


বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রাজপথ, সর্বত্রই একটাই আলোচনা জাতীয় নির্বাচন। রাজনেতাদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ামাত্রই জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাদের ধারণা, নতুন সরকার এলেই অপরাধ কমবে, মানুষ স্বাধীনভাবে চলতে পারবে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে। কিন্তু ইতিহাসের আয়নায় এবং বাস্তবতার নিরিখে যারা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন, তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তারা প্রশ্ন তুলছেন, সত্যিই কি নির্বাচন মানুষের মুক্তির চাবিকাঠি, নাকি এটি কেবল ক্ষমতার পালাবদল মাত্র?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নির্বাচন মানেই এক দলের প্রস্থান এবং অন্য দলের আগমন, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের চাকা খুব একটা ঘোরে না। নির্বাচনকে যদি গণতন্ত্রের উৎসব বলা হয়, তবে সেই উৎসবের প্রদীপ নিভে যাওয়ার পরই শুরু হয় সাধারণ মানুষের অন্ধকারের গল্প।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অনেকগুলো সরকার পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল নতুন এক ভোরের। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলোর দিকে তাকালে আমরা কী দেখি? প্রতিবারই মানুষ বুকভরা আশা নিয়ে ভোট দিয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই বিজয়ী দল রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে নিজেদের বিত্ত-বৈভব গড়ার হাতিয়ার হিসেবে।
একটি উপমা দেওয়া যাক- কোনো একটি ভাঙা গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট, চাকা লক্কড়-ঝক্কড়। এখন আপনি যদি কেবল সেই গাড়ির ড্রাইভার পরিবর্তন করেন, গাড়িটি কি নতুনের মতো চলবে? অবশ্যই না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা সেই নষ্ট ইঞ্জিনের মতো হয়ে গেছে। নির্বাচন কেবল ড্রাইভার (সরকার) পরিবর্তন করে, কিন্তু ‘সিস্টেম’ বা ইঞ্জিন সেই পুরাতন ও জরাজীর্ণই থেকে যায়। ফলে যাত্রী বা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমে না, বরং বাড়ে।
নির্বাচন কি অর্থনৈতিক মুক্তির নিশ্চয়তা দেয়? পরিসংখ্যান কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের বোঝা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিটি শিশু জন্মের সময় প্রায় ১ লাখ টাকার বেশি ঋণের বোঝা নিয়ে জন্মায়। সিপিডি (CPD) এবং বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন খাদের কিনারে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে (আইএমএফ-এর হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত অঙ্ক আরও অনেক বেশি)।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে হাজার হাজার কোটি ডলার। কানাডার ‘বেগম পাড়া’ কিংবা মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং প্রচলিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ফসল। নির্বাচন দিয়ে এক দল ক্ষমতায় এসে আগের দলের দুর্নীতির বিচার করার বদলে নিজেরাও একই পথে হাঁটে। কারণ বর্তমান ব্যবস্থায় ক্ষমতায় যাওয়ার মূল উদ্দেশ্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘লুণ্ঠনতন্ত্র’ কায়েম করা। নির্বাচন তাই লুটেরাদের হাতবদল ছাড়া আর কিছুই উপহার দিতে পারছে না।
নির্বাচনের মাধ্যমে কি মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়? অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতা বাড়ে। মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ (আসক)-এর পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম এবং রাজনৈতিক দাঙ্গায় মৃত্যুর মিছিল কেবল দীর্ঘই হয়েছে। পুলিশ এবং প্রশাসনকে রাজনীতিকরণ করার ফলে তারা জনগণের সেবকের পরিবর্তে দলীয় লাঠিয়ালে পরিণত হয়েছে। সাধারণ অপরাধের চিত্রও ভয়াবহ। হোমিসাইড রেট প্রতি লাখে ২.২-২.৫ এর আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে বছরের পর বছর। ২০২৪-২৫ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর খুন, ডাকাতি, ছিনতাই বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। জানুয়ারি ২০২৫-এ এক মাসে ২৯৪টি খুনের মামলা, যা আগের বছরের চেয়ে অনেক বেশি।
বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। সাগর-রুনি হত্যা মামলা থেকে শুরু করে ত্বকী হত্যা-বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও বিচার মেলে না। যখন রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়, তখন নিছক একটি নির্বাচন করে সেই কাঠামোর পরিবর্তন আশা করা আকাশকুসুম কল্পনা। মানুষ এখনো রাস্তাঘাটে চলতে ভয় পায়, ঘরে ঘুমানোর সময়ও থাকে আতঙ্কে। এই আতঙ্ক কেবল চোর-ডাকাতের নয়, বরং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপব্যবহারের আতঙ্কও বটে।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন বারবার নির্বাচন হওয়ার পরেও মানুষের মুক্তি মিলছে না? এর মূল কারণ নিহিত আছে আমাদের তৈরি করা ব্যবস্থায় (System)। বর্তমান গণতন্ত্র বা প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মনে করা হয় জনগণকে বা সংসদকে, যারা নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো আইন তৈরি ও পরিবর্তন করতে পারে। এই সুযোগে মানুষ তার নিজের স্বার্থে আইন বানায়। ফলে ধনী আরও ধনী হয়, গরিব আরও নিস্পেষিত হয়। মানবরচিত বিধানের সীমাবদ্ধতা হলো, মানুষ পক্ষপাতদুষ্ট এবং স্বার্থপর। তাই মানুষের তৈরি আইনে কখনোই পরম ন্যায়বিচার (Absolute Justice) প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
ইতিহাস সাক্ষী, যখনই মানুষ ঐশ্বরিক বা স্রষ্টার দেওয়া বিধান থেকে দূরে সরে গেছে, তখনই সমাজে অনাচার, অবিচার ও জুলুম বেড়েছে। স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি ভালো জানেন মানুষের জন্য কোন ব্যবস্থাটি কল্যাণকর। বর্তমান যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা ও সেক্যুলার রাষ্ট্রকাঠামো চলছে, তা মূলত শক্তিশালীকে দুর্বলের ওপর ছড়ি ঘোরানোর লাইসেন্স দেয়।
নির্বাচন হলো একটি প্রক্রিয়া মাত্র, কোনো সমাধান নয়। যদি পাত্রটিই ছিদ্রযুক্ত হয়, তবে তাতে যত ভালো পানিই (সরকার) ঢালা হোক না কেন, তা ধারণ করা সম্ভব নয়। তেমনি রাষ্ট্রকাঠামো যদি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তবে ভোটের মাধ্যমে কেবল শোষকের মুখ পরিবর্তন হবে, শোষণের অবসান হবে না।
অতএব বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকে ‘একমাত্র সমাধান’ ভাবাটা এক ধরণের রাজনৈতিক অন্ধত্ব। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, কেবল ব্যালট পেপারে সিল মেরে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। মানুষের মুক্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে হলে প্রচলিত পচা-গলে যাওয়া ব্যবস্থাটির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন।
আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সেই শাশ্বত নীতি ও নৈতিকতার দিকে, যা স্রষ্টা মানুষের কল্যাণের জন্য প্রদান করেছেন। যেখানে বিচারক কারোর মুখের দিকে তাকিয়ে রায় দেবেন না, শাসক নিজের পকেট ভারী করবেন না এবং পুলিশ হবে প্রকৃত অর্থেই জনবন্ধু। যতক্ষণ না আমরা ‘মানুষের তৈরি ত্রুটিপূর্ণ বিধান’ এর পরিবর্তে ‘স্রষ্টার দেওয়া ন্যায়পরায়ণ ব্যবস্থা’র দিকে ফিরে যাব, ততক্ষণ নির্বাচন হবে কেবল একটি প্রহসন এবং ক্ষমতার পালাবদলের নাটক। তাই আজকের দিনে আমাদের স্লোগান হওয়া উচিত কেবল নির্বাচন নয়, বরং ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। একমাত্র তখনই মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও মুক্তি খুঁজে পাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।