিই তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তা করবেন।
আব্রাহা জানতে চায়, কে সেই মালিক?
আব্দুল মুত্তালিব বলেন, তুমি যখন সেখানে যাবে, তখনই এর জবাব পাবে।
আব্দুল মুত্তালিবের এই উত্তরে আব্রাহা আরো চটে যায়। সে বলে, নিয়ে যাও তোমার উট আর বন্দি মানুষদেরকে। তবে জেনে রাখ, আগামীকাল যখন আমার হস্তিবাহিনী তোমার নগরীকে পিষে ফেলতে যাবে, তখন তারা এতটুকুও করুণা দেখাবে না।
পরের দিনের ঘটনা। মক্কার উপত্যকায় ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে আসছিল আব্রাহার বাহিনী। তাদের সম্মুখে ছিল অতিকায় হস্তির পাল। দ্বিতীয় সারিতে অশ্বারোহী বাহিনী। আর পেছনে অগণিত যোদ্ধা। সবার সম্মুখে, অতিকায় এক হাতির পিঠে চড়ে রাজকীয় আসনে আসীন ছিল বাদশা আব্রাহা। আর তাকে ঘিরে রেখেছিল দীর্ঘদেহী রক্ষীরা। দাম্ভিক আব্রাহার হস্তিবাহিনীর প্রতিটি পদক্ষেপ মক্কার মাটিতে প্রকম্পন সৃষ্টি করে। আর হস্তিযূথের গগনবিদারী চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয় পাহাড়ের গায়ে।
এদিকে মক্কায় তখন ঠিক বিপরীত দৃশ্য। যে মক্কা ছিল অগনিত মানুষের বিচরণ আর কোলাহলে পূর্ণ এক জনপদ, তা হয়ে ওঠে জনমানবহীন এক ভুতুড়ে নগরী। জীবন বাঁচাতে সবাই আশ্রয় নেয় নিকটস্থ পাহাড়ে। রয়ে যান কেবল আব্দুল মুত্তালিব। মহান পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম আঃ এর স্মৃতিবিজড়িত এই কাবাকে একা ফেলে তিনি যেতে পারেন না। এর সাথে মিশে আছে তার পূর্বপুরুষদের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য। কিন্তু সেই ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে আজ তিনি অপরাগ। নিজেকে বড় অসহায় অনুভব করেন আব্দুল মুত্তালিব।
হঠাৎ আব্দুল মুত্তালিব চারপাশের আবহাওয়ায় কি একটা পরিবর্তন অনুভব করেন। দূরে-বহুদূরে আকাশের এক কোণে তিনি একটি ছায়ার অস্তিত্ব দেখতে পান। ধীরে ধীরে ছায়াটি বড় হতে থাকে আর শীঘ্রই সারা আকাশ আচ্ছন্ন করে এগিয়ে আসে নগরীর দিকে। খুব ভালো করে লক্ষ করে আবু তালিব বুঝতে পারেন, এরা দলে দলে ছুটে আসা আবাবিল পাখি। সংখ্যায় তারা অগণিত। চারিদিক আচ্ছন্ন করে তারা এগিয়ে আসে কাবা ঘরের দিকে এবং চক্রাকারে আবর্তন করতে থাকে। অতঃপর তারা সেই পথের দিকে অগ্রসর হয়, যে পথ ধরে এগিয়ে আসছিল আব্রাহার হস্তিবাহিনী।
মক্কা উপত্যকার আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে পরে লক্ষ লক্ষ আবাবিল পাখিতে। অগণিত পাখির উপস্থিতি আর তাদের সম্মিলিত কিচিরমিচির আওয়াজ আব্রাহার বাহিনীর মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে হাতি ও ঘোড়াগুলো অস্থির হয়ে পড়ে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করে কিভাবে আতঙ্ক কাটিয়ে প্রাণীগুলোকে শান্ত রাখা যায়। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রাণীগুলো আব্রাহা সহ প্রত্যেকে আরোহীকে পিঠ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর দ্রুত ময়দান থেকে সরে যায়।
নিরীহ প্রাণিগুলো সরে গেলে শুরু হয় আক্রমণের পালা। একযোগে লক্ষ লক্ষ পাখি নিক্ষেপ করে তাদের সাথে বয়ে আনা পাথরখণ্ড। আর মধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে প্রচণ্ড গতিতে নেমে আসে সেই পাথরগুলো। বৃষ্টির মতো আড়াল করে দেয় মক্কা উপত্যকার আকাশ। পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে পাগলের মতো ছুটতে থাকে আব্রাহার সেনারা। নিজেদেরকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে তারা। কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা যায়। একেকটি পাথর বুলেটের গতিতে নেমে আসে। কোনোটা কারো মস্তক চূর্ণ করে দেয়, আর কোনোটা কারো বুক ঝাঝরা করে দেয়। মাত্র কয়েক মিনিটের আক্রমণে ধসে পড়ে সম্পূর্ণ বাহিনী। মৃত্যু হয় অহংকারী বাদশা আব্রাহার। কিছুক্ষণ আগেও যারা মাটিতে কম্পন সৃষ্টি করে এগিয়ে যাচ্ছিল কাবার দিকে, এক মুহূর্ত পরে তারাই মিশে যায় মাটির সাথে। আর এটাই ছিল মহান আল্লাহ তাআলার ঐশী ক্ষমতার প্রদর্শন।
তিনিই সেই সত্ত্বা, যিনি নীলনদের পানিতে সৈন্যসমেত ডুবিয়ে মেরেছিলেন দাম্ভিক ফেরাউনকে। তিনিই সেই সত্ত্বা যার ইশারায় মহাপ্রলয় নেমে এসেছিল কওমে লুতের উপর, আর শক্তিশালী ভূমিকম্প উল্টে দিয়েছিল তাদের পাপের নগরী। তিনিই সেই সত্বা যিনি নিমিশে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন অকৃতজ্ঞ আদ জাতির সুউচ্চ অট্টালিকা আর প্রাসাদ। তিনিই সেই সত্ত্বা যার ক্রোধ থেকে রক্ষা পায় নি হযরত শোয়াইবকে (আ.) প্রত্যাখ্যানকারী আহলে মাদিয়ান, রক্ষা পায়নি হযরত সালেহকে (আ.) প্রত্যাখ্যানকারী সামুদ জাতি, হযরত নূহকে (আ.) প্রত্যাখ্যাকারী পৃথিবীবাসী।
যারা অহংকারের বশে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে, যারা অজ্ঞতার কারণে সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদেরকে প্রমাণিত করে, তাদের জন্য এই ঘটনাগুলো সতর্কবার্তা।