
শরীয়তপুর (জাজিরা) প্রতিনিধি:
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নারীদের বাইরে বের হওয়া ঠেকাতে লাঠি মিছিল করা হয়েছে। ঈদের দিন থেকে শুরু হওয়া এই লাঠি মিছিল নিয়মিত চলবে বলে জানিয়েছে তারা। তাদের দাবি সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে পারবে না কোনো মহিলা। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ঠেকাতে ও ঈমান বাঁচাতে এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান তারা। স্থানীয় একটি দাখিল মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকের মদদে ধর্মান্ধ এক শ্রেণীর আলেম এ কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে উৎসব এলেই পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া ও বাইরে খাওয়াদাওয়া বাঙালিদের রীতিতে পরিণত হয়েছে বহুকাল থেকেই। বাঙালি মুসলিমদের সবথেকে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ। ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিতে স্বপরিববারে বাইরে বের হন অনেকেই। তবে ভিন্ন নিয়ম শুধু এই এলাকায়।
জানা যায়, এখানে সন্ধ্যার পর পরিবারের নারী সদস্যকে নিয়ে বের হওয়া যাবে না। সন্ধ্যার পরপরই নারীদের বাইরে বের হওয়া ঠেকাতে লাঠি হাতে রাস্তায় নামেন এখানকার স্থানীয় মসজিদ ও মাদ্রাসা কমিটির লোকজন। শুধু তাই নয়, কোনো দোকানে মহিলা ক্রেতা দেখলে, কিনবা সন্ধ্যার পর মহিলা ক্রেতাদের কাছে কেউ কিছু বিক্রি করলে দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে ঘোষণা না জানার ফলে সন্ধ্যার পর পরিবার নিয়ে বাইরে বের হয়ে বিপদে পড়েছেন অনেকেই। তবে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কিছু অস্থায়ী খাবারের দোকানীরা।
জানা গেছে, শরীয়তপুরের জাজিরায় তেমন কোনো দর্শনীয় স্থান নেই। উপজেলার জয়নগরে একটি দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ রয়েছে। এই ব্রিজকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ঈদেই মেলার আয়োজন করে স্থানীয় বাজার কমিটি। ব্রিজটির উপর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে আশপাশের অনেকেই স্বপরিবার ঘুরতে আসেন। তবে চলতি বছর ঈদে কোনো মেলার আয়োজন করতে দেননি স্থানীয় মাদ্রাসা সুপার মাওলানা মোহাম্মদ সেলিম।
শুধু তাই নয়, সন্ধ্যার পর মহিলা সদস্যদের ব্রিজে ওঠার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন তিনি ও নেতৃত্বে থাকা স্থানীয় ধর্মান্ধরা । সন্ধ্যা হলেই লাঠি হাতে "ইসলামের শত্রুরা, হুশিয়ার সাবধান" বলে বিশাল আকৃতির লাঠি মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হন তিনি। ব্রিজে কোনো মহিলা সদস্যকে দেখলে বিভিন্ন অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করছেন তারা। তাদের হাতে লাঠি, এবং ইসলামের দোহাই থাকায় প্রতিবাদ করেন না কেউ।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চটপটি খেতে এসে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়া নুরে আলম নামে একজন জানান, দিনে রোদের তাপ থাকায় সাধারণত আমরা বিকেলেই বের হই। মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে একটু লেইট হয়ে গেছে। আমি আমার আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে চটপটি খেতে বসেছি। দোকানদার চটপটি সামনে দিয়ে লাঠি মিছিল দেখে তা নিয়ে গেছে। এখন আমার মেয়ে চটপটি খেতে কান্না করতেছে। আমি জানতাম না যে, এখানে মেয়েদের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তাহলে হয়তো আসতামই না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক চটপটি দোকানী বলেন, আমাদের বেচাকেনা একেবারেই নেই। সন্ধ্যার পর এখানে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। মহিলাদের দেখলে বেজন্মা, বেশরম বলে মাইকে গালিগালাজ করেন মাওলানা সেলিম। এমন হলে এখানে কেউ আসবে?
স্থানীয় আরেক চটপটি দোকানীর দাবী, সারাদিন রোদ থাকায় বেচাকেনা শুরুই হয় সন্ধ্যার পর। ব্রিজটি দৃষ্টিনন্দন হওয়ার দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসে। সারাবছর অপেক্ষা করেন এই ঈদের জন্য। কিন্তু মহিলারা দোকানে বসলে দোকানে ভাঙচুর করা হবে। এই ভয়ে আমরা তাদের দোকানে বসতে দেই না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মাদ্রাসা সুপার সেলিম মাওলানাকে মুঠোফোনে কল করলে তিনি জানান, স্থানীয় দুইটি মসজিদ ও মাদ্রাসার লোকজন মিলে তারা এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ব্রিজটিতে সন্ধ্যার পর প্রচুর লোকজন হয়, তারা টিকটকসহ বিভিন্ন অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা করেন। যা ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ। আমরা তাই নিজ উদ্যোগে ঈমান বাঁচাতে স্থানীয় ঈমানদার মুসলমানেরা মহিলাদের এখানে আসা নিষেধ করেছি। প্রশাসনকে না জানিয়ে শুধুই ঈমানি দায়িত্ব থেকেই নাকি এমনটি করছেন তিনি।
তবে লাঠি হাতে মিছিলের বিষয়টি অস্বীকার করেন। এসময় গালিগালাজ ও দোকানে আগুন দেয়ার ঘোষণার বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি। তবে লাঠি হাতে মিছিলের ফুটেজ রয়েছে আমাদের কাছে বলার পরেও তিনি জানান, লাঠি ব্যাবহার আমি সমর্থন করি না। কেউ লাঠি আনলেও আমি জানি না।
স্থানীয় দোকানী ও দর্শনার্থীদের সাথে কথা বললে তারা বলেন, সন্ধ্যার পর একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয় ব্রিজটিতে। মাওলানা সেলিম নিজে এবং তার সঙ্গে থাকা শতাধিক ব্যাক্তি কোদালের আছাঁড়ি জাতীয় এক প্রকার লাঠি নিয়ে মিছিল করেন। অতিউৎসাহী হয়ে এদের মধ্যে কেউ যদি কোনো মহিলাকে আঘাত করে বসেন, তাহলে বাকিরাও করবেন। তাৎক্ষণিক ওই মাওলানা এমন ঘটনা সামাল দিতে পারবেন না। এরফলে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাছাড়া দেশে পুলিশ প্রশাসন থাকতে তারা কেনো লাঠি হাতে নিবে বলেও প্রশ্ন করেন অনেকে। নিষেধা জারীর বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে।
এ বিষয়ে জাজিরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা ইসলাম লুনা মুঠোফোনে বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানিনা। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন কোনো নির্দেশনাও দেয়া হয়নি। বিষয়টি দেখবেন বলেও জানান তিনি।