মো. মোখলেছুর রহমান, সাংবাদিক ও কলামনিস্ট:
কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠী যখন আক্রান্ত হয় কিংবা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করে, তখন তারা সবার আগে ছুটে যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা প্রশাসনের কাছে। কেননা, তারা বিশ্বাস করে, প্রশাসন চাইলে যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা থামিয়ে দিতে পারে। মানুষের এই আস্থা ও বিশ্বাস যেন নষ্ট না হয়, সে জন্য প্রশাসনকে প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা বিধানে সব সময় সজাগ ও সতর্ক থাকার দায়িত্ব দিয়েছে রাষ্ট্র। যে কারণে মানুষ যখন নিশ্চিন্তে ঘুমায়, তখন পুলিশের গাড়ি টহল দিয়ে বেড়ায়। মধ্যরাতে যখন কেউ বিপদে পড়ে থানায় ফোন দেয়, তখন তাকে এই প্রশ্ন করা হয় না, এত রাতে কেন ফোন দিয়েছেন? বরং সাথে সাথে হুইসেল বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। এটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব নয় কেবল, প্রশাসন তথা রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার অপরিহার্য প্রচেষ্টা।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের বহু ঘটনায় প্রশাসনের এক ধরনের গাফিলতি প্রতীয়মান হয়। দেখা যায়, নিজেদের জানমালের আশঙ্কা করে থানা-পুলিশের সহায়তা চেয়ে বা সাধারণ ডায়রি করেও হামলা এড়াতে পারছেন না, নিরাপদ থাকতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত, গত বুধবার ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদের সদস্যদের বাড়ি-ঘরে সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা। এটি একদিনের ঝটিকা ও অপরিকল্পিত হামলা ছিল না। বরং ঈদের আগে থেকে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে হেযবুত তওহীদের ব্যাপারে অপপ্রচার চালিয়ে মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা হয়েছে। এমনকি হ্যান্ডবিলও বিতরণ করা হচ্ছে এক সপ্তাহ আগে থেকে। একটি লেবাসধারী মহল সাধারণ মানুষকে বলে আসছে, হেযবুত তওহীদের কর্মীদেরকে এলাকায় থাকতে দেয়া যাবে না, তাদেরকে উচ্ছেদ করে দিতে হবে, তাদের বাড়ি-ঘর গুড়িয়ে দিতে হবে ইত্যাদি। অতঃপর দুদিন আগে তারা সমাবেশ আহ্বান করে। পুরো ঘটনা কোন্ দিকে গড়াচ্ছে তা উপলব্ধি করার জন্য তথাকথিত “চৌকশ ও বিচক্ষণ” অফিসার হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং সাধারণ বিচার-বিবেচনাতেই বোঝা যায়, এখানে বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, এখানে যে একটি হামলার ঘটনা ঘটতে পারে সেই আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে ঘটনার আগের দিনই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন হেযবুত তওহীদের নেতাকর্মীরা। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, আমাদের সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বিষয়টিকে ততটা আমলে নেন নি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রশাসন কি তাহলে একেবারে নির্বিকার ভূমিকা পালন করেছে? তারা কি কোনো পদক্ষেপই নেয় নি? তা নয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছে, বাঁশি ফুকিয়েছে, হামলাকারীদেরকে ছত্রভঙ্গ করেছে, এক কথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু ততক্ষণে ঘটনা ঘটে গেছে। এরই মধ্যে কয়েকজন নিরপরাধ মানুষ আহত হয়েছেন, কয়েকজন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। হেযবুত তওহীর সদস্যদের একটি দোকান এবং চারটি বাড়ি প্রায় সম্পূর্ণ লুট হয়েছে। পুলিশের এই বিলম্বিত পদক্ষেপের কারণ কী তা আমাদের জানা নেই।
এ ধরনের একটি ঘটনার ভয়াবহতা কতদূর গড়াতে পারে তা প্রশাসনকে উপলব্ধি করতে হবে। নইলে সাধারণ মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানে তারা ব্যর্থ হবেন, মানুষও তাদের উপর আস্থা হারাবে। লক্ষ্য করুন, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের এই হামলায় কারা নেতৃত্ব দিয়েছে, কারা অংশ নিয়েছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনার ভিডিও ও ছবি যতটুকু পাওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে একটি ধর্মীয় উগ্রবাদী শ্রেণিই পুরো ঘটনার নেপথ্যে। এরা এমন একটি শ্রেণি যারা সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে নিয়ে খেলা করতে অভ্যস্ত। এরা কথায় কথায় মানুষকে কাফের ঘোষণা দিতে পটু। সাধারণ মানুষকে উস্কে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে দাঙ্গা সৃষ্টি করতে এরা সিদ্ধহস্ত। এদের কথায় মানুষ হৈ-হৈ, রৈ-রৈ করে একদিকে ছুটে যায়, অতঃপর ঘটনা একটি ঘটিয়ে দেয়। তা কখনো হামলা ও ভাঙচুর, আবার কখনো হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়ায়। এই সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিভীষিকা বাংলাদেশে নতুন নয় যে প্রশাসন তা আগে থেকে ঠাহর করতে পারবে না। এর আগে ২০১৪ সালে নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে হেযবুত তওহীদের কর্মীদের উপর হামলা চালিয়ে যে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল সেখানেও প্রশাসনের তড়িৎ হস্তক্ষেপের অভাব ছিল। আমরা মনে করি, ময়মনসিংহে যে ঘটনা ঘটেছে সেখানেও নোয়াখালীর পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারতো, বা এখনো ঘটতে পারে। সন্ত্রাসীদের তৎপরতা এখনো থামে নি। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে তাদের যে কোনো অঘটন ঘটিয়ে দেয়ার এই অপচেষ্টা বন্ধে আমরা প্রশাসনের সর্বোচ্চ সতর্কতা ও কঠোর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করি। শোনা যাচ্ছে, যেখানে ঘটনাস্থল হেযবুত তওহীদ সদস্যদের দোকান ও বাড়ি-ঘর, সেখানে অদৃশ্য কারণে আক্রান্ত হেযবুত তওহীদ সদস্যদেরকে উল্টো আক্রমণকারী বানানোর পাঁয়তারা চলছে। প্রশাসনের মধ্যেও যেন উগ্রবাদীদের ভুতের আসর না পরে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের সজাগ থাকা প্রয়োজন।