Date: May 19, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / জাতীয় ও বৈশ্বিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায় - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

জাতীয় ও বৈশ্বিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায়

March 17, 2023 05:42:34 PM   সম্পাদকীয়
জাতীয় ও বৈশ্বিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায়

রিয়াদুল হাসান
সমস্ত পৃথিবী আজ এক সাংঘাতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ-রক্তপাত, খুন, ধর্ষণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি সংকট- সব মিলিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের পর বহু রাষ্ট্রনায়ক, সেনানায়ক ও নিরাপত্তা-বিশ্লেষক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে- এ হামলার মধ্য দিয়েই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। অস্ত্রব্যবসায়ী দেশগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে নিদারুণ বিপর্যয়ের মুখোমুখী হতে হচ্ছে। চলমান বিশ্বসংকটের জালে আমাদেরকেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতে হচ্ছে, কারণ আমরাও নানাভাবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত।
১৯৭১ সালে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পার হওয়ার পরও এখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পায়তারা চলছে। একদিকে বিভিন্ন মতাদর্শের উপর গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে হানাহানি ও ক্ষমতা দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা; অন্যদিকে ধর্মকে ব্যবহার করে চলছে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী গোষ্ঠীর পেশিশক্তির মহড়া, রমরমা ধর্মব্যবসা, গুজব ও হুজুগনির্ভর ধর্মীয় উন্মাদনার তাণ্ডব। মোটকথা বর্তমানে বিশ্বের সকল সমাজের ধর্মীয় রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি স্মরণকালের ভয়াবহতম সংকটকাল ও যুগসন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনও সমাজের কল্যাণ চান, স্থিতিশীল পরিবেশ ও শান্তি চান, কিন্তু তারা নানারকম চিন্তায়, বাদ-মতবাদের দ্বন্দ্বে আক্রান্ত এবং ধর্মীয়ভাবে হাজারো ফেরকা মাজহাব তরিকায় খণ্ডবিখণ্ড, তারা ঐক্যবদ্ধ নন। এ কারণে কোনো সংকটের স্থায়ী সমাধানেই তারা পৌঁছতে পারেন না। নানামুখী চাপে শান্তিকামী মানুষ আজ দিশেহারা!
কোন পথে গেলে মানুষ অকল্যাণে, যুদ্ধ ও রক্তপাতে পতিত হবে, এটা তিনিই ভালো জানবেন যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন (সূরা মুলক ১৪)। তাই আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলের (সা.) মাধ্যমে যে দীন বা জীবনব্যবস্থা প্রেরণ করলেন তার লক্ষ্যই ছিল শরিয়ত ও মারেফতের সমন্বয়ে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত মানুষ যেন ন্যায়, সুবিচার, শান্তিতে থাকতে পারে সেজন্য ভারসাম্যপূর্ণ একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান (দীনুল ইসলাম) প্রণয়ন। সেই জীবনব্যবস্থাকে অনুসরণ করেই এক সময় আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হয়েছিলাম। অথচ আজ আমরা জাতীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও বিচারিক জীবন থেকে বাদ দেওয়ার দরুনই হাজারো সঙ্কটে পতিত হচ্ছি। আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে আমরা যখন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর কাছে সামরিকভাবে পরাজিত হয়েছিলাম, তখন তারা দুশ বছর আমাদের ওপর শাসন শোষণ চালিয়েছে। তাদের আইন, বিধান, আমলাতন্ত্র, শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। আজও আমরা সেই বিধি-ব্যবস্থা দিয়ে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। তাদের তৈরি সুদের অর্থনীতি ও ঋণের জালে আটকে গেছি। এখন তারা পরোক্ষভাবে আমাদেরকে আগের চাইতেও বেশি শাসন ও শোষণ করে যাচ্ছে।
এখন এ সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে, সমস্ত জনগোষ্ঠীকে যে কোনো মূল্যে আল্লাহপ্রদত্ত মহান আদর্শের ভিত্তিতে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সে আদর্শটি কী? এক কথায় সেটি হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া দীনুল হক, সত্য জীবনব্যবস্থা অর্থাৎ ইসলাম। এই জীবনব্যবস্থা দিয়েই দেড় হাজার বছর পূর্বে আল্লাহর শেষ রসুল মোহাম্মদ (সা.) অর্ধ পৃথিবীর মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা সর্বপ্রকার সংকট দূর করেছিলেন। অজ্ঞানতার যুগে আরব সমাজে গোত্রে গোত্রে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সুদি কারবার, চুরি-ডাকাতি, নারী-নির্যাতন, দাসপ্রথাসহ যাবতীয় অন্যায় চরম আকার ধারণ করেছিল। এ পরিস্থিতিতে আল্লাহ মহানবীকে (সা.) মানুষের দুর্দশা দূর করার উপায় ও পারলৌকিক মুক্তির পথ প্রদর্শন করলেন। সেটি হচ্ছে মানবজাতিকে আল্লাহর তৈরি জীবনব্যবস্থা মেনে চলতে হবে যার ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ তওহীদ। কলেমায়- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.), অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম-বিধান ছাড়া আর কারো হুকুম মানি না এবং মোহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রসুল। এ ঘোষণার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাকই তিনি মানবজাতিকে দিয়েছেন।
এই তওহীদের আহ্বান করার সাথে সাথেই আরবের গোত্রপতি ও ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়াতে শুরু করল। তাদের হাতে অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করে নবগঠিত জাতির সঙ্গে একদেহ একপ্রাণ হয়ে মানুষের মুক্তির জন্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম, কোরবানি ও শাহাদাতের বিনিময়ে আরব উপদ্বীপে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হল। 
ফলে সমগ্র আরব উপদ্বীপে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জীবন-সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সালাত, যাকাত, হজ, সওম ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে মো’মেনদের ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, আত্মিক পরিশুদ্ধি, দানশীলতা, পবিত্রতা, তাকওয়া অর্জন ইত্যাদির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হল। নব্যুয়তের প্রথম ২৩ বছরে সমগ্র আরবে ও পরবর্তী ৬০/৭০ বছরে অর্ধ পৃথিবীতে এই অনাবিল শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল। মাত্র এক শতাব্দির ব্যবধানে পৃথিবীর সবচেয়ে অবজ্ঞাত, মূর্খ, অশিক্ষিত, বিশৃঙ্খল, ঐক্যহীন জনগোষ্ঠীটি শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, সামরিক শক্তিতে, ঐক্যে, শৃঙ্খলায়, আত্মিক পবিত্রতায়, নতুন নতুন ভূখণ্ড বিজয়ে, ন্যায়ের শাসনে পৃথিবীর সকল জাতির শিক্ষকের আসনে আসীন হয়েছিল। উম্মতে মোহাম্মদীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর হিম্মত কারো ছিল না। তৎকালীন দুইটি বিশ্বশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য নবগঠিত মুসলিম জাতির সামনে তুলোর মত উড়ে গিয়েছিল। 
প্রশ্ন হতে পারে, কোন মন্ত্রবলে তারা বিশ্বের সেরা জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন? উত্তর হচ্ছে, তারা সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। গোটা জাতি নিজেদের জীবন-সম্পদ সমস্ত কিছু আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করে সংগ্রাম করে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেন মানুষ শান্তি পায়। দীনকে বিজয়ী করাই ছিল তাঁদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাদের এই অভূতপূর্ব বিজয়ের ফলেই সম্ভব হয়েছিল ইসলামের সোনালি যুগ প্রতিষ্ঠা। দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস হচ্ছে, আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর হাতে গড়া জাতিটির সকল সদস্য একে একে চলে যাওয়ার পর আবার শয়তানের চক্রান্ত শুরু হল। একটা পর্যায়ে জাতির আকিদায় বিকৃতি প্রবেশ করল। সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার যে মহান লক্ষ্য নিয়ে রসুলাল্লাহ (সা.) জাতিটি গঠন করেছিলেন, পরবর্তীতে সে লক্ষ্য জাতির সামনে থেকে হারিয়ে গেল। 
জাতির শাসকরা মহান খলিফাদের আদর্শ ত্যাগ করে, পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বাদ দিয়ে অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের মতই সীমাহীন ভোগবিলাসে ডুবে গেলেন। অর্ধ-পৃথিবী বিস্তৃত মুসলিম ভূখণ্ড বহু রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেল। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ল। এদিকে ভোগবিলাসী সুলতান ও আমিরদের সকল শরিয়া-বিরুদ্ধ অবৈধ কাজের অনুমোদন দেওয়ার জন্য সৃষ্টি হল দরবারি দুনিয়ালোভী আলেম সমাজ। আরও জন্ম নিল অতি-পণ্ডিত শ্রেণি। জাতি যখন সংগ্রাম ত্যাগ করল তখন তাদের হাতে অফুরন্ত সময় দীনের ছোটখাটো, অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক বিষয় নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, অতি বিশ্লেষণ, চুলচেরা বিশ্লেষণ, তর্ক-বাহাস, মারামারি। তাদের এ বাড়াবাড়ির পরিণামে জাতি শত শত মাজহাব, ফেরকা তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেল। আর ঐক্য ধ্বংস হলে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
প্রচণ্ড গতিশীল বিস্ফোরণমুখী জাতি গতি হারিয়ে প্রাণহীন স্থবির হয়ে গেল। সেই একপেশে ভারসাম্যহীন বিকৃত সুফিবাদ বর্তমানে পীর-মুরিদি ব্যবসায় পর্যবসিত হয়েছে। এবার শুরু হল পরাজয়ের পালা। এই সাবধান বাণী আল্লাহ কোর’আনে করেছেন- যদি তোমরা আমার রাস্তায় সংগ্রামে বের না হও, তবে অন্য জাতিকে চাপিয়ে দেব (সূরা তওবা ৩৯)। এরই মধ্যে যখন ইউরোপের খ্রিষ্টান, মোঙ্গল ও তাতারদের নির্দয় নিষ্ঠুর আক্রমণ শুরু হল তখন তা রুখবার মতো চেতনা, ঐক্য, শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব বা সাহস কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। পুরো মুসলিম বিশ্বই একটা পর্যায়ে ইউরোপের ছোট ছোট খ্রিষ্টান জাতির কাছে পরাজিত হয়ে গেল। এই কয়েক শতাব্দি জুড়ে এ জাতির ইতিহাস ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়ার ইতিহাস, বহিঃশত্রুর হাতে পরাজয়, লাঞ্ছনা ও দাসত্বের ইতিহাস। সেই দাসত্ব এখন পর্যন্ত চলছে। ফলে আজ এ জাতি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই পাশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীল; রাষ্ট্র চালানোর জন্য আইন-দণ্ডবিধি, অর্থব্যবস্থার জন্য সুদভিত্তিক পুঁজিবাদ, চিকিৎসা, তথ্য ও প্রচার-প্রযুক্তি, উচ্চশিক্ষা- এক কথায় উন্নত জীবনের জন্য আমরা পাশ্চাত্যের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। বর্তমানে এই মুসলমান নামক জাতি সংখ্যায় প্রায় ১৮০ কোটি অথচ সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮ কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু। কেউ তাদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছে না, এমনকি অনেক মুসলিম দেশও তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে না। সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো মিথ্যা অজুহাতে একের পর এক তাদের দেশগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। নির্মমভাবে গণহত্যা করা হচ্ছে। পৃথিবীর যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই মুসলিমদের করুণ দুর্দশা চোখে পড়ে। 
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘাতের কারণ:
প্রায় তিন শতাব্দি আগে যখন আমাদের এই উপমহাদেশ ব্রিটিশের উপনিবেশে পরিণত হয় তখন তারা এখানে নিজেদের তৈরি ব্যবস্থা দিয়ে শাসন ও শোষণ করতে থাকে। তাদের শোষণে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ এ অঞ্চল দুর্ভিক্ষপীড়িত হতদরিদ্র ভিক্ষুকের দেশে পরিণত হয়। তারা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে স্থায়িভাবে পদানত করে রাখার পরিকল্পনা করে। জাতি যেন কোনোদিন ইসলামের আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে সেজন্য তারা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় দীর্ঘ ১৪৬ বছর ধরে খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের তৈরি সিলেবাস ও কারিকুলাম দিয়ে একাদিক্রমে ২৭ জন খ্রিষ্টান পণ্ডিত অধ্যক্ষপদে থেকে সেই বিকৃত, বিপরীতমুখী, অপূর্ণাঙ্গ ইসলাম এ জাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন। সে সিলেবাসে জাতীয় জীবনের অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত করে ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি মাসলা-মাসায়েল, দোয়া-কালাম, আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যে বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা হয়েছে, জাতির মধ্যে মাজহাব ও ফেরকাগত বিভক্তি সৃষ্টি করে সেগুলো এই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদর মনে মগজে গেড়ে দেওয়া হল, যাতে তারা আর কোনোদিনও ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। এসব মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে আসা শ্রেণিটি- যাদেরকে আমরা আলেম মওলানা বলে সম্মান করি, তারা কিন্তু ওয়াজের মাঠে, মসজিদে বিভিন্ন ছোটখাটো বিষয়ের মাসলা-মাসায়েল নিয়ে ফেরকা মাজহাবের কূটতর্কে লিপ্ত হয়ে আছেন। 
এক আলেম আরেক আলেমকে অবমূল্যায়ন করেন, কাফের মুরতাদ ফতোয়া দেন, গালিগালাজ পর্যন্ত করেন, আরেক মতাদর্শের অনুসারীদের উপর হামলার উস্কানি দেন, হুঙ্কার দেন, ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিদেরকে উত্তেজিত করেন, অপ্রয়োজনীয় অনর্থক বিষয় নিয়ে একে অপরের সঙ্গে বাহাস করেন। এসবের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মুসলিম জাতি আরো নতুন নতুন ভাগে বিভক্ত হয়ে চলেছে। অথচ তাদের দায়িত্ব ছিল জাতিকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে আল্লাহর দেওয়া দীনুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহর হুকুম-বিধান মোতাবেক জাতিকে পরিচালিত করা; দুনিয়ার অপরাপর জাতির থেকে মুসলমানদেরকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে এক কথায় সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করা। কিন্তু বাস্তবে সেটা তো তারা করছেনই না, উল্টো তারা নিজেদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার জন্য নানা উপায়ে দীনকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করে চলেছেন, এক কথায় ধর্মব্যবসা করে যাচ্ছেন। এই যে তারা পরনির্ভরশীল একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছেন, কারণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তাদেরকে এই অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশদের তৈরি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্মমুখী বা প্রযুক্তিগত (ঠড়পধঃরড়হধষ) কোনো শিক্ষা দেওয়া হয়নি। এটা ছিল তাদেরকে সাহসহীন, পরনির্ভরশীল একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার বৃটিশদের একটি সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত। অপরদিকে সাধারণ সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি তাদের পূর্বতন প্রভুদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সরকার ব্যবস্থার অন্ধ অনুসরণ করে হাজারো দল-উপদলে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে আছে। তারাও একে অপরের কার্যালয়ে হামলা চালায়, ভাঙচুর করে, প্রতিপক্ষকে জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করে, পিটিয়ে মারে, পরস্পরের উপর প্রতিশোধ নিতে দেশের সম্পদ ধ্বংস করে। গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে পশ্চিমাদের থেকে ধার করা বিভেদেপূর্ণ রাজনীতি আমাদেরকে একদিনের জন্যও ঐক্যবদ্ধ থাকতে দেয়নি। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকগুলোকে মুসলমানের সন্তান হিসাবে কোর’আন হাদিস থেকে ন্যূনতম নৈতিক শিক্ষাও দেওয়া হয়নি। উপরন্তু তাদেরকে ভোগবিলাসী জীবনের জন্য অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। তারা হয়ে উঠেছে মানবতাহীন, দেশপ্রেমহীন, চরম দুর্নীতিপরায়ণ। স্বদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিতে তাদের বুক কাঁপে না। এর নেপথ্য কারণও সেই ব্রিটিশদের তৈরি করা বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা।
এ অবস্থায় সামাজিক বিপর্যয় হচ্ছে, দুর্ভি¶ বাড়ছে, বাড়ছে রাজনৈতিক উত্থান পতন। ফলে সামাজিক অপরাধ আরো বাড়বে, নিরাপত্তাহীনতা আরো বাড়বে, বৈদেশিক নির্ভরশীলতা ও খবরদারি আরও বাড়বে। সিরিয়ায় আফগানিস্তানে ক্ষুধার জ্বালায় সন্তান বিক্রি করে দিচ্ছে মায়েরা। আমাদেরকেও এমন অবর্ণনীয় অমানবিক দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে। বলা যায়, আমরা জনগণ যদি উদাসীন হয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকি তাহলে কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। যদি না দেশের সকল মানুষ সম্মিলিতভাবে এ পরিণতি থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় অনুসন্ধান ও কার্যকর পদক্ষেপ না নেই। 
এখন এই পরিস্থিতিতে আমাদের মুক্তির পথ কী?
আসন্ন মহাসংকট থেকে বাঁচতে একটি সম্মিলিত উদ্যোগ লাগবে। তাই আমাদেরকে আল্লাহপ্রদত্ত সেই তওহীদ ভিত্তিক সত্যদীন, জীবনব্যবস্থা আবার জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আল্লাহর রসুল (সা.) যেভাবে জাতিটিকে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই আমাদেরকেও সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে একজন নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। 
ঐক্যবদ্ধ হব কীসের ভিত্তিতে?
রসুল (সা.) বলেছেন, ইসলামের বুনিয়াদ ৫টি; (১) ‘তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম বিধান মানি না’ - এ সাক্ষ্য প্রদান করা। ২) সালাহ কায়েম করা। (৩) যাকাত প্রদান করা। (৪) হজ পালন করা। (৫) সওম পালন করা।
বুনিয়াদি পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে প্রথমটি অর্থাৎ তওহীদ হচ্ছে দীনের ভিত্তি। বাকিগুলো হচ্ছে মো’মেনের চরিত্র সৃষ্টির আমল। কিন্তু এই দীনটি তো প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ৫টি। ১) তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হও (ঐক্য), ২) নেতার আদেশ শোনো (শৃঙ্খলা), ৩) নেতার হুকুম পালন করো (আনুগত্য), ৪) সকল অন্যায় থেকে পৃথক হও (হিজরত), ৫) জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে সংগ্রাম (জেহাদ)।
এই ৫ দফা কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে একটি জাতিসত্তা যখন তৈরি হবে তখন তারা হবে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ। তারা সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে দিবে। যার ফলে পৃথিবীময় ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১০০৫০২৫]