
চকরিয়া সংবাদদাতা, কক্সবাজার:
কক্সবাজারের চকরিয়ায় পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষের আগ্রাসন প্রতিবছরই ভয়াবহ আকারে বেড়ে চলছে। দুইযুগ আগেও এখানে তামাক চাষের বিস্তৃতি এতটা না হলেও বর্তমানে টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর লাগামহীন প্রলোভনের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে কৃষকরা অনেকটা প্রতিযোগিতামূলক সিস্টেমে বাড়িয়ে দিয়েছে তামাক চাষের পরিধি।
এ প্রেক্ষাপটে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তামাকের চাষ বেড়েছে কয়েকগুণ। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের স্বনির্ভর জনপদ চকরিয়ায় তামাক চাষের ভয়াবহতা রুখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কিংবা পরিবেশবাদী কেউ নেই। এ অবস্থায় দিন দিন কমে যাচ্ছে কৃষি জমি। এতে করে অদূর ভবিষ্যতে চকরিয়া উপজেলাজুড়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের বির্পযয়ের আশঙ্কা করছেন কৃষি কর্মকর্তাসহ পরিবেশ সচেতন মহল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তামাকের ভয়াবহ আগ্রাসন ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি জমির ছাড়াও মাতামুহুরী নদীর জেগে ওঠা চর, দুই তীরের পরিত্যক্ত জমি, সরকারি খাস জমি এবং কয়েকটি ইউনিয়নে বনবিভাগের পাহাড়ি টিলা এবং সমতল ভূমিতে হচ্ছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ। এতে একদিকে বোরো ধান, রবিশস্য, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল খাদ্যশস্য উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি উৎপাদিত তামাক শোধন করতে গিয়ে প্রতিবছর উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
সরজমিনে উপজেলার তামাক চাষপ্রবণ কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। এসব ইউনিয়নের সিংহভাগ ফসলি জমি গিলে খাচ্ছে তামাক চাষ। বিশেষ করে উপজেলার বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, ফাঁসিয়াখালী, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী ইউনিয়নে তামাক চাষ এবছরও বেড়েছে। তন্মধ্যে ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে পাহাড়ি জনপদ বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর ও কাকারা ইউনিয়নে। এই তিন ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বহমান মাতামুহুরী নদীর দুই তীর ছাড়াও পাহাড়ি টিলা ও সমতল ভূমির অন্তত ৮০ শতাংশ তামাক চাষ করা হয়েছে। যদিও নদীর দুই তীর হচ্ছে সরকারি খাস জমি এবং পাহাড়ি টিলা ও সমতল ভূমি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতাভুক্ত, তবে সেই নদীর তীর, পাহাড়ি ভূমি দখলে নিয়ে এই তামাক চাষ অব্যাহত রয়েছে।
তবে উপজেলা কৃষিবিভাগ জানিয়েছে, চকরিয়া উপজেলার মাত্র ৫ ইউনিয়ন তথা বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, ফাঁসিয়াখালী ও লক্ষ্যারচরে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাক চাষ নিয়ে কৃষি বিভাগের এই জরিপে স্থান পায়নি কৈয়ারবিল, বরইতলী, খুটাখালী, চিরিঙ্গাসহ আরো কয়েকটি ইউনিয়ন।
চকরিয়া কৃষি বিভাগ জানায়, উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় প্রায় ২২ হাজার হেক্টর কৃষি জমি রয়েছে। তন্মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নে তামাক চাষ হচ্ছে ৬২০ হেক্টর ফসলি জমিতে। বাকী জমিতে বোরো ধান, রবিশস্য, রকমারী শাক-সবজির উৎপাদন হচ্ছে।
তবে কৃষি বিভাগের এই তথ্য বাস্তবের সাথে অনেক ফাঁরাক রয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন। কক্সবাজার অঞ্চলে দুইযুগের বেশি সময় ধরে তামাকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজ করছেন উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনের জরিপ মতে- চকরিয়ার ৮টি ইউনিয়নের ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি, মাতামুহুরী নদীর দুই তীর ও পাহাড়ি টিলা ও সমতল ভূমি মিলিয়ে অন্তত দুই হাজার হেক্টর জমিতে পরিবেশ ও মানুষের জীবন ধ্বংসকারী তামাক চাষ হচ্ছে।
চকরিয়া উপজেলার মধ্যে বেশি তামাক চাষ হচ্ছে সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, দীর্ঘ দুইযুগের বেশি সময় ধরে এখানে তামাকের আগ্রাসন চলছে। ইতোপূর্বে তামাক চাষিদের নিয়ে প্রশাসনের তরফ থেকে এলাকায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোম্পানিগুলোর প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে প্রান্তিক চাষিরা তামাক চাষ ছাড়তে পারছেন না। তামাক চাষ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা না হয় তাহলে, এটি চলতে থাকবে।
একইধরনের কথা জানিয়েছেন, তামাক চাষ নির্ভর দুই ইউনিয়ন যথাক্রমে বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজুরুল কাদের ও কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাহাব উদ্দিন।
সুরাজপুর মানিকপুর ও কাকারা ইউনিয়নের একাধিক তামাক চাষি বলেন, জ্বালানী হিসেবে চুলিস্নতে লাকড়ি বা কাঠ ছাড়া তামাক পেড়ানো হলে ভাল গ্রেড পাওয়া যায় না। তাই বেশি মূল্য পেতে গ্রেডের মান নিশ্চিত করতে অবশ্যই কাঠ পোড়াতে হয়। প্রতি মৌসুমে একেকটি চুলিস্নতে অন্তত ৪০ হাজার কেজি তামাক শোধন করা যায়। বিপরীতে প্রতি চুলিস্নতে ওই পরিমাণ তামাক শোধনে কাঠ পোড়াতে হয় অন্তত সাড়ে ৩ লাখ কেজি।
আর সেই জ্বালানীর ৮০ শতাংশ সংগ্রহ করতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে। অপরদিকে চুলিস্ন নির্মাণের সময় প্রতিটিতে ২০-২৫ ফুট লম্বা প্রায় ৩০টি খুঁটি ব্যবহার করা হয়। এসব খুঁটিও সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করতে হয়। ব্যবহৃত খুঁটির মধ্যে রয়েছে সেগুন, গর্জনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ এসএম নাছিম হোসেন বলেন, তামাক চাষ বন্ধ করার বিষয়ে এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে কোন বিধি-নিষেধ নেই। তবে তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করে রকমারী ফসলের আবাদে ফেরাতে প্রান্তিক কৃষকদের প্রতিনিয়ত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তামাক চাষের কুফল ও ভয়াবহতার কথা অনুধাবন করে চাষিদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রম হাতে নিতে পারে সরকার।