Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / ইসলামের দৃষ্টিতে শিল্প-সঙ্গীত - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

ইসলামের দৃষ্টিতে শিল্প-সঙ্গীত

July 01, 2024 02:54:20 PM   অনলাইন ডেস্ক
ইসলামের দৃষ্টিতে শিল্প-সঙ্গীত

মোহাম্মদ আসাদ আলী:
আমরা মুসলমানরা খুব গর্ব করে একটা কথা বলে থাকি- ইসলাম হলো আল্লাহর দেওয়া পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান শব্দটার অর্থ আমরা কয়জন বুঝি তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মানুষের জীবনের বিভিন্ন ভাগ আছে। যেমন- রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন ইত্যাদি। একইভাবে মানুষের একটা সাংস্কৃতিক জীবনও আছে, যা তার আত্মার খোরাক যোগায়। কিন্তু আমাদের মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই মানুষের এই সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে অস্বীকার করে বসেন। তারা পাইকারিভাবে ফতোয়া দিয়ে থাকেন- গান হারাম, বাদ্য হারাম, ছবি হারাম, নাটক হারাম, চলচ্চিত্র হারাম, এক কথায় সকল প্রকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হারাম। তারা এমন সমাজ নির্মাণ করতে চান যেখানে কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থাকবে না। কিন্তু আসলেই কি ইসলামে সংস্কৃতি চর্চা হারাম? আজকের লেখায় আমরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড (বিশেষত গান-বাদ্য) নিয়ে ইসলামের অবস্থান জানার চেষ্টা করব ইনশা’আল্লাহ।

কোর’আনে সংস্কৃতি চর্চা ও গান-বাদ্য নিয়ে কী বলা হয়েছে? সঙ্গীত ও শিল্পচর্চা যদি হারাম হতো তাহলে আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে অন্তত একটি আয়াতে হলেও তা উল্লেখ করতেন। কারণ, যখন কোর’আন নাজেল হচ্ছিল, তখনও পৃথিবীর প্রায় সকল সভ্যতাতেই গান বাদ্যের প্রচলন ছিল। মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে সঙ্গীত ও শিল্পকলার চর্চা চালিয়ে আসছিল। সুতরাং এত বছর ধরে যে সাংস্কৃতিক চর্চা মানুষ চালিয়ে আসছে, সেটাকে আল্লাহ হারাম ঘোষণা করলে অবশ্যই বিশেষ জোর দিয়ে পবিত্র কোর’আনে সে বিষয়ে উল্লেখ থাকার কথা, আলোচনা থাকার কথা। গান গাইলে বা গান শুনলে কী ধরনের শাস্তি হবে সেটাও থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে পবিত্র কোর’আনে গান নিয়ে আল্লাহ একটা শব্দও বলেননি।
আমাদের ধর্মনেতারা অবশ্য একটা আয়াতকে গান হারামের পক্ষে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন, সেটা হলো সুরা লোকমানের ৬ নাম্বার আয়াত। সেখানে আল্লাহ বলেছেন- ‘আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য “লাহুওয়াল হাদিস” কিনে নেয়।’ লাহুওয়াল হাদিসের বাংলা হলো অসার, অহেতুক, অনর্থক কথা। আমাদের এক শ্রেণির আলেমের মতামত হলো- ‘এই আয়াতে আল্লাহ নাকি অসার কথা বলে গানের কথা বুঝিয়েছেন, তাই গান হারাম।’ সাধারণ জ্ঞানেই এই যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ অসার কথা মানে অসার কথাই। গানের মাধ্যমেও যদি অসার কথা বলা হয় তাহলে সেই অসার কথাই হারাম হবে, গান হারাম হবে কেন? গান হারাম করা উদ্দেশ্য হলে আল্লাহ গানের আরবি শব্দ “গেনা” বা “নাগমা” ব্যবহার করতেন। আল্লাহ তা করেননি।

সবচাইতে বড় কথা হলো, কোন আয়াতের কী অর্থ সেটা বোঝার উত্তম উপায় হচ্ছে আল্লাহর রসুল ও সাহাবীরা সেই আয়াতকে কীভাবে অনুসরণ করেছেন সেই ইতিহাস দেখা। আল্লাহ মদ হারাম করেছিলেন, এরপর আরব সমাজে মদের ছিটেফোটাও ছিল না। সাহাবীরা মদের পাতিল পর্যন্ত রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। যদি আল্লাহ সঙ্গীত হারাম করতেন তাহলে কোনো সাহাবী কখনও গান গাইতেন কি? আল্লাহর রসুল গান শুনতেন কি? কখনই নয়। কিন্তু ইতিহাস কী বলছে চলুন দেখা যাক।

রসুল (সা.) ও সাহাবীদের সঙ্গীতচর্চা-
প্রথমত আপনাকে মনে রাখতে হবে- রসুল (সা.) কে ছিলেন? তিনি ছিলেন ইতিহাসের সবচাইতে বড় বিপ্লবী মহামানব, যিনি মাত্র ১০ বছরে ৭৮টা যুদ্ধ করেছিলেন। কাজেই এত ব্যস্ততার মধ্যে গান শোনার অবসর তিনি খুব একটা পাননি। তারপরও আপনি যদি হাদিস গ্রন্থগুলো খুলে দেখেন, বহু হাদিস পাবেন যেখানে রসুল (সা.) এর সামনে সাহাবীরা গান গেয়েছেন, রসুলকে গান গেয়ে শুনিয়েছেন, আবার কখনও রসুল (সা.) নিজেই দফ বাজিয়ে গান গাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এসব ঘটনা থেকে কয়েকটি ঘটনা হাদিসের রেফারেন্সসহ দেখে নেওয়া যাক-

১. সহিহ বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈর হাদিস। মসজিদে নববী নির্মাণের সময়কার স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে আনাস (রা.) বলেন: মসজিদ নির্মাণের সময় রসুল (সা.) ও তাঁর সঙ্গীরা কর্ম-সঙ্গীত গাচ্ছিলেন। (বোখারী ও মুসলিম)
২. আয়েশা (রা.) বলেন- আমার অধীনে এক আনসারী মেয়ে ছিল; যাকে আমি বিয়ে দিলাম। তখন রসুল (সা.) বললেন, হে আয়েশা! বিয়েতে তোমরা গান গাইলে না? আনসারী গোত্রের লোকেরা তো গান পছন্দ করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ: ৩১৫৪)
৩. আনাস (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বনি নাজ্জার গোত্রের এক মহল্লার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন কিছু কিশোরী দফ বাজাচ্ছিল আর বলছিল- আমরা বনী নাজ্জারের কিশোরী, কতই না উত্তম, আমাদের প্রতিবেশী মুহাম্মদ (সা.)। অতঃপর নবী (সা.) বললেন; আল্লাহ জানেন আমার হৃদয় তোমাদের ভালোবাসে। (আস সহীহা: ৩১৫৪)
৪. আয়েশা (রা.) এর বর্ণিত হাদিস। রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন- তোমরা প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে মসজিদে বিয়ে সম্পন্ন করো এবং তাতে দফ বাজাও। (মিশকাতুল মাসাবীহ: ৩১৫২)
৫. আরেক হাদিসে রসুল (সা.) বলেন- বিয়েতে হারাম ও হালালের পার্থক্য হলো দফ বাজানো ও ঘোষণা দেওয়া। (ইবনু মাজাহ: ১৮৯৬)
৬. বুরাইদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল (সা.) তাঁর কোনো এক যুদ্ধাভিযানে যান। তিনি ফিরে এলে এক কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে এসে বলে, হে আল্লাহর রসুল! আমি মানত করেছিলাম যে, আপনাকে আল্লাহ তা’আলা সুস্থাবস্থায় ফিরিয়ে আনলে আপনার সম্মুখে আমি দফ বাজাবো এবং গান করব। রসুল (সা.) তাকে বললেন- যদি মানত করে থাকো তাহলে বাজাও। (তিরমিজি: ৩৬৯০)
৭. রুবাঈ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- আমার বাসর রাতে রসুল (সা.) এসে আমার বিছানায় এমনভাবে বসলেন, যেমনটা তুমি বসে আছো। অতঃপর কয়েকটি বালিকা তাদের দফ বাজিয়ে বদর যুদ্ধে শহীদ আমার পিতা ও চাচার সুনাম করছিলো। এক পর্যায়ে একটি বালিকা বললো, “আমাদের মাঝে এমন একজন নবী রয়েছেন, যিনি জানেন আগামীকাল কী হবে।” একথা শুনে রসুলাল্লাহ বললেন- এই কথাটা বর্জন করো, বরং আগে যা বলছিলে তাই বলো। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯২২)
৮. কায়স বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- রসুল (সা.) এর যামানায় যা কিছু ঘটেছে তা আমি দেখেছি। একটি বিষয় অবশ্যই আমি দেখেছি যে, রসুল (সা.) এর সময়ে ঈদুল ফিতরের দিন “দফ” বাজানো হতো। (ইবনু মাজাহ: ১৩০৩) 
৯. একবার নবীজী মহিলাদেরসহ এক সফরে ছিলেন। হুদী গায়ক হুদি গান গাইছিল। উট হাঁকানোর তালে যে গান গাওয়া হয় তাকে হুদী বলে। রসুল (সা.) তাকে নির্দেশ দিলেন- ওহে আঞ্জাশা! তুমি কাঁচপাত্র তুল্য সওয়ারীদের সাথে সদয় হও। অর্থাৎ তাকে মহিলাদের কথা বিবেচনা করে আস্তে চালাতে বললেন। কিন্তু গান গাওয়া নিয়ে কিছু বললেন না। (সহিহ বুখারী: ৬২১১)
১০. এবার আসুন বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভীর লেখা ইসলামে হালাল-হারামের বিধান গ্রন্থ থেকে একটি হাদিস উল্লেখ করা যাক। মাওলানা আব্দুর রহীমের অনুবাদ করা বইটির ৪০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত হাদিস- হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, তাঁর কাছে উপস্থিত থেকে দু’টি মেয়ে ঈদুল আজহার দিনে গান গাচ্ছিল ও বাদ্য বাজাচ্ছিল। নবী করিম (সা.) কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। এ সময় আবু বকর (রা.) তথায় উপস্থিত হলেন। তিনি মেয়ে দু’টোকে ধমকালেন। নবী করিম (সা.) তা শুনে মুখের কাপড় খুলে বললেন- হে আবু বকর, ওদের গাইতে দাও। এখন তো ঈদের উৎসবের সময়। (বোখারী ও মুসলিম)

আবু বকর (রা.) হয়ত ভেবেছিলেন- রসুল (সা.) হয়ত মেয়েদের গান বাদ্যের কারণে বিশ্রাম নিতে পারছেন না। তাই তিনি মেয়েদেরকে ধমক দিয়েছিলেন কিন্তু রসুল (সা.) প্রতিবাদ করে আবু বকরকেই থামিয়ে দিলেন।
পাঠক, এভাবে রেফারেন্স দিতে থাকলে লেখার কলেবর বড় হয়ে যাবে, তাই আমি মাত্র দশটা রেফারেন্স দিলাম। হাদিস নম্বরও দিলাম। আপনারা নিজেরাও যাচাই করে দেখতে পারেন। উপরোক্ত হাদিসগুলোর মধ্যে কিছু আছে রসুলাল্লাহর মুখের নির্দেশ, বাকি সবই রসুলাল্লাহর জীবনের প্রত্যক্ষ ঘটনা, যার সাক্ষী ছিল পুরো উম্মাহ।

তাহলে কি সব ধরনের গানই হালাল?
পাঠক, এই প্রশ্নের জবাব আমরা সবাই জানি। ইসলামের সাধারণ মানদণ্ড হলো- অশ্লীলতা হারাম, আল্লাহর নাফরমানি হারাম, মিথ্যাচার হারাম। সুতরাং যে গানে অশ্লীলতার বিস্তার ঘটে, আল্লাহর নাফরমানির প্রকাশ ঘটে ও মিথ্যা কথা প্রচার করা হয়- সেই গান অবশ্যই হারাম। যেমন- উপরোক্ত একটি হাদিসে আমরা দেখলাম একটি গানের লাইনে “অসত্য” থাকায় রসুল (সা.) সেই লাইনটা সংশোধন করে দিলেন কিন্তু তিনি গান গাইতে নিষেধ করলেন না। শুকরের গোশত হারাম বলে তো আপনি গোশতকেই হারাম বলে দিতে পারেন না। গরুর গোশত, মুরগির গোশত তো হালাল। শুধু হারামকে হারাম বলতে হবে, যতটুকু হারাম ততটুকুকেই হারাম বলতে হবে। কারণ মাথা ব্যাথার জন্য আমরা কেউই মাথা কেটে ফেলার কথা ভাবি না।

গান বাদ্য নিয়ে কিছু ভুল ধারণার জবাব
অনেকে মনে করেন- “গান হারাম না ঠিক আছে, তবে ইসলামী গান হতে হবে।” তারা ইসলামী গান বলতে হামদ, নাত, গজল ইত্যাদিকে বুঝিয়ে থাকেন। অথচ, ইসলামী গান বলতে আলাদা কোনো গানের শাখা খোলার দরকার নেই। যে গানে হারাম উপাদান থাকবে না, সেটাই ইসলামী গান, ইসলামসম্মত গান। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ হানাদারদের বিরুদ্ধে জাতিকে জাগ্রত করার জন্য লিখলেন “কারার ঐ লৌহ কপাট!” গানটি লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী যুবকদের আজও উদ্দীপ্ত করে! আপনি এই গানকে অনৈসলামিক গান বলবেন?

আবার অনেকে বলেন- “রসুল (সা.) যেহেতু দফ বাজাতে বলেছেন কাজেই দফ হালাল, কিন্তু অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র হারাম।” তাদেরকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে বলতে চাই, দফ যদি হালাল হয়, তাহলে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র কী দোষ করল একটু বলবেন কী? বাদ্যযন্ত্র তো একটা যন্ত্রমাত্র, এটা কি হারাম-হালাল হতে পারে? একটা চাকু যখন ছিনতাইকারীর হাতে পড়ে তখন সে মানুষকে জখম করে, আর যখন ডাক্তারের হাতে পড়ে ডাক্তার রোগীর জীবন বাঁচায়। চাকুকে কি হারাম বলা যায়? ১৪০০ বছর আগে আজকের মতো আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কার হয়নি, তখন সহজলভ্য বাদ্যযন্ত্র বলতেই ছিল দফ। কাজেই সাহাবীরা সেটাই ব্যবহার করেছেন। এই যুগে আপনি এই যুগের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করবেন, অসুবিধা কী? সাহাবীরা উটের পিঠে চলাফেরা করতেন বিধায় কি আমরা বলব কেবল উটের পিঠে চড়া হালাল আর বাস-ট্রেইন হারাম?

কেউ কেউ আবার একথাও বলেন- “হাদিসে কিশোরীদের গান গাওয়ার বর্ণনা আছে, কাজেই বড়দের গান হারাম।” অথচ, এই কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। হাদিসে বড়দেরও গান গাওয়ার বিবরণ আছে, দফ বাজানোর বিবরণ আছে। উপরন্তু রসুল (সা.) নিজে গান শুনেছেন। তিনি তো প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। যে কাজ অন্যদের জন্য হারাম, সেটা কি রসুল (সা.) নিজে করতে পারেন? নাউজুবিল্লাহ!

গান হারামের পক্ষে কয়েকটা জাল হাদিসও বলা হয়। যেমন, এক হাদিসে পাওয়া যায়- রসুল (সা.) বাঁশির আওয়াজ শুনে কানে আঙ্গুল দিয়েছিলেন। বাঁশির আওয়াজ দূরে চলে গেলে তিনি কানের আঙ্গুল সরান। (মুসনাদে আহমদ হাদীস: ৪৫৩৫)
এই হাদিসের দু’টি ব্যাখ্যা হতে পারে- নিশ্চয়ই সেই বাঁশির আওয়াজে প্রচণ্ড শব্দদূষণ হচ্ছিল বিধায় রসুল (সা.) স্বাস্থ্যগত কারণে কানে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছিলেন। অথবা এই হাদিসটি একটা জাল হাদিস। বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটেনি এবং ঘটার কথাও নয়। কেন এই কথা বলছি? কারণ রসুল (সা.) ছিলেন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ। কোনো ব্যক্তি প্রকাশ্যে হারাম কাজ চালিয়ে যাবেন, আর রসুল (সা.) তাকে না থামিয়ে, তার শাস্তিবিধান না করে, উল্টো নিজেই কানে আঙ্গুল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, এটা রসুলাল্লাহর শানের সঙ্গে, চরিত্রের সঙ্গে ও দায়িত্বের সঙ্গে যায় না। যিনি শিরক কুফরের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি সামান্য বাঁশির আওয়াজকে প্রতিহত করতে পারবেন না এটা কি যুক্তিসঙ্গত?

এবার দেখা যাক গান-বাদ্য হারাম হবার পক্ষে যে কয়টি জাল হাদিস উল্লেখ করা হয়, সেগুলোর বিষয়ে কয়েকজন আলেমের মতামত। কাযী আবু বাকার ইবনুল আরাবী তার কিতাব আল আহকাম-এ বলেছেন, ‘সঙ্গীত নিষিদ্ধ বলে যেসব হাদীসে দেখা যায়, সেগুলোর একটিও নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত নয় (হাদীসশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ আলেমদের দ্বারা)।’ ইবনে হাজম বলেছেন- ‘এ পর্যায়ে সব বর্ণনাই বাতিল ও মনগড়া রচিত।’ (ইসলামে হালাল-হারামের বিধান, পৃষ্ঠা: ৪০৮-৯) গান বা সঙ্গীত কাকে বলে এমন প্রশ্নের উত্তরে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ইসলামী পণ্ডিত শায়খ ইউসুফ কারযাভী বলেন- ‘যে কাজে সাধারণত মানুষের মন আকৃষ্ট হয় ও অন্তর পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করে এবং কর্ণ কুহরে মধু বর্ষিত হয়, তা হচ্ছে গান বা সঙ্গীত।’ (ইসলামে হালাল-হারামের বিধান: পৃষ্ঠা ৪০৬) শায়খ কারযাবী গানকে মুবাহ বলেছেন নিন্মোক্ত শর্তে: নির্লজ্জতা,কুৎসিত-অশ্লীল ভাষা কিংবা পাপ কাজে উৎসাহ উত্তেজনা দানের সংমিশ্রণ না থাকা।

গান-বাদ্য না থাকলে অসুবিধা কী?
আমি জানি পাঠকদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত ভাবছেন- মানুষকে গান বাজনা করানোর জন্য এই লোক এত উঠেপড়ে লেগেছে কেন? যদিওবা গান/বাদ্য হালাল হয়, তারপরও কী দরকার এসবের? গান না শুনে একটু ওয়াজ শুনলেও তো সওয়াব হয়!”

পাঠক, যারা ছোটবেলা থেকে সঙ্গীত ও শিল্পকলাকে হারাম জেনে এসেছেন, তারা আমার এই একটা লেখা পড়েই এতদিনের বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসবেন আমি নিজেও তা আশা করি না। বিশেষ করে যখন সংস্কৃতিচর্চার নামে চলছে অশ্লীলতা ও অনৈসলামিক মূল্যবোধের প্রসার, তখন সংস্কৃতিচর্চার পক্ষে বললে অবচেতনভাবেই সেটার বিরোধিতা হবে, সন্দেহের তীর ছুটে আসবে এতে অবাক হবার কিছু নাই। এই যে আমি গান বাদ্য নিয়ে এত কথা বললাম, হয়ত আমার বিষয়েও আপনার মনে একটা নেচিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। সন্দেহ তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু না পাঠক, আমি কলম ধরেছি মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণের জন্যই। আমার কথাগুলো যেমন বুঝতে হবে, আমার মনের আকুতিটাও বুঝতে হবে। বুঝতে হবে আমার উদ্দেশ্য।

মানুষ শুধু দেহ না, তার একটা আত্মাও আছে। তার আত্মারও খোরাক দরকার, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা দরকার। মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনকে আপনি চাইলেই অস্বীকার করতে পারবেন না। মানুষের মনকে আল্লাহ শিল্প, সংস্কৃতি, সঙ্গীতের অনুরাগী করে সৃষ্টি করেছেন। গান না শুনে, সিনেমা না দেখে, নাটক না দেখে, উপন্যাস না পড়ে, ছবি না এঁকে, কেবল ওয়াজ শুনে হয়ত আপনি আপনার জীবন পার করে দিতে পারবেন। কিন্তু আপনার সন্তানরা কেবল ওয়াজ শুনে জীবন পার করতে পারবে? পারবে না। তারা বিনোদনের জন্য ইন্টারনেটে যাবে, টেলিভিশন দেখবে, মোবাইল ফোন হাতে নিবে, আর সেখানে পাবে শুধুই অশ্লীল সিনেমা, অশ্লীল গান, অশ্লীল কন্টেন্ট। খুবই স্বাভাবিক- কারণ ইসলামী মাইন্ডের লোকজন যখন সঙ্গীত ও শিল্পচর্চাকে হারাম জ্ঞান করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে ত্যাগ করেছেন, তখন সাংস্কৃতিক অঙ্গন চলে গেছে ধর্মহীন ইসলামবিদ্বেষীদের দখলে। এই ধর্মহীন, নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষীরা ইচ্ছা করেই এমন গান বানাচ্ছে, এমন সিনেমা বানাচ্ছে, এমন নাটক বানাচ্ছে- যেগুলো ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক! তারা বিনোদনের নামে অশ্লীলতার প্রসার ঘটাচ্ছে আর মুসলিম ঘরের সন্তানরা সেই অশ্লীলতায় ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু পাঠক একবার ভেবে দেখুন তো- আমরা যদি মানবপ্রবৃত্তিকে অস্বীকার না করে, শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যের এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারতাম, যেখানে গান থাকবে, বাদ্য থাকবে, সিনেমা থাকবে, সাহিত্য থাকবে, আর্ট থাকবে, সব থাকবে, কিন্তু অশ্লীলতা থাকবে না, মিথ্যাচার থাকবে না, শিরক কুফর থাকবে না। তাহলে আমাদের সন্তানরা একটা নিরাপদ সাংস্কৃতিক অঙ্গন পেত। তাদেরকে বিনোদনের জন্য অশ্লীল জিনিস দেখতে হতো না।

গান হারামের ফতোয়া তো গত হাজার বছর ধরেই আমাদের আলেমরা দিয়ে আসছেন। তাতে আমাদের মুসলিম সমাজে একদিনের জন্যও কি গান বাদ্য বন্ধ থেকেছে? উল্টো ওয়াজের বক্তারাই হিন্দি গানের সুর নকল করে প্যারোডি গেয়ে শোনাচ্ছেন। কাজেই আসুন নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিজেরাই কিছু করি। সঙ্গীত-শিল্পকলার বিরুদ্ধে অহেতুক ফতোয়াবাজি বন্ধ করে এমন একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি করি, যেখানে চিত্তবিনোদনের সকল সুযোগই থাকবে, শুধু থাকবে না অশ্লীলতা ও ক্ষতিকর উপাদান। কেবল ওয়াজ করলেই সওয়াব হয় এই ধারণা ভুল। অনৈক্য সংঘাতে লিপ্ত এই মুসলিম জাতির কালঘুম ভাঙানোর জন্য একটা কালজয়ী জাগরণী গান গেয়েও ইসলামের প্রভূত কল্যাণ সাধন করা সম্ভব। একজন কাজী নজরুল ইসলাম সেটা করে দেখিয়েছিলেন গত শতাব্দীতে। আজও কাজী নজরুলের “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে” গান ছাড়া আমাদের ঈদ যায় না। একবার ভাবুন তো- বিদ্রোহী কবি যদি গান হারাম মনে করতেন তাহলে আমরা মুসলিম সমাজ কতটা বঞ্চিত হতাম? তাকে সালাম জানাই, তিনি ফতোয়ার চোখ রাঙানিকে ভয় পাননি। কিন্তু এই যুগের কাজী নজরুলরা কোথায়? তারা হারিয়ে যাচ্ছেন না তো মিথ্যা ফতোয়ার ভিড়ে?