Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / জাতীয় / ‘তৌহিদী জনতা’ নামে হামলা: কারা করছে, কেন করা হচ্ছে? - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

‘তৌহিদী জনতা’ নামে হামলা: কারা করছে, কেন করা হচ্ছে?

January 30, 2025 05:41:23 PM   অনলাইন ডেস্ক
‘তৌহিদী জনতা’ নামে হামলা: কারা করছে, কেন করা হচ্ছে?

সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ‘তৌহিদী জনতা’ বা ‘বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের’ নামে নানা ধরনের হামলা, বিক্ষোভ ও বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া, ঢাকায় অভিনেত্রী অপু বিশ্বাসের অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান, টাঙ্গাইলে অভিনেত্রী পরীমনির শোরুম উদ্বোধন স্থগিত, চট্টগ্রামে মেহজাবীন চৌধুরীর শোরুম উদ্বোধনে প্রতিবাদ এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাজার ও দরবারে হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

এই হামলাগুলো কোথা থেকে সংগঠিত হচ্ছে, কারা এসবের পেছনে রয়েছে এবং কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না -এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

নারীদের ফুটবল ম্যাচে হামলা:

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নারীদের ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। তবে এর আগের দিনই স্থানীয় ‘বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা’ মাঠে হামলা চালিয়ে চারপাশের টিনের বেড়া ভাঙচুর করে। স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের ভাষ্য অনুযায়ী, আছরের নামাজের পর এই আক্রমণ হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়-

“মুসলমান মেয়েদের ঘরে রাখার জন্য আল্লাহ তা'আলা বলেছেন। তারা পর্দার মধ্যে থাকবেন। কিন্তু মেয়েদের এনে যুবকদের পাপাচারে লিপ্ত করা হচ্ছে। যারা এভাবে মেয়েদের ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করতে চায়, তাদের সতর্ক করছি।”

এই বক্তব্যে নারীদের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে ভবিষ্যতে নারীদের খেলা বন্ধেরও হুমকি দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায় নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করার চেষ্টাকে কেন্দ্র করে আয়োজকদের সঙ্গে 'তৌহিদী জনতা'র সংঘর্ষ হয়। এতে কয়েকজন আহত হন।

হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অমিত রায় ও থানার ওসি সুজন মিঞা জানান, "তৌহিদী জনতার" ব্যানারে সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। তবে কারা এই হামলার পেছনে আছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য দিতে পারেননি তারা।

অপু বিশ্বাসের অনুষ্ঠানে বাধা:

ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে একটি রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রিত ছিলেন চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস। তবে স্থানীয় ‘মুসল্লিদের’ আপত্তির মুখে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান তাকে ছাড়াই আয়োজন করা হয়।

কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মো. আমিরুল ইসলাম জানান- “ফেসবুকে এ নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট আসতে থাকে, যেখানে বলা হয় অপু বিশ্বাসকে আনলে বিশৃঙ্খলা হবে। বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে, রেস্টুরেন্ট মালিকদের সম্মতিতে অপু বিশ্বাসকে ছাড়াই উদ্বোধন করা হয়।”

এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। এর আগে টাঙ্গাইলে প্রসাধন কোম্পানির বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য অভিনেত্রী পরীমনির উপস্থিতি ঠেকাতে হেফাজতে ইসলাম প্রতিবাদ করে। একইভাবে চট্টগ্রামে শোরুম উদ্বোধন করতে গিয়ে মেহজাবীন চৌধুরীও বাধার মুখে পড়েছিলেন।

মাজার ও দরবারে হামলা:

বিশ্ব সূফী সংস্থা নামের একটি সংগঠন জানিয়েছে, ক্ষমতার পরিবর্তনের পর গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮০টির বেশি মাজার ও দরবারে হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

তাদের দাবি, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উসকানিতে এসব হামলা হচ্ছে, যা দেশের ঐতিহ্যবাহী সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিক স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত পদক্ষেপ।

‘তৌহিদী জনতা’ কারা?

দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার প্রশাসন সরাসরি জানিয়েছে যে, ‘তৌহিদী জনতা’ নামে সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। তবে এই গোষ্ঠী কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সদস্য কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা হয়নি।

স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, এসব বিক্ষোভে ইসলামিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত দলগুলোর কর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে।

হাকিমপুর থানার ওসি সুজন মিঞা বলেন- “ঘটনায় খেলাফত মজলিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত নুরুল হক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পরে জুবায়েরপন্থী বাবলু হাজীও আসেন। তবে এখানে নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যরাই শুধু জড়িত নন, স্থানীয় ধর্মীয় অনুভূতিতে উদ্বুদ্ধ মুসল্লিরাও ছিলেন।”

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থানার ওসি আনিছুর রহমান জানান- “এখানে চরমোনাই গ্রুপের কিছু লোকজন ছিল, জামায়াতেরও কিছু কর্মী ছিল, আবার সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ছিলেন।”

বারবার হামলা কেন?

বিভিন্ন সামাজিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন, দেশে একটি সংঘবদ্ধ ধর্মীয় উগ্রবাদী মব কালচার গড়ে উঠেছে, যা সময়ের সঙ্গে আরও বিস্তৃত হচ্ছে।

সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন- “এই ধরনের হামলা বেআইনি। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে মব থামানো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, যা আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আল মারুফ মনে করেন- "সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে, তারা এই মব সংস্কৃতির বিষয়ে কী করতে চায়। অন্যথায় এটি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।"

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন- “ইসলাম কখনোই বিশৃঙ্খলতা বা উগ্রবাদ সমর্থন করে না। যারা 'তৌহিদী জনতা' নামে এসব করছে, তারা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে।”

সরকারের ভূমিকা:

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, তারা এসব ঘটনায় কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বড় কোনো আইনি পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্রুততম সময়ে এই ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা রুখতে না পারলে এটি বাংলাদেশের সামাজিক ভারসাম্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

সামাজিক সচেতনতা, প্রশাসনিক কঠোরতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ‘তৌহিদী জনতা’ নামে সংঘটিত মব সংস্কৃতিকে দমন করা না গেলে ভবিষ্যতে আরও বড় সহিংসতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।