Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / গাজার মৃত্যুপুরীতে ফ্যাকাশে ঈদ - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

গাজার মৃত্যুপুরীতে ফ্যাকাশে ঈদ

March 31, 2025 11:03:26 PM   অনলাইন ডেস্ক
গাজার মৃত্যুপুরীতে ফ্যাকাশে ঈদ

হাসান মাহ্দী:
ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ, আর এর শাব্দিক অর্থ হলো বারবার ফিরে আসা। এ দিনটি প্রতি বছর পুনরায় ফিরে আসে, তাই একে ঈদ বলা হয়। আল্লাহ তা’আলা এ দিনকে তাঁর বান্দাদের জন্য বিশেষ অনুগ্রহ ও নেয়ামতের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তিনি তাদের প্রতি দয়া করে বারবার নি'আমাত দান করেন এবং ইহসান করেন। রমজান মাসে সারাদিন পানাহার ও অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার পর, ঈদের দিনে পানাহার ও বৈধ আনন্দের অনুমতি প্রদান করা হয়, এদিন সওম (রোজা) রাখাও নিষিদ্ধ মুসলমানদের জন্য। মুসলমানরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করে এদিনে, যা রমজানের ঈদ নামে পরিচিত। শাওয়াল মাসের ১ তারিখে পালিত এই আনন্দঘন দিনে মুসলিমরা একত্রিত হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে, পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবং দরিদ্রদের জন্য সদকাতুল ফিতর প্রদান করে, জন্য এদিন ঈদুল ফিতর নামেও অভিহিত। ঈদ শুধু আনন্দের দিন নয়, এটি ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও উদারতারও প্রতীক।

এটি ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকল মুসলিমের জন্য খুশির বার্তা বয়ে আনে। কিন্তু গাজা উপত্যকায় নেই ঈদের কোনো আনন্দ, শুধুই শোকের করুণ ছায়া। আঠারো মাস ধরে ইসরায়েলের নির্মম হামলা খামেনি আজও, প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর বিভীষিকা গ্রাস করছে ফিলিস্তিনিদের। যেখানে জীবন প্রতিদিন ধ্বংসের মুখোমুখি, সেখানে স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন দেখাই বৃথা। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম যখন ঈদের উল্লাসে মাতোয়ারা, গাজাবাসীর জন্য এটি শুধুই বেদনার আরেক নাম। নতুন জামা কেনা কিংবা সুস্বাদু খাবারের আয়োজন-এসব তাদের কাছে এখন স্বপ্নের মতো অদৃশ্য। অনেক পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে, ত্রাণের সামান্য রেশনই যাদের শেষ ভরসা। কিন্তু ইসরায়েল এখন সেটিও বন্ধ করে দিয়ে, ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখে ঠেলে দিয়েছে পচা আবর্জনা। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা প্রিয়জনদের আর্তনাদ, মৃত্যুভয়ে কাঁপতে কাঁপতে স্রষ্টার নাম স্মরণ- এই হলো গাজাবাসীর ঈদের বাস্তবতা। ইসরায়েলের বর্বরোচিত আগ্রাসন আজ এক অস্তিত্ব সংকটের যুদ্ধে রূপ নিয়েছে, যেখানে টিকে থাকাই এক অসম লড়াই।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত ৬২,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। হাজার হাজার মানুষ এখন ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। এছাড়া ১৯ জানুয়ারি কার্যকর হওয়া এক অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির পর সেটিও লঙ্ঘন করে ইসরাইলি সেনাবাহিনী রোজার মধ্যেই আবার গাজায় বিমান হামলা শুরু করে। এই হামলায় এখন পর্যন্ত ৮৩০ জন নিহত হয়েছে। এমনকি ইসরায়েলের বর্বরতা মৃতদেরও রেহাই দিচ্ছে না-গোরস্থান ধ্বংস করে সমাধি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে। ঈদের দিনেও থেমে থাকেনি ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ড। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের দিন ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় ৯ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে পাঁচজন শিশু।

এছাড়া গাজায় ১৯ লাখ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত, অনেকেই একাধিকবার তাদের বাসস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। গাজার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে চলমান আগ্রাসনে ইসরায়েলি বাহিনী ২,০০,০০০-এর বেশি বাড়িঘর ধ্বংস করেছে এবং আরও ১,০০,০০০ বাড়ি গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গাজায় প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিসংখ্যান আমাদের অনুভূতিকে অবশ করে দিতে পারে, কিন্তু এর গভীরে রয়েছে একটি নির্মম বাস্তবতা। এই মানবসৃষ্ট সংকটকে ইসরায়েল আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। সম্প্রতি তারা মানবিক সহায়তা আটকে দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ অমান্য করছে। গাজায় ইসরায়েল খাদ্য, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানির প্রবেশ প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে, ফলে ৯০% গাজার মানুষ চরম খাদ্যসংকটে ভুগছে।

একদিকে বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহ ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা, অন্যদিকে গাজায় ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে ঈদের সব আশা-আনন্দ। গাজার ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের হামলায় ১,২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ৮৩৪টি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, আর ২৭৫টি এতটাই ক্ষতিগ্রপ্ত যে সেখানে নামাজ পড়ার কোনো উপায় নেই। ঈদের নামাজ আদায়ের জায়গা পর্যন্ত হারিয়েছে গাজাবাসী-এ কেমন ঈদ? এমতবস্থায় আরব বিশ্বের ভজামি এই মুহূর্তে আরও স্পষ্ট। একদিকে তারা ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করছে, অন্যদিকে শুধু মুখে মুখে নিন্দা জানিয়ে নিজেদের দায় এড়াচ্ছে। ঈদের অন্যতম শিক্ষা হলো ভ্রাতৃত্ব কিন্তু গাজার মুসলিমদের বেলায় যেন সব শিক্ষাই পদদলিত। যখন ফিলিস্তিনিরা ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে ঈদ কাটাচ্ছে, তখন মুসলিম নেতারা বিলাসবহুল ঈদ আয়োজনে ব্যস্ত। গাজায় ঈদ মানে ক্ষুধার্ত শিশুর চোখে অশ্রু, বিধ্বস্ত বাড়ির ধুলোয় মিশে যাওয়া ঈদের নতুন জামা, আর ধ্বংসস্তূপের নিচে ফেলে আসা প্রিয়জনের স্মৃতি। এই ঈদ তাদের জন্য আনন্দ নয় বরং অস্তিত্বের লড়াই। অথচ মুসলিম বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা দেখে মনে হয়, গাজার আর্তনাদগুলো যেন কারও কানেই পৌঁছাচ্ছে না।

এর বাইরে পশ্চিমা বিশ্বের নগ্ন ভণ্ডামি তো আছেই। তাদের এই সিলেক্টিভ মোরালিটি (selective morality) আজ আর লুকানোর জায়গা নেই। যারা মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক আইনের মোড়কে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে। ইসরায়েলকে অস্ত্র, অর্থ ও রাজনৈতিক ছাড়পত্র দিয়ে ফিলিস্তিনি নিধনে সরাসরি সহায়তা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলো ইসরায়েলকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মারাত্মক অস্ত্র সরবরাহ করছে। অথচ মুখে মুখে তারা "শান্তির পক্ষে" বলে বুলি আওড়ায়! তাছাড়া, তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া যেন এক কল্পিত বাস্তবতা তৈরি করেছে- যেখানে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য সংগ্রামকে "সন্ত্রাস" বলে চিত্রিত করা হয়, আর ইসরায়েলের বর্বর হামলাকে "আত্মরক্ষার অধিকার" বলে সাজানো হয়। গাজার শিশুদের রক্ত যখন রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে তখন তা "সংঘাতের দুর্ভাগ্যজনক ফল" বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ আন্তর্জাতিক আদালত ইতোমধ্যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে "গণহত্যার সম্ভাব্য অভিযোগ" হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এই নিষ্ঠুর দ্বিচারিতা কি সত্যিই বিশ্ব দেখছে না, নাকি ক্ষমতার জোরে ন্যায়বিচারকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে? আজ যদি ফিলিস্তিনের মাটিতে এই অন্যায় মেনে নেওয়া হয়, তবে আগামীকাল আপনাদের ওপরও একই নৃশংসতা চাপিয়ে দেয়া হবে না তার কি গ্যারান্টি? গাজার সংকট কোনো সাধারণ সংঘাত নয়-এটি ১৮ বছরের নির্মম অবরোধ, যা পর্যায়ক্রমে গণহত্যায় রূপ নিয়েছে। একে "জটিল সংঘাত" বলে আখ্যায়িত করা আসলে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধকে বৈধতা দেওয়ার কূটচাল মাত্র। সমাধান স্পষ্ট: অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, অবরোধ প্রত্যাহার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- কে এগিয়ে আসবে? এই জাতি যে আজ হাজারো ভাগে বিভক্ত। মুসলিম বিশ্ব কেন এমন নেতৃত্বশূন্য? কোথায় সেই সাহসী নেতা, যিনি জাতির বিভেদ ভুলে সমগ্র উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করবেন? যিনি শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য আপোসহীন কণ্ঠস্বর হবেন? ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম জাতি কখনই নেতৃত্বের অভাবে পড়েনি। বিপুল জনসংখ্যা ও সম্পদের অধিকারী বহুধাবিভক্ত জাতির (আসলে একটি জনসংখা মাত্র) আজ প্রয়োজন একজন দূরদর্শী, অকুতোভয় নেতা- যিনি নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। ন্যায় ও সত্যের মাধ্যমে দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন।