Date: April 29, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / ধর্মীয় দলগুলোকে ‘ব্যবহার’ করে ছুঁড়ে ফেলা হয় - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

ধর্মীয় দলগুলোকে ‘ব্যবহার’ করে ছুঁড়ে ফেলা হয়

July 01, 2023 03:56:46 PM   সম্পাদকীয়
ধর্মীয় দলগুলোকে ‘ব্যবহার’ করে ছুঁড়ে ফেলা হয়

▪ রিয়াদুল হাসান
শরিফার স্বামী রবিউল দশ বছর যাবৎ বিদেশ করে, সৌদি আরবে তেলের পাম্পে চাকরি। দুই তিন বছর পর বাড়িতে আসে। শরিফা নিঃসন্তান। স্বামীর অবর্তমানে উঠতি মাস্তান আর পাড়াতো দেবর রাজুর সাথে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠতা। তাদের অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয় পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে। এক পর্যায়ে শশুরবাড়িতে আর থাকা হয় না শরিফার। তার বাপের বাড়িও একই গ্রামে। সে বাপের বাড়ি চলে যায়। কিন্তু সেখানেও নিত্যদিন অপমান আর গঞ্জনা সহ্য করতে হয় তাকে। 
এভাবেই কেটে যায় তিন চার মাস। হঠাৎ এক বর্ষারাতের অন্ধকারে শরিফা প্রেমিক রাজুর হাত ধরে বাড়ি ছাড়ল। ছাড়ল গ্রাম। সদরে গিয়ে তারা উপস্থিত হয় কাজী অফিসে। কাজি পরিস্থিতি শুনে বলল, ‘যত মুশকিল তত আসান। যেহেতু ডিভোর্স হয় নাই, তাই খরচ সামান্য বেশি।’ রাজু তাতেই রাজি। কাজী উঠে গিয়ে রাস্তা থেকে দুটো হিরোসেবী টোকাই যুবক ধরে নিয়ে আসলো। এরাই শরিফা-রাজুর অবৈধ বিয়ের সাক্ষী। পরিবার রাজি না, ডিভোর্স হয় নাই, অবৈধ প্রেম তারপরও দুজন সাক্ষী আর কাজীর পকেটে কিছু উপরি পয়সার আগমনে সরকারি রেজিস্ট্রি হয়ে গেল। 
কিছুদিন পর রাতের অন্ধকারে নবদম্পতি আবার ফিরে আসলো নিজ গ্রামে। নতুন ঘর তুলে শুরু হল শরিফা-রাজুর সংসার। নিস্তরঙ্গ গ্রামে কিছুদিন আলোড়ন চলল তাদের বিয়ে বৈধ কি বৈধ না তা নিয়ে। এক সময় নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনাস্রোতে পুরোনো হয়ে গেল শরিফা রাজু আর রবিউলের সংসার-সংবাদ। সেই টোকাই সাক্ষীদের খোঁজ কেউই করল না। কখনও সদরে গেলে আপনি দেখবেন, এখনও তারা কাজী অফিসের সামনে ঘোরাফেরা করছে নতুন কোনো বিয়ের সাক্ষী হওয়ার জন্য। 
গ্রামেগঞ্জে এমন ঘটনা ঘটছে না, এমন কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। এমন ঘটনা বিগত কয়েকযুগ ধরে ঘটে চলেছে আমাদের জাতীয় নির্বাচনের মাঠেও। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচনকে বৈধ করতে বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণ থাকা যেমন প্রয়োজন, তেমনি সরকার গঠন করতেও বিরোধীদলের অস্তিত্ব থাকা ‘ভালো’। গণতন্ত্রের কেতাবে আছে, বিরোধীদল নাকি ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে, সরকারকে স্বৈরাচারী হতে দেয় না। তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা, অধিকার আদায়ের আন্দোলন, রাষ্ট্র পরিচালনায় বিকল্প নীতি উত্থাপন ও বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করার মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। তাই সংসদে বিরোধীদলের আসন নির্দিষ্ট করা থাকে। কিন্তু অধিবেশনের সময় সেই আসনগুলো একদম খালি রাখলে কেমন দেখায়? সংসদে তর্ক হবে, তুমুল ঝগড়া হবে, কুৎসিত অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হবে, পরস্পরকে লক্ষ্য করে ফাইল ছোঁড়া হবে, ফাইল ছেঁড়া হবে, মারামারিও হতে পারে। সেটাই হবে গণতন্ত্রের চরম সৌন্দর্য ও সম্পূর্ণতা। 
দীর্ঘদিন থেকে আমাদের দেশের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। আন্তর্জাতিক মহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে দৌড়ঝাঁপ করছে তিনবারের সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দল বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। ভোটের পাল্লা ভারি করতেই তারা অন্যান্য ছোট দল ও ধর্মীয় দলগুলোকে নিজেদের দিকে টেনে থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বিবিসির সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ধর্মভিত্তিক দলগুলো ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করে আর বড় দলগুলো এসব দলগুলোকে নিজেদের পক্ষে রেখে সেই ধর্মকেই নির্বাচনের মাঠে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সমর্থন পাবার জন্য।” এজন্য নির্বাচন এগিয়ে আসলেই তারা মূলধারার দলগুলোর উপর ভর করে। বিভিন্ন সভায় বা সামাজিক অনুষ্ঠনে তখন তাদেরকে একসঙ্গে দেখা যায়। 
২০২৩ সালের শেষ কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৮ সনের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ১১ তম সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের বড় দুটি দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জোটসহ বাংলাদেশের নিবন্ধিত সর্বমোট ৩৯টি দল অংশগ্রহণ করে। এতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরষ্কুষ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু ২০২০ সালের ১১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তৈরি প্রতিবেদনে নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে মন্তব্য করা হয়। তারপরও ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিক দল জাতীয় পার্টিকে বিরোধীদল বানিয়ে আর রওশন এরশাদকে প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী বানিয়ে সংসদে বসানো হয়। চারবছর নামেমাত্র সাংসদ থাকার পর বিএনপির সাতজন সদস্য ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গোলাপবাগ মাঠে একত্রে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। 
যদি যে কোনো পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সেক্ষেত্রে সরকার গঠন করার অপরিহার্য উপাদান বিরোধীদল কে হবে? এই শূন্যস্থান পূরনের স্বপ্ন দেখছে কিছু ছোটখাটো ইসলামী রাজনৈতিক দল যাদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ ইসলামি আন্দোলন (চরমোনাই)। বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তারা অংশও নিয়েছে এবং কোথাও জয়ী হতে পারে নি। ২০১৮ সালে অনুষ্টিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ২৯৮ আসনেই প্রার্থী দিয়েছিল চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তবে একজন বাদে বাকি সবাই জামানত হারিয়েছিলেন। 
সম্প্রতি তারা বর্তমান সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। এর কারণ বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন চলাকালে শায়খে চরমোনাই মুফতি ফয়জুল করিমকে নিয়ে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা। দুই দলের কর্মীদের ধাক্কাধাক্কির মাঝে পড়ে তার নাক ও ঠোঁটের কোনায় কেটে গিয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে তারা দেশের বহু জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন এবং সরকার পতন আন্দোলনেরও ডাক দিয়েছেন। তারা বিএনপিসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে মতবিনিময় সভা পর্যন্ত করেছে। বিএনপির পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা সব দল, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতাকে মতবিনিময় সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন। কেবল আওয়ামী লীগকে তারা আমন্ত্রণ জানায়নি। সভায় শায়েখে চরমোনাইয়ের উপর হামলার মুখর সমালোচনার পাশাপাশি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ঐকমত্য পোষণ করা হয়েছে।
কেবল ইসলামী আন্দোলনই নয়, দীর্ঘ এক দশক পর সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে জামায়াতে ইসলামী। গত ১০ জুন রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, দলের আমির শফিকুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতা ও আলেমদের মুক্তি এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে জামায়াতে ইসলামী এ সমাবেশ করছে। এর আগে পুলিশের অনুমতি নিয়ে তারা সর্বশেষ বিক্ষোভ মিছিল করেছিল ঢাকার মতিঝিলে ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে ১০ বছরের বেশি সময় পর ঢাকায় কর্মসূচি পালনের অনুমতি পেল জামায়াত। সামনে নির্বাচনে স্বতন্ত্র পদে অথবা বিভিন্ন দলীয় মার্কার আড়ালে আবডালে তাদের নেতাকর্মীদেরকেও অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হতে পারে।
নিজেদের সমমনা আলেম ওলামাদের নিয়েও আওয়ামী লীগ কর্মসূচি গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আওয়ামী ওলামা লীগ তিন দশক ধরে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের মর্যাদা চেয়ে আসছিল। সংগঠনটি বিভিন্ন সময় নারী নীতি ও শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ বক্তব্য দিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এমনকি সংগঠনটির পক্ষ থেকে পয়লা বৈশাখকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনা আওয়ামী লীগকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। এমনকি ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ বিবৃতি দিয়ে ওলামা লীগের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকার কথা বলেছিল। তবে সেই পরিস্থিতি হঠাৎই পাল্টে গেছে। ওলামা লীগের বিষয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা সংগঠনটির সম্মেলনেও অংশ নেন। গত ২৫ মে ঢাকায় ওলামা লীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি তাঁর বক্তব্যে ওলামা লীগকে দলাদলি, চাঁদাবাজিসহ অপরাধমূলক কোনো কর্মকাণ্ডে না জড়ানোরও আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক চর্চার অতীত ভালো নয়। এখানে ব্যবসায়ীরা রাজনীতির মাঠ দখল করে নিয়েছেন এবং ব্যবসার স্বার্থে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগাচ্ছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ৯০ শতাংশ সদস্য আইনের ছাত্র। বাংলাদেশের সংসদের ৮০ ভাগই ব্যবসায়ী। (প্রথম আলো, ৪ অক্টোবর)। তাদের কাছে রাজনীতিটাও একটা ব্যবসা। এ অঙ্গনে সন্ত্রাস সৃষ্টি, দুর্নীতি, ছলচাতুরি, খুন-খারাবি, ভোট ডাকাতি, জালিয়াতি ইত্যাদি আমাদের দেশে স্বীকৃত। নিজেদের স্বার্থে, দলীয় স্বার্থে এখানে সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য করা হয়। বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা হয়, প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা হয়। যারা সেক্যুলার রাজনীতি করেন তাদের এসব অন্যায় কাজে ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতা বা ইসলামের বিধিনিষেধ পরোয়া করার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যারা ইসলামের নাম দিয়ে রাজনীতি করেন, যারা দাবি করেন যে তাদেরকে ভোট দিলে আল্লাহর রসুলকে ভোট দেওয়া হবে, তাদের উপর ইসলামের নীতি মান্য করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ইসলাম এক মহান আদর্শ। এখানে ধাপ্পাবাজী চলে না, প্রতারণা চলে না। আমাদের ধর্মভিত্তিক দলের নেতারা, আলেম ওলামারা যখন সেক্যুলার দলগুলোর মতই আচরণ করছেন তখন ইসলামের সুমহান আদর্শই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাদেরকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করা হচ্ছে। অতীতে তারা অগণতান্ত্রিক অ-জনপ্রিয় স্বৈরশাসকদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছেন, ভোটারবিহীন নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়ে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। শুরুতে বলা গল্পে শরিফা-রাজুর অবৈধ বিয়েতে টোকাইদেরকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, সেভাবে কথিত গণতান্ত্রিক সেক্যুলার দলগুলো তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডে ধর্মভিত্তিক দলগুলিকে ব্যবহার করবে তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। 
 

[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১০০৫০২৫]