Date: April 29, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষিতরা ‘মানুষ’ হচ্ছেন কতটা? - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষিতরা ‘মানুষ’ হচ্ছেন কতটা?

July 01, 2023 03:46:22 PM   সম্পাদকীয়
দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষিতরা ‘মানুষ’ হচ্ছেন কতটা?

মোখলেসুর রহমান সুমন
শিক্ষাকে বলা হয়েছে জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদন্ড শরীরকে সোজা রাখে, তার চলাফেরা, গতি, মুভমেন্ট সচল-স্বাভাবিক রাখে। মেরুদণ্ডে সামান্য সমস্যা হলে স্বাভাবিক চলাফেরা, স্বাভাবিক গতি অসম্ভব। একটি জাতির ক্ষেত্রেও মেরুদণ্ডতুল্য শিক্ষা একই ভূমিকা পালন করে। জাতির চিন্তা-ভাবনা ও চেতনার বিকাশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি, অর্থনৈতিক অগগ্রতি, সততা-আদর্শ-ন্যায়ের উদ্দীপনা, আত্মমর্যাদাবোধ, দেশপ্রেম, এক কথায় একটি জাতির যত ধরনের ইতিবাচক চর্চা হতে পারে, তার সবকিছুর গোড়া শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের সমস্যা-সংকটের শেষ নেই, কিন্তু আসল মারটা আমরা খেয়েছি এখানে, শিক্ষাব্যবস্থায়। এই গোড়াতেই রয়ে গেছে বড় ধরনের গলদ। আর গলদটা আজকের নয়, সেই ঔপনিবেশিক শাসন আমলে ইংরেজরা আমাদেরকে এই গলদের মধ্যে রেখে গেছে। 
প্রত্যেকটা জিনিসের একটি লক্ষ্য থাকে, সেই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই পুরো বিষয়টি গড়ে উঠে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ দখলের পর উপলব্ধি কোরল, অল্প ক’জন ইংরেজ দিয়ে পুরো ভারত শাসন করা সম্বব নয়। তাই তাদের কিছু স্বল্প শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী জনবলের প্রয়োজন পরল। কিন্তু এরা যদি দেশপ্রেমিক হয় তাহলে ব্রিটিশের শোসন নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবে - এটাই স্বাভাবিক। তাই এই শ্রেণীটি হতে হবে স্বার্থপর, দুর্নীতিবাজ। ফলে প্রভু ব্রিটিশদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার চিন্তাও তারা করবে না। সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের শিক্ষার কারিক্যুলাম, সিলেবাস ইত্যাদি প্রবর্তন করল। এক্ষেত্রে ব্রিটিশরা শতভাগ সফলও হল, যে ধারা এখনও বহমান।
আরও লক্ষণীয় বিষয়, এখানে তারা প্রধান দুটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করল। একটি সাধারণ, অপরটি মাদ্রাসাভিত্তিক। দুই ধারার অবস্থান দুই মেরুতে। প্রথমটি থেকে যারা উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে বের হয়ে আসছেন তারা প্রচণ্ড স্বার্থপর, নীতিবিবর্জিত, আত্মকেন্দ্রিক। কথাটাতে অনেকে গোস্যা হতে পারেন, তাদের ইগোতে লাগতে পারে। কথাটাকে এভাবে না বলে যদি বলতাম ‘সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, স্বার্থপরতা’, তাহলে তাদের ইগো রক্ষা পেত, কেননা বিষয়টা কথিত ‘সমাজ’ এর উপর দিয়ে চলে যেত। যাই হোক, সত্য হলো, এই শিক্ষিত ব্যক্তিরা, অল্প শিক্ষিত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষিত, কেরানী থেকে শুরু করে সচিব-মহাসচিব, তাদের অধিকাংশই স্বার্থপরতা ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। হাতে গোনা কিছু মানুষ থাকতে পারেন, যারা ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম দিয়ে কখনও কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় না। এই যে শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত শ্রেণিটির স্বার্থপরতা, দুর্নীতি, এর মূল কারণ ওই শিক্ষাব্যবস্থা। এ শিক্ষাব্যবস্থায় দীন সম্পর্কে প্রায় কিছুই শিক্ষা দেওয়া হয় না। বরং সুদভিত্তিক অংক, ব্রিটিশ রাজা- রানির ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, গণিত, পাশ্চাত্যের ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, পাশ্চাত্য বস্তুবাদী দর্শন ইত্যাদি শিক্ষার পাশাপাশি ধর্ম সম্পর্কে, বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে একটা বিদ্বেষভাব (অ যড়ংঃরষব ধঃঃরঃঁফব) শিক্ষার্থীদের মনে প্রবেশ করানো হয়। ওখান থেকে লক্ষ লক্ষ কথিত আধুনিক শিক্ষিত লোক বের হচ্ছেন যারা চরম আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। নিজেদের বৈষয়িক উন্নতি ছাড়া আর কিছুই তারা ভাবেন না। তারা অধিকাংশই ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মকে মনে করেন সেকেলে, মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা; ধর্মকে মনে করেন কল্পকাহিনী। তারা গণিত, বিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, কলা, সাহিত্য শিখেন। তারপর সেসব বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। চাকরি পেতে গেলেও তাদেরকে এই পুঁথিগত শিক্ষার দৌড় কতটুকু তার প্রমাণ দিয়ে চাকুরি পেতে হয়। কিন্তু মানুষটি ব্যক্তি হিসেবে কতটুকু সৎ, কতটুকু দেশপ্রেমিক, কতটুকু মানবিক, কতটুকু মূল্যবোধসম্পন্ন, এর পরীক্ষা কে নেয়? একজন শিক্ষার্থী কিংবা একজন চাকুরিপ্রত্যাশী কতটুকু ‘ভালো মানুষ’, তা পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা কোথাও আছে কি? একজন সর্বোচ্চ ভালো ফলাফলকারী ব্যক্তিও যদি তার ব্যক্তিগত জীবনে অসৎ হয়, মিথ্যুক হয়, স্বার্থপর হয়, তাহলে তার হাতে সরকারের কোনো একটি চেয়ারের দায়িত্ব দেয়ার আগে, সেই চেয়ারটি ছোট হোক বা বড় হোক, দশবার চিন্তাভাবনা করতে হবে, এই ব্যবস্থাটি আছে কি? নেই। এর অবধারিত ফল এই যে, এরা পারে তো দেশটা বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে চলে যায়। এরাই দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’, এরকম কবিতা পড়িয়ে ‘ভালো মানুষ’ গড়া যাবে না। বরঞ্চ ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ী ঘোড়ায় চড়ে সে’ এই বাক্য তার আত্মায় হৃদয়ে গেঁথে গেছে।
আমাদের আরেকটা শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে মাদ্রাসাভিত্তিক। একে অবশ্য ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা না বলে বরং মসজিদ-মাদ্রাসায় ইমাম, খতিব, মোয়াজ্জিন তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা বলা উচিত। কেননা কথিত শুদ্ধ উচ্চারণে আরবি পাঠ, আর কিছু সুরা-কেরাত-মাসলা-মাসায়েলের জ্ঞানের মধ্যেই তাদের সম্পূর্ণ শিক্ষাজীবন সীমাবদ্ধ। এর বাইরে মানুষের একটি বাস্তব জীবন আছে, সেই জীবনে তাদেরকে কর্ম করতে হয়, তাদের নবী (স.), সেই নবীর সাহাবিরা, সাহাবিদের সন্তানরা, তাঁরা সবাই কর্ম করে খেয়েছে, হাত পেতে, ভিক্ষা মেগে খায় নাই, এই বোধটুকু তাদের নাই। এরা আরবি মুখস্থ করে মুখে ফেনা তুলতে তুলতে জীবনের সম্পূর্ণ শিক্ষাজীবনটুকু পাড় করে দেয়। শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করে, বাস্তব জীবনে করে খাওয়ার মতো জীবনঘনিষ্ঠ, কর্মমুখী বা ভোকেশনাল কোনো শিক্ষা তাদেরকে দেওয়া হয় নাই। উপায়ন্তর না পেয়ে যে মাদ্রাসায় তারা ‘আরবি ভাষা’ পড়তে লিখতে শিখেছে, সেই মাদ্রাসাতেই একটি চাকরির জন্য ঘুরে। কিংবা এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে সদকায়ে জারিয়ার কথা বলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে, আর নিজেরা সেখানে মুহতামিম, বড় হুজুর, ছোট হুজুর হয়। তারপর মানুষের বাড়ি ঘুরে ঘুরে একটা সন্তান হাফেজ ও আলেম হলে কী ‘ফজিলত’ হবে তা বর্ণনা করে বাচ্চা ‘কালেকশন’ করে। সেই বাচ্চাদের বাড়ি বাড়ি পাঠায় মুষ্টির চাল ও টাকা কালেকশনের জন্য। শিশুকালেই তারা শিক্ষার নামে ভিক্ষা করার দীক্ষাটা পেয়ে যায়। পরকালের সুযোগ-সুবিধা চিন্তা করে ধর্মান্ধ অভিভাবকরা আদরের সন্তানকে ‘হুজুরের কাছে আমানত’ রেখে যাওয়ার পর রাতারাতি তাদেরকে ‘মরহুম’ বানিয়ে দেয়। বাবা মা বেঁচে আছেন, এমন হাজার হাজার শিশু নিজেদেরকে এতিম পরিচয় দিয়ে টাকা কালেকশন করে হুজুরের বেতের ভয়ে। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শত শত বছরের ব্যবধানে একটি আলাদা গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেছে যারা নিজেরা কোনো কর্মের সাথে জড়িত নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে মানুষের দানের উপর নির্ভরশীল। আর এর সংখ্যাটা আমাদের দেশে কোটির কম হবে না। 
কথা হচ্ছে, এই যে সম্পূর্ণ আলাদা ও বিপরীতমুখী দুই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে চিন্তাচেতনায় ভারসাম্যহীন দুই ভিন্ন ধারার মানুষ বের হয়ে আসছে, যারা একই দেশে বাস করেও পৃথক সমাজের অধিবাসী। তাদের পৃথক জীবনদর্শন, পৃথক পোশাক-আশাক, পৃথক মূল্যবোধ। কেবল পৃথকই নয়, সাংঘর্ষিক। উভয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষিতজনেরা একে অপরের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুড়িতে লিপ্ত থাকেন, দিনকে দিন তাদের মধ্যে বিরাজিত বিদ্বেষ, অবিশ্বাসের ব্যবধান সরু নালা থেকে সাগরে পরিণত হচ্ছে। অথচ আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম হচ্ছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে জাতির মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করা। যে শিক্ষাব্যবস্থা জাতির মধ্যে বিভেদ তৈরি করে তার সংস্কার করা আশু কর্তব্য। ইংরেজরা এককালে আমাদের প্রভু ছিল। প্রভুর আসনে বসে নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য তারা আমাদেরকে যা খুশি শিখিয়েছে, যেভাবে খুশি কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু ইংরেজ চলে গেছে সেই ১৯৪৭ সালে। তাহলে আমরা কেন স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছি না? তারা যে শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে দিয়ে গেছে, তাকে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আগলে রাখতে হবে কেন? এটা কি কোর’আন, নাকি বেদবাক্য? না। আমরা তো কোর’আনের জীবনব্যবস্থাকেও অবহেলায় পরিত্যাগ করতে পেরেছি, কিন্তু ইংরেজদের ডিভাইড এন্ড রুল ষড়যন্ত্রের অংশ যে শিক্ষাব্যবস্থা, তাকে কেন পরিত্যাগ করতে পারছি না?
কাজেই এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব করা যেতে পারে, যেখানে আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয় থাকবে। শুধু ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষা দিয়ে হবে না। মানুষের দেহ যেমন আছে তেমনি আত্মা তথা বিবেকও আছে। সে বিবেকের দাবি পূরণ করার জন্য বিভিন্নভাবে এদিক ওদিক যেতে চাইবে। আবার বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে কেবল মাসলা-মাসায়েল, দোয়া কালাম, ফতোয়াবজির ইসলাম যা কেবল পরকালীন সওয়াবমুখী, সেটা দিয়েও হবে না। প্রস্তাবিত এই একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছাত্ররা এমন মানুষ হয়ে বের হবে যারা ধর্মান্ধ নয়, ধর্মবিদ্বেষী নয়, যারা প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবোধসম্পন্ন, দেশপ্রেমিক, রুচিশীল, মার্জিত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, জাগ্রতবিবেক, স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন। তারা স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, দাম্ভিক, অহঙ্কারী না হয়ে বিনীত ও নম্র  হবে, মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ হবে। প্রতিটি মানুষ হবে আলোকিত, সত্য ও ন্যায়ের ধারক। মানুষের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ তারা ঘুনাক্ষরেও চিন্তা করবে না। এমন মানুষ তৈরি করতে পারে একটি ভারসাম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা। এ ছাড়া চলমান অবক্ষয়ের কোনো সমাধান নেই।
 

[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১০০৫০২৫]