
রিয়াদুল হাসান:
তারা এ জাতিকে ভুলিয়ে দিল তার নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পূর্ব পুরুষের গৌরবগাঁথা। মাথায় ভরে দিল ইংরেজ কোন রাজার প্রাসাদে কয়টা রুম ছিল, কয়টা রানি ছিল, আস্তাবলে কয়টা ঘোড়া ছিল এসব। এসব শিখে এদেশের মানুষ নিজের দেশের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা হারালো, নিজের অস্তিত্বের প্রতি, পোশাক-আশাক, গায়ের রঙের প্রতি ঘেন্না ধরে গেল। তারা চলনে বলনে, ঠাঁটবাটে, কৃষ্টি-কালচারে হয়ে উঠল বাদামি ইংরেজ। তাদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে গেল সাদা চামড়ার প্রভুদের অন্ধ অনুকরণ। সেই ধারাবাহিকতায় আজও আমাদের মধ্যে স্নো পাউডার মেখে ফর্সা হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। একই সাথে চলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাসহ প্রতিটি সিস্টেমকে ঢেলে সাজানোর প্রাণান্তকর সংগ্রাম।
তারা এ জাতিকে ভুলিয়ে দিল তার নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পূর্ব পুরুষের গৌরবগাঁথা। মাথায় ভরে দিল ইংরেজ কোন রাজার প্রাসাদে কয়টা রুম ছিল, কয়টা রানি ছিল, আস্তাবলে কয়টা ঘোড়া ছিল এসব। এসব শিখে এদেশের মানুষ নিজের দেশের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা হারালো, নিজের অস্তিত্বের প্রতি, পোশাক-আশাক, গায়ের রঙের প্রতি ঘেন্না ধরে গেল। তারা চলনে বলনে, ঠাঁটবাটে, কৃষ্টি-কালচারে হয়ে উঠল বাদামি ইংরেজ। তাদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে গেল সাদা চামড়ার প্রভুদের অন্ধ অনুকরণ। সেই ধারাবাহিকতায় আজও আমাদের মধ্যে স্নো পাউডার মেখে ফর্সা হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। একই সাথে চলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাসহ প্রতিটি সিস্টেমকে ঢেলে সাজানোর প্রাণান্তকর সংগ্রাম।
কিছুদিন আগে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওয়াসার এমডি তাসকিম এ খানের ‘যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বিলাসবহুল বাড়ি থাকার অভিযোগ’ নিয়ে গণমাধ্যমে ঝড় উঠেছিল। ওদিকে নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকার সার গিলে ফেলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ সংক্রান্ত মামলা আদালতে চলমান রয়েছে। এর আগে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় বনখেকো আখ্যাত চাকরিচ্যুত প্রধান বন সংরক্ষক ওসমান গনিকে ১২ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেছে আদালত যা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল।
লোভ ও অতিরিক্ত ভোগের আকাক্সক্ষা থেকেই দুর্নীতির উৎপত্তি হয়। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারি দায়িত্ব পালনের বিধিবিধান ও কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে কাউকে কোনো সুবিধা দেয়া হলো দুর্নীতি। মানুষের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার ঘাটতি হলেই দুর্নীতি জেঁকে বসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সাল থেকেই দুর্নীতি বিস্তার লাভ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেয়া বিভিন্ন বক্তৃতায় দেশের দুর্নীতি, অতিমুনাফাখোরি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, কালোবাজারি প্রভৃতির বিরুদ্ধে কষ্ট ও হতাশা ফুটে ওঠে। পরবর্তীতে সামরিক সরকার ও পরবর্তী সময়ে ‘স্বৈরাচারী’ সরকার দেশ শাসনের ফলে দুর্নীতি আরো ডালপালা বিস্তার করে।
দুর্নীতিসংক্রান্ত বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থাগুলোর রিপোর্ট অনুযায়ী বহু পূর্ব থেকেই দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে ২০০১-০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বের প্রথম স্থানে ছিল। একই প্রতিষ্ঠানের ২০২০ সালের ‘করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স’ অনুযায়ীও দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতিতে আফগানিস্তান শীর্ষে এবং বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে।
দুর্নীতি করে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচারের মত কাজগুলো যারা করছেন তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত। কেননা উচ্চশিক্ষিত না হয়ে এসব উচ্চপদে কেউ যেতেই পারে না। বাংলাদেশ থেকে কে কত টাকা বিদেশে পাচার করেছে, হাইকোর্ট জানতে চাওয়ার নয় মাস পর ৪৩টি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা প্রদান করেছিল দুদক। পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপার্স নামে প্রদত্ত্ব সেই তালিকার প্রত্যেকটি মানুষ কেবল শিক্ষিতই নন, প্রত্যেকে যার যার অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত। অশিক্ষিত একজন চোর মানুষের বাড়িতে সিঁদ কাটতে পারে, গরু চুরি করতে পারে, দুধে জল মেশাতে পারে, মলম পার্টির সদস্য হতে পারে কিন্তু আমলা হতে পারে না।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া চার লাখ কোটি টাকা। এই টাকা বাংলাদেশের মোট রিজার্ভের সমপরিমাণ। দুই বছর আগে পুরো বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের সমান। তথ্যমতে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে চলে যায়। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “বাংলাদেশ প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে পায় সেটির প্রায় তিনগুণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়।” এর পরিণামে হতদরিদ্র ঋণগ্রস্ত দেশটির উপর প্রতিদিন বাড়তে থাকে ঋণের বোঝা, আর জনগণের উপর বাড়তে থাকে করের বোঝা। বাড়ানো হয় বিদ্যুতের মত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন সেবাখাতের ব্যয়ভার।
যে মুহূর্তে আমাদের দেশ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আছে, যখন খাদ্যের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশের অধিকাংশ মানুষকে, তখন এই দুর্নীতিবাজ তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণি দেশের তহবিল খালি করে বিদেশে আখের গোছাচ্ছে। কীভাবে তারা এতটা আত্মকেন্দ্রিক, অমানবিক ও স্বার্থপর হয়ে উঠল যে, যে দেশের আলো বাতাস গায়ে মেখে, যে দেশের ধানচাল খেয়ে তারা বড় হয়েছে সে দেশকেই ফকির বানিয়ে দিতে তাদের একটুও বিবেকে বাধছে না?
হ্যাঁ, তারা বিবেকের বালাই থেকে মুক্ত হতে পেরেছে বস্তুবাদী পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা ও জীবনদর্শনের প্রভাবে। এই শিক্ষা তাদেরকে বলেনি যে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি, সে আশরাফুল মাখলুকাত। এই শিক্ষা তাদেরকে বলেনি যে তারা আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও রোজ হাশরে এক মহা পরাক্রমশালী বিচারকের কাঠগড়ায় খোলা আমলনামা হাতে দাঁড়াতে হবে। তারা শিখেছে মানুষ আর বানর চাচাতো ভাই, শিখেছে ধর্ম হচ্ছে চতুর মানুষের সৃষ্টি। তারা বলছে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেন নাই, বরং মানুষই আল্লাহকে সৃষ্টি করেছে, পরকালের হিসাব নিকাশ বলতে কিছু নেই। তাই যত পারো কামাই করো, ভোগ কর। অর্থ, নাম, যশ, খ্যাতিই হচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্য। এগুলোর মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। এ শিক্ষাই মানুষের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দিচ্ছে।
আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে, এ জীবনদর্শনের গোড়াটা কোথায়? মধ্যযুগের ইউরোপে জাতীয় জীবনের কর্তৃত্বের জায়গা থেকে খ্রিষ্টধর্মের পতনের পর কঠোর বস্তুবাদী দর্শন ও ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আলিঙ্গন করে নেয় ইউরোপ। সেখানকার চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে শুরু করে জীবনের সমস্তকিছুরই বস্তুবাদী যুক্তি মতবাদ উদ্ভাবন করতে থাকেন আর সকল ধর্মকে দাঁড় করান যুক্তির বিপরীতে। তারা সামরিক শক্তিবলে মুসলিম বিশ্বসহ পৃথিবীর বিপুল ভূখণ্ডের অধিকার লাভ করে। ভারতবর্ষ পদানত হয় ব্রিটিশ বেনিয়াদের। এর আগে এখানে চলছিল মোগল শাসনামল যা বিকৃত হলেও ইসলাম ধর্মের দর্শন ও শাসনব্যবস্থার দ্বারাই মোটামুটি পরিচালিত হচ্ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা যখন শাসন আরম্ভ করল তারা নিজেদের দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা-দর্শন, সাহিত্য, বিধিবিধান, জনপ্রশাসন, সরকার কাঠামো এক কথায় সবকিছুই এ দেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দিল। নিজেরা শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সেগুলোই এদেশের মানুষদেরকে শিক্ষা দিতে লাগল।
বিরাট ভারতবর্ষের জন-প্রশাসনসহ অন্যান্য দপ্তরগুলো চালাতে যে জনশক্তি দরকার তা নিজেদের দেশ থেকে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। তাই ইংরেজদের ভাষা বুঝতে পারে, কেরানি দপ্তরির কাজগুলো চালিয়ে নিতে পারে এমন একটি শিক্ষিত শ্রেণি তারা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তৈরি করল। সরকারি প্রতিটি বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের মূল পরিচালকের জায়গাগুলো তারা ইংরেজদের হাতে রাখল, যেমন জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার, জেলার, ডাকবিভাগের প্রধান, রেল বিভাগের প্রধান ইত্যাদি।
সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের মনে মগজে তারা একটা বিশ্বাস দৃঢ়মূল করে দিল যে, প্রাচ্যের সব জঘন্য। প্রাচ্যের আবহাওয়া থেকে শুরু করে মানুষের জীবনাচরণ, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, সাহিত্য সব নিকৃষ্ট। তাদের তুলনায় আমরা অসভ্য, বর্বর, নেটিভ, জংলি বানর। পক্ষান্তরে তারা সঙ্গীতে, সাহিত্যে, শৌর্যে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে, সভ্যতায়, জীবনপদ্ধতিতে অতি উন্নত, সুসভ্য, দেবতুল্য। এদেশে তারা এসেছে ‘বনের রাজা টারজান’ হয়ে।
তারা এ জাতিকে ভুলিয়ে দিল তার নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পূর্ব পুরুষের গৌরবগাঁথা। মাথায় ভরে দিল ইংরেজ কোন রাজার প্রাসাদে কয়টা রুম ছিল, কয়টা রানি ছিল, আস্তাবলে কয়টা ঘোড়া ছিল এসব। এসব শিখে এদেশের মানুষ নিজের দেশের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা হারালো, নিজের অস্তিত্বের প্রতি, পোশাক-আশাক, গায়ের রঙের প্রতি ঘেন্না ধরে গেল। তারা চলনে বলনে, ঠাঁটবাটে, কৃষ্টি-কালচারে হয়ে উঠল বাদামি ইংরেজ। তাদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে গেল সাদা চামড়ার প্রভুদের অন্ধ অনুকরণ। সেই ধারাবাহিকতায় আজও আমাদের মধ্যে স্নো পাউডার মেখে ফর্সা হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। একই সাথে চলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাসহ প্রতিটি সিস্টেমকে ঢেলে সাজানোর প্রাণান্তকর সংগ্রাম।
বর্তমানে পশ্চিমাদের মানসিক দাসত্বের নিগড়ে বন্দী জনগোষ্ঠির শিক্ষিত অংশকে হরহামেশাই বলতে শোনা যায় দেশ ও জাতির অগ্রগতির জন্য, শান্তি ও নিরপত্তার জন্য ধর্মের বা ইসলামের কী প্রয়োজন? সভ্যতার চূড়ায় আরোহণ করা পশ্চিমা বিশ্ব তথা ইউরোপ, আমেরিকায় তো ইসলামের বা অন্য কোনো ধর্মের গুরুত্ব নেই। অথচ তাদের দেশের জনগণের জীবনমান মুসলিমদের থেকে বহু গুণে উন্নত। অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলোতে অশিক্ষা, ক্ষুধা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হানাহানি, সন্ত্রাস, অপরাধ ইত্যাদি ভয়াবহ আকৃতি নিয়েছে।
ভালো কথা। আমরা তো দুশ বছর সরাসরি তাদের দাসত্ব করেছি। তারপর থেকে সিস্টেমের দাসত্ব, মানসিক দাসত্ব অব্যাহতভাবে করে যাচ্ছি। লক্ষ্য একটাই অর্থনৈতিক উন্নতি, জীবনমানের উন্নতি, অর্থাৎ বস্তুগত উন্নতি। কিন্তু সেটা হল কি? না, হল না। যুগের পর যুগ ধরে অন্ধ অনুকরণ করেও প্রভু ও দাসের সম্পূর্ণ ভিন্ন দশা। পশ্চিমা প্রভুদের উন্নতি যেমন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, তাদের অনুকরণ করা দাসদের অবনতিও তেমন ত্বরান্বিত হচ্ছে।
পাশ্চাত্য প্রভুরা দখলকৃত দেশগুলোর ক্ষমতা ছেড়ে যাবার সময় এই দেশগুলির যেটুকু অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছিল, আজ ৪০/৫০ বছর পর সেটুকুও অবশিষ্ট নেই। সেদিন যতলোক অর্ধাহারে, অনাহারে থাকতো আজ তার চেয়ে বেশি মানুষ অনাহারে থাকে। পাশ্চাত্য প্রভূরা চলে যাবার দিন এই দেশগুলির উপর কোন ধারকর্জ ছিল না। আজ পাশ্চাত্যের কাছে ঋণ, ধার-কর্জে এদের হাড়গোড় পর্যন্তÍ দায়বদ্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ প্রায় এক লক্ষ টাকা। মাঝখান থেকে আত্মার ও চরিত্রের যেটুকু পরিচ্ছন্নতা ছিল পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে তাও হারিয়ে গেছে। পাশ্চাত্য প্রভুরা চলে যাবার দিনটির চেয়ে প্রতিটি তথাকথিত মুসলিম দেশে অন্যায়, খুন-জখম, রাহাজানী, ব্যভিচার, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি আজ বহুগুণ বেশি এটা যে কোন পরিসংখ্যান দেখলেই দেখা যাবে। প্রত্যেকটি জাতির নৈতিক চরিত্র আজ অধঃপতিত। পশ্চিমা জীবনদর্শন নকল করার প্রচেষ্টার ফল এই হয়েছে যে প্রাচ্যের দেশগুলি জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে নিম্নগামী, অধঃগামী। ঊর্ধ্বগামী শুধু তিনটি ক্ষেত্রে, জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে, অপরাধে আর পাশ্চাত্যের কাছে ঋণের অঙ্কের পরিমাণে। পশ্চিমা প্রভুদের দেশের আইন-আদালত, পুলিশ প্রশাসন, চিকিৎসাব্যবস্থা, দাপ্তরিক সেবা, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের মত দেশের ঐ খাতগুলোর কোনো তুলনাই হয় না। অথচ আমরা তাদেরকে নকল করার চেষ্টায় ওষ্ঠাগত প্রাণ হচ্ছি।
অন্ধ অনুকরণ করেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মাঝে জীবনের প্রতি স্তরে তফাৎ সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতার একনিষ্ঠ অন্ধ অনুকরণকারী প্রাচ্যের নেতৃত্ব চোখ-কান বুজে পাশ্চাত্যের বস্তুতান্ত্রিক, ভারসাম্যহীন, একপেশে অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু পাশ্চাত্যের মত অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ করতে গেলে যে চারিত্রিক গুণগুলি প্রয়োজন তার নিম্নতম মানও তাদের শিক্ষিত সংখ্যালঘু অংশেরও নেই, অশিক্ষিত সংখ্যাগরিষ্ট অংশের তো নেই-ই। পাশ্চাত্য জাতিগুলি তাদের ভৌগোলিক রাষ্ট্রের (ঘধঃরড়হ ঝঃধঃব) স্বার্থকে তাদের অধিকাংশ মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের উপর স্থান দেয়। তাদের বিদ্যালয়, স্কুল-কলেজে, ছোট বেলা থেকেই কতগুলি বুনিয়াদী শিক্ষা এমনভাবে তাদের চরিত্রের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয় যে কিছু সংখ্যক অপরাধী চরিত্রের লোক ব্যতীত কোনো মদখোর, মাতাল, ব্যভিচারীকে দিয়েও তার দেশের, জাতির ক্ষতি হবে এমন কাজ করানো যায় না, খাওয়ার জিনিসে ভেজাল দেওয়ানো যায় না, মানুষের ক্ষতি হতে পারে এমন জিনিস বিক্রি করানো যায় না ইত্যাদি। পক্ষান্তরে প্রাচ্যের এই ‘মুসলিম’ দেশগুলিতে এখনও ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখার ফলে যে শিক্ষিত শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে তা একটি স্বাধীন জাতির, বিশেষ করে অনুন্নত দেশের জন্য কোন কাজে আসবে না। কারণ একটি জাতিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতি করতে গেলেও যে কর্মনিষ্ঠা, যে সাধুতা, যে কর্তব্যপরায়ণতা একান্ত প্রয়োজন তা এদের মধ্যে নেই। ব্যক্তিগত, দলীয় স্বার্থকে এরা দেশের স্বার্থের ওপরে স্থান দেয়। কেননা ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষা, অংক, ভূগোল, কিছু বিজ্ঞান, কিছু বিকৃত ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হত। কিন্তু চরিত্র গঠনের কোন শিক্ষা তাতে ছিল না এবং আজও নেই। কাজেই, স্বভাবতই পাশ্চাত্যের শিক্ষালয়গুলির ছাত্র-ছাত্রীরা সুশৃঙ্খল আর প্রাচ্যের উশৃঙ্খল, সেখানে লেখাপড়া হয় আর এখানে রাজনীতি, মারামারি, গোলাগুলি হয়। পাশ্চাত্যের শিক্ষালয়গুলি থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা একটা চরিত্র নিয়ে বের হয় আর প্রাচ্যের ছাত্র-ছাত্রীরা চরিত্রহীন হয়ে বের হয়। এরা যখন সরকারি, বেসরকারি চাকরিতে যোগ দেয়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব লাভ করে তখন স্বভাবতই প্রাচ্য-পাশ্চাত্য কোন আদর্শ দিয়েই পারিচালিত হয় না। রাষ্ট্রের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের ওপরে স্থান দেওয়ার পাশ্চাত্য শিক্ষা পায়নি বলে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেও নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে। অন্যদিকে ইসলামের শিক্ষা পায়নি বলে ঘুষ খায়, মিথ্যা বলে, ইসলামের যা কিছু আছে তার বিরুদ্ধাচারণ করে। কাজেই পাশ্চাত্য যা করে সফল, প্রাচ্য তাই করতে যেয়ে ব্যর্থ।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা প্রভুরা শিখিয়েছে শিল্পায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করতে হবে, আমরা অত্যন্ত মহানুভব, আমার টাকা আমরা ধার দেব, তোমরা কল-কারখানা স্থাপন শুরু করে দাও। পাশ্চাত্যের বিগত প্রভুদের এই মহানুভবতার আসল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক অধিকার ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেও প্রাচ্যের জাতিগুলির গলায় ঋণের সোনার শেকল পড়িয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অর্থনৈতিক দাস বানিয়ে রাখা। কিন্তু প্রাচ্যের জাতিগুলি যদি ঐ ঋণের পূর্ণ সদ্ব্যŸহার করতে পারতো তবুও কিছুটা অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারত। কিন্তু সেটাও করা সম্ভব হয় নি। প্রথম কারণ, অন্ধ অনুকরণকারী প্রাচ্যের নেতৃত্ব স্বাধীনতা পাবার পর কেরানি সৃষ্টিকারী শিক্ষাব্যবস্থা বদলিয়ে চরিত্র সৃষ্টিকারী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেননি।
একই জীবনদর্শন অনুসরণ করেও পাশ্চাত্যের উন্নতির গ্রাফ কেন ঊর্ধ্বমুখী আর আমাদেরটা কেন নিম্নমুখী- এর আরো কিছু কারণ আছে, কিন্তু লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় থামছি। সারকথা এই যে, আমাদের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে যে শিক্ষিত দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠীটি তারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি শিক্ষাব্যবস্থার প্রোডাক্ট। একদিকে আমরা সেই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন পয়দা করে যাচ্ছি, আর যখনই তারা কোনো দুর্নীতির লঙ্কাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তখন তাদেরকে বনখেকো, ভূমিখেকো, দুর্নীতিবাজ বলে ধিক্কার দিচ্ছি। বিষবৃক্ষ বিষফল দিচ্ছে, আমরা সেই বৃক্ষকেই সযত্নে লালন করছি আর বিষফলকে দোষারোপ করছি। কিন্তু এসব দুর্নীতিবাজ শিক্ষিত শ্রেণির অপকর্মের দায় আমাদেরকেও নিতে হবে। তাই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, আনার উপায় নেই বলে এসব অর্থহীন আহাজারি আর টকশোর টেবিলে ঝড় তোলা বন্ধ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানো উচিত। এই শিক্ষাব্যবস্থাই মানুষের সামনে গাড়িঘোড়ায় চড়াকে অর্থাৎ যে কোনো প্রকারে জীবনমানের উন্নয়নকে মনুষ্যজীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর কিছুতেই সে সন্তুষ্ট নয়। পৃথিবীর সকল সম্পদও যখন তাদের সম্পদের ক্ষুধা মেটাতে অক্ষম, সেখানে ছোট্ট একটা বাংলাদেশের সামান্য সম্পদ গিলে তাদের আর কতটুকুই বা পেট ভরবে?
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৭১১-৫৭১৫৮১,]