
জাফর আহমেদ:
আমাদের মধ্যে নবীর সুন্নতের নামে কিছু অস্পষ্টতা আছে। আমরা মনে করি দাড়ি-টুপি সুন্নত, খেজুর খাওয়া সুন্নত, আরবীয় পোশাক পরা সুন্নত ইত্যাদি। আমরা ভাবি না যে, আরবদেশে যখন জুলুম-নির্যাতন এবং জাহেলিয়াত বা মূর্খতা চরম পর্যায়ে- তখন দাড়ি-টুপি, পাগড়ি, জুব্বা পরিধানের জন্য আল্লাহ কি তার আখেরী নবীকে দায়িত্ব দিয়ে মক্কায় পাঠিয়েছেন? আরবের লোকেরা শসা, উটের দুধ, খেজুর খেতো না, মিসোয়াক করতো না, বিবির মুখে লোকমা তুলে দিতো না--- মহানবী এসে তাদেরকে এগুলো শিখিয়ে দিলেন! এগুলো কি একজন রসুলের মূল কাজ, নাকি এগুলো একজন মানুষ হিসেবে তার ব্যক্তিগত অভ্যাস? বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে।
আল্লাহ আখেরী নবীকে তাঁর নাজিলকৃত দীনুল হক প্রয়োগ করে সমাজ শান্তি, শৃংখলা এবং ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন। দীনুল হক প্রয়োগের কর্মকৌশলের মধ্যে আমরা নবীর সুন্নতকে খুঁজে পাবো। তিনি একটি Strategy/Methodology অনুসরণ করে ২৩ বছরে দীন কায়েমের সেই গধমযধ project বাস্তবায়ন করেন।
মক্কার ১৩ বছর মানব জীবনে আল্লাহর হুকুমের সার্বভৌমত্ব বা তওহীদ যারা মেনে নিয়েছে তাদেরকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করলেন। তখন মুষ্টিমেয় কিছু সাহাবী ছাড়া সাধারণ জনগণ নবীর প্রচারিত তওহীদের এর ঘোষণা দেয় নাই। মক্কার জীবনে রাসুল (সা:) একটি দল বা গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে সশস্ত্র কোনো পন্থা গ্রহণ করেন নাই। আল্লাহও তখন কোরানে সশস্ত্র জিহাদ অর্থাৎ কিতালের আয়াত নাজিল করেন নাই। আল্লাহর হুকুমে সাহাবাগণ আবিসিনিয়ায় এবং পরবর্তীতে ইয়াসরিবে হিযরত করেছেন।
ইয়াসরিবে প্রথম তিনি মসজিদ প্রতিষ্ঠা এবং জুমার সালাত কায়েম করে তার অনুসারী মুহাযের ও আনসার সাহাবীগনের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত করার পাশাপাশি সমাজে দীনুল হক প্রয়োগের একটি মসজিদ কেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস নিলেন। ইয়াসরিবের সকল বিবদমান কবিলা-গোত্র, ধর্ম-বর্ণের লোকদের সাথে সামাজিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তাহীনতা কীভাবে দূর করা যায় সে বিষয়ে বছরব্যাপী অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য ও আন্তরিক আলোচনা ও সংলাপ চালিয়ে গেলেন। ইহুদী, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক, প্রকৃতি পূজারী, কৃষিজীবী, কামার-কুমার, বণিক সবাইকে তিনি বুঝাতে সক্ষম হলেন যে, সমাজের সকলের শান্তি, শৃংখলা ও নিরাপত্তার জন্য একত্রে কাজ করা দরকার। তাঁর এই সার্বজনীন স্বার্থ রক্ষার প্রস্তাবে সবাই একমত হলো। ইয়াসরিবের ১৪ টি কবিলা ঐতিহাসিক মদীনা সনদ স্বাক্ষর করলো। শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব সনদে রূপান্তরিত হলো। সনদের মাধ্যমে ইয়াসরিবে একতা সৃষ্টি হলো। রাসুলের বিচক্ষণতা (Sagacity) থেকে নেতৃত্বের উদারতা ও বিশালতার পথ ধরে ইয়াসরিব গ্রাম হলো মদীনাতুন নবী বা নবীর নেতৃত্ব গ্রহণকারী নগরী। একটি নগর রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন হলো। এ রাষ্ট্রের সংহতি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য তিনি সুশৃঙ্খল নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তুললেন। তাদের প্রশিক্ষণ দিলেন, অস্ত্রে সজ্জিত করলেন। রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে শত্রুদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ করলেন। মাদানী সুরাগুলোতে সশস্ত্র জিহাদ অর্থাৎ হারব-কিতালের হুকুম আসলো। সমগ্র জাজিরাতুল আরবে দীনুল হকের প্রয়োগ হলো।
মক্কার ১৩ বছর এবং মদীনার ১০ বছর আখেরী নবী উবারহব মঁরফবফ যে Strategy বা রণনীতি রণ-কৌশল অনুসরণ করেছেন, তা হলো সুন্নত বা দীন কায়েমের Strategy/Methodology।
আরবের লোকেরা দাড়ি রাখতো না, মাথায় পাগড়ি বাঁধতো না, গায়ে জুব্বা চাপাতো না, মিসোয়াক করতো না, খেজুর খেতো না, ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করতো না, উটের দুধ বা লাউ খেতো না, তাসবীর দানা জপতো না, তখন বিশ্বজাহানের সৃষ্টকারী আল্লাহ মোহাম্মদ (সা.) নামে একজন নবীকে পাঠালেন তাদেরকে এসব সুন্নত শিখানোর জন্য- এটা একটি হাস্যসকর কথা চিন্তা। আখেরী নবীর বিপ্লবী জীবনকে অনুধাবনে ব্যর্থ কিছু লোকের অজ্ঞতাসূলভ বিকৃত ধারণা ছাড়া আর কিছুই না। এগুলো মরু আরবের একজন বাস্তববাদী মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাস। একজন নবী-রসুলের নবীসুলভ কাজ বা রিসালাতের কাজ নয়।
[লেখক: জাফর আহমেদ, সাবেক সচিব ও গবেষক;
যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]