
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত 'কওমী উদ্যোক্তা সম্মেলন ২০২৫'-এ সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে নারী সাংবাদিক এমি জান্নাতকে প্রবেশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে 'অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা' উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করা হলেও, ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন একে 'তার দায় নয়' বলে মন্তব্য করেছেন।
কি ঘটেছিল সেখানে?
বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ইউএনবির সাংবাদিক এমি জান্নাত জানান, তিনি বুধবার (২৯ জানুয়ারি) বিকেল ৩টার দিকে সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে যান। কিন্তু প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে জানায়, নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
তিনি বলেন, "গেট দিয়ে ঢোকার সময় গার্ডরা বলে—আপনি তো ঢুকতে পারবেন না। কওমী, উনাদের প্রোগ্রাম। উনারা মানা করছে। ভলান্টিয়ারদের সাথে কথা বলেন, ওরা যেতে দেয় কিনা।"
এরপর আরও প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পরও তাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পরে তিনি তার অফিসকে বিষয়টি জানান এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করলে এটি ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে।
ফেসবুকে এমি জান্নাতের প্রতিক্রিয়া
ফেসবুক পোস্টে এমি জান্নাত লেখেন, "দেশের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের মধ্যে মাননীয় ধর্ম উপদেষ্টাকে শুধু ছেলেদের সেবায় কাজ করার জন্য নিয়োজিত করা হয়েছে কি না, প্রশ্ন রেখে গেলাম। যদি এটাই হয়ে থাকে, স্পষ্টত উল্লেখ করে কাজ করার অনুরোধ করছি।"
তিনি আরও বলেন, "একজন নারী সাংবাদিক বলে নিউজ কাভার করতে পারবে না, এটা কতটা দুঃখজনক এবং অবমাননাকর!"
এছাড়া আমন্ত্রণপত্রে নারী রিপোর্টারদের প্রবেশের বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ ছিল না বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
আয়োজকদের ব্যাখ্যা
সম্মেলনের আয়োজক 'কওমী উদ্যোক্তা' সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। সংগঠনটির সভাপতি রোকন রায়হান বলেন,
"আমাদের অনুষ্ঠানে নারী আসতে পারবে না, এমন কোনো নীতি আমরা বিশ্বাস করি না। এটা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু কোনো একজন দর্শকের কারণে এমনটা ঘটেছে।"
তিনি আরও দাবি করেন, "আমাদের এক স্বেচ্ছাসেবক চ্যানেল আইয়ের একজন নারী সাংবাদিককে অনুষ্ঠানে বসিয়েছেন। তাই নারী সাংবাদিকদের নিষিদ্ধ করার অভিযোগ ঠিক নয়। এটি নিছক একটি ভুল বোঝাবুঝি।"
তবে আয়োজকদের পক্ষ থেকে এও বলা হয়,
"অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা সবাই আলেম-ওলামা। হয়তো কোনো অডিয়েন্স থেকে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং নিন্দনীয়।"
ধর্ম উপদেষ্টার প্রতিক্রিয়া
ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এই ঘটনার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "আমি মাত্র এক ঘণ্টা সেখানে ছিলাম। অনেক সাংবাদিক ছিলেন, নিউজও কাভার করেছেন। আমি জানতাম না যে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। আমাকে কেউ জানায়নি বা আমি শুনিওনি।"
তিনি দাবি করেন, "রাত সাড়ে ১১টায় জানতে পারি এমি জান্নাত নামে একজন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। প্রয়োজনে আমি তার সঙ্গে কথা বলতাম, কিন্তু গভীর রাত হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।"
ধর্ম উপদেষ্টা আরও বলেন, "এই ঘটনার দায় আমার ওপর কোনোভাবেই বর্তায় না। আমি অতিথি হিসেবে গিয়েছি। সেখানে কওমী আলেমরা উদ্যোক্তা হয়ে আসছেন, এটাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখেছি।"
সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
ফেসবুকে এমি জান্নাতের পোস্টের পর দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং নারী সাংবাদিকদের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা জানান। সাংবাদিকদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—নারী সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের অধিকার কি সংকুচিত করা হচ্ছে?
এদিকে, আয়োজকদের ব্যাখ্যার পরও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। সাংবাদিকদের অনেকেই মনে করেন, ধর্ম উপদেষ্টার অনুষ্ঠানে প্রবেশে বাধা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা প্রয়োজন।
এই ঘটনার পর আয়োজকরা দুঃখ প্রকাশ করলেও নারীদের প্রবেশ নিষেধ ছিল কিনা, সে বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। আয়োজকরা বলছেন, এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, তবে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, এমি জান্নাতের অভিজ্ঞতা এবং তার ফেসবুক পোস্ট বলছে ভিন্ন কথা।
এই বিতর্ক নারী সাংবাদিকদের পেশাগত কাজের স্বাধীনতা, কওমী প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধর্মীয় অনুষঙ্গের সাথে আধুনিক কর্মক্ষেত্রের সামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এখন দেখার বিষয়—এই ইস্যুতে সরকারি পর্যায়ে কোনো তদন্ত হয় কিনা, নাকি বিষয়টি সময়ের সাথে চাপা পড়ে যায়।