
মো. মশিউর রহমান:
ইসলাম একটি সুমহান জীবনাদর্শ, জীবনব্যবস্থা। এর নাম আল্লাহ দিয়েছেন দীনুল হক অর্থাৎ সত্যদীন, যা তিনি স্বয়ং তৈরি করে নবী-রসুলদের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন সমাজে কার্যকরী করার মাধ্যমে সমাজে সৃষ্ট যাবতীয় অন্যায় অবিচার অশান্তি দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, মানুষের জীবনের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে। মানুষ যেন খারাপ জীবনাচরণ ত্যাগ করে মানবিক হয়ে ওঠে, সৎ, সত্যবাদী, বিশ্বস্ত, সমাজের কল্যাণকামী হয়ে ওঠে সেটি নিশ্চিত করতে। কারণ কোনো ধরনের অন্যায়, অবিচার, বক্রপথে স্বার্থোদ্ধার, মিথ্যাচার ইসলাম সমর্থন করে না। এগুলো ইসলামে নেই। কারণ এসব আচরণ সমাজকে ধ্বংস করে, মানবজাতির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে। এজন্য প্রত্যেক নবী-রসুল অন্যায়, অবিচার, মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন যা পরবর্তী উম্মাহর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়েছে।
বিশেষ করে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) মিথ্যাকে প্রশ্রয় না দেওয়ার যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা মানব-ইতিহাসে নজিরবিহীন। সেই সব দৃষ্টান্ত সিরাতগ্রন্থ ও বিশুদ্ধ বলে স্বীকৃত হাদিসগ্রন্থাদিতে সংরক্ষিত রয়েছে, যা থেকে আমরা জানতে পারি মিথ্যাশ্রয়ীদের ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য কী এবং মিথ্যাবাদীদের পরিণতি কী। দুটো দৃষ্টান্ত আমরা এখানে তুলে ধরছি।
মদিনায় রসুলাল্লাহর তিন বছরের ছেলে ইব্রাহিম যেদিন ইন্তেকাল করলেন, সেদিন সূর্যগ্রহণ হলো। আরবের নিরক্ষর, অনেকটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের মনে এ ধারণা জন্মাল যে, যার ছেলে মারা যাওয়ায় সূর্যগ্রহণ হয়, তিনি তো নিশ্চয়ই আল্লাহর রসুল, না হলে তাঁর ছেলের মৃত্যুতে কেন সূর্যগ্রহণ হবে? কাজেই চলো, আমরা তাঁর হাতে বায়াত নেই, তাঁকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে নেই, তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করি। তাদের এ মনোভাব মুখে মুখে প্রচার হতে থাকল। আল্লাহর রসুল (সা.) যখন এ কথা শুনতে পেলেন, তখন তিনি নিজ গৃহ থেকে বের হয়ে লোকজনদের ডাকলেন এবং বললেন, “আমি শুনতে পেলাম তোমরা অনেকেই বলছ, আমার ছেলে ইব্রাহিমের ইন্তেকালের জন্য নাকি সূর্যগ্রহণ হয়েছে। এ কথা ঠিক নয়। ইব্রাহিমকে আল্লাহ নিয়ে গিয়েছেন আর সূর্যগ্রহণ একটি প্রকৃতিক নিয়ম। এর সাথে ইব্রাহিমের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই।” (হাদীস, মুগীরা ইবনে শো’বা ও আবু মাসুদ (রা.) থেকে বোখারী)।
ঘটনাটি এমন এক সময়ের যখন মদিনার মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড টানাপড়েন ও বিতর্ক চলছে যে আল্লাহর রসুলকে তারা জাগতিক ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে কি করবে না। মোনাফেকদের অপতৎপরতাও ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। এমতাবস্থায় রসুলাল্লাহ কিছু না বলে যদি শুধু চুপ থাকতেন, তাহলে দেখা যেত অনেকে তাঁর উপর ঈমান এনে ইসলামে দাখিল হতো, তাঁর উম্মাহ বৃদ্ধি পেত অর্থাৎ যে কাজের জন্য আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন সেই কাজে তিনি অনেকটা পথ অগ্রসর হয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, এসেছিলেন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে, তাই মিথ্যার সাথে এতটুকুও আপস করলেন না। এতে তাঁর নিজের ক্ষতি হলো। কিন্তু যেহেতু এ কথা সত্য নয় গুজব, সত্যের উপর দৃঢ় অবস্থান থাকার কারণে তিনি সেটিকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিলেন না। তিনি শক্তভাবে এর প্রতিবাদ করলেন, তিনি জনগণের ধারণাকে সঠিক করে দিলেন।
আরেকবার মদিনায় একটি প্রচণ্ড শব্দ হলো। সেটা কীসের শব্দ তা কেউ বুঝতে পারল না। মদিনার লোকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে বিভিন্ন ধরনের শঙ্কার উদয় হলো, কেউ ভাবল শত্রু আক্রমণ করেছে, কেউ বা একে আসমানী গজবের আলামত মনে করল। লোকেরা সেই আওয়াজের দিক লক্ষ্য করে অগ্রসর হতে লাগল। একটু এগিয়েই তারা দেখতে পেল যে নবী করিম (সা.) সেই দিক থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে আসছেন। তিনি অভয় দিয়ে বললেন, “সবকিছু স্বাভাবিক আছে। তোমরা কোনো চিন্তা করো না।” আওয়াজটি রসুলাল্লাহর কানে যাওয়া মাত্রই কালবিলম্ব না করে তিনি একাই ঘোড়া ছুটিয়ে সেদিকে রওয়ানা দেন এবং নিজ জনগোষ্ঠীকে আস্বস্ত করেন (আনাস (রা.) থেকে বোখারী)। এভাবে তিনি তাঁর জনগণের মধ্যে কোনো প্রকার গুজবের বিস্তার ঘটার কোনো সুযোগ দিলেন না, ঘটনাটিকে রাজনৈতিক স্বার্থেও ব্যবহার করলেন না।
এরকম অনেক ঘটনা রয়েছে যা প্রমাণ করে কোনো নবী-রসুল এবং তাঁদের হাতে গড়া উম্মাহ গুজব ও মিথ্যাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সত্য উদঘাটন করেছেন। কারণ ইসলাম গুজব, হুজুগ ও মিথ্যাচারকে সমর্থন তো করেই না, বরং যারা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর, শাস্তির বিধান প্রয়োগ করে। এ বিষয় ইফ্কের ঘটনাটি বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে। ষষ্ঠ হিজরি সনে বনু মুস্তালিক যুদ্ধে রসুল (সা.) এর সাথে হযরত আয়েশা (রা.) ও ছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে তার গলার হার হারিয়ে যায়। হারানো হার খুঁজতে গিয়ে তিনি কাফেলা থেকে পিছনে পড়ে যান। সাফওয়ানকে (রা.) নবীজি এ কাজের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন যে, তিনি কাফেলার পশ্চাতে সফর করবেন এবং কাফেলা রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পর কোন কিছু পড়ে থাকলে তা কুড়িয়ে নেবেন। আম্মা আয়েশা (রা.) কে মাঠে দেখতে পেয়ে তিনি তাঁকে সসম্মানে মদিনায় নিয়ে আসেন। কিন্তু এই ঘটনাটি নিয়ে আম্মা আয়েশার (রা.) উপর মিথ্যা একটি অপবাদ আরোপ করা হয়েছিল এবং গুজব রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই গুজব, মিথ্যা অপবাদ মহানবীর পারিবারিক জীবনের শান্তিকে পর্যন্ত বিঘ্নিত করেছিল এবং সমগ্র মুসলিম সমাজের উপর এর একটি প্রভাব পড়েছিল। পরে আল্লাহ কোর’আনে আয়াত নাজিল করে আম্মা আয়েশার (রা.) নির্দোষ হওয়ার ব্যাপারে ঘোষণা দেন। ফলে যারা এই গুজব ছড়ানোর কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের প্রত্যেককে এজন্য জুমার দিনে বেত্রাঘাতের দণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল।
পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ গুজব রটনাকারীদের ব্যাপারে কঠিন দণ্ড ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, মোনাফেকগণ এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে এবং যারা নগরে গুজব রটনা করে তারা বিরত না হলে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে প্রবল করব, এরপর তারা এ নগরীতে অল্প দিনই তোমার প্রতিবেশীরূপে থাকবে। অভিশপ্ত (লানতপ্রাপ্ত) অবস্থায় তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে, ধরা হবে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে। যারা পূর্বে অতীত হয়ে গেছে, তাদের ব্যাপারে এটাই ছিল আল্লাহর রীতি (সুন্নাত)। আপনি আল্লাহর রীতিতে (সুন্নাতে) কখনও পরিবর্তন পাবেন না (সুরা আহযাব: ৬০-৬২)।
আল্লাহ গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে এতটা কঠোর হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে আমরা দেখতে পাই আমাদের সমাজে ধর্মের নামে অহরহ গুজব রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং হামলা চালানো হচ্ছে। এজন্য মসজিদের মাইক, ওয়াজের মাইক ব্যবহার করা হচ্ছে। বহু মানুষকে উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে বা কুপিয়ে মেরে ফেলার পর জানা গেছে যে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দোষ ছিল। গুজব-সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে হেযবুত তওহীদ আন্দোলন। হেযবুত তওহীদ যখন প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা মানবজাতির সামনে তুলে ধরছে, আল্লাহর দীনকে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তখন ধর্মব্যবসায়ী একটি শ্রেণিটি হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে এমন সব বানোয়াট মিথ্যাচার, অপপ্রচার চালাচ্ছে যার সাথে বাস্তবের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। আল্লাহ বলেছেন, ‘তাদের প্রতি আল্লাহর অভিশম্পাত যারা মিথ্যাবাদী (সুরা ইমরান: ৬১)। অনত্র বলেন, তাদের হৃদয়ে একটি রোগ রয়েছে, অতঃপর সে রোগ আল্লাহ বৃদ্ধি করে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি (সুরা বাকারা: ১০)। আর রসুল (সা.) বলেছেন, ‘মিথ্যা পাপাচারের পথ দেখায়। আর পাপাচার জাহান্নামে নিয়ে যায়। নিশ্চয়ই মিথ্যাচার জাহান্নাম নিশ্চিত করে (সহিহ বুখারি: ৫৬২৯)।
রসুল (সা.) অক্লান্ত পরিশ্রম করে, কঠোর অধ্যবসায়, নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে যে দীনটি আরব উপদ্বীপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তাঁর হাতে গড়া উম্মাহ পরবর্তীতে যে দীনটি অর্ধ-দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই দীনটি তাঁর ওফাতের এক থেকে দেড়শো বছরের মধ্যে বিকৃত ও বিপরীতমুখী হয়ে গেছে (কীভাবে হয়েছে সে বিষয় অনেক নিবন্ধ রয়েছে পড়ে নিবেন)। বিগত চৌদ্দশ বছর ধরে সেই বিকৃত ইসলামটি চর্চিত হতে হতে বর্তমানে এসেছে। যে ইসলামের আগমন হয়েছিল সমাজ থেকে যাবতীয় অশান্তির উৎসকে নির্মূল করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আজকে সেই ইসলাম নিয়ে চলছে তর্কবিতর্ক, মতানৈক্য, দ্বন্দ্ব-সংঘাত। ফলে ইসলাম দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অশান্তিই বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনকে দিন। অন্যদিকে এই সুযোগে ইসলামকে অনুপযোগী, অকার্যকর, অকল্যাণকর বলে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধা করছে না ইসলামবিদ্বেষীরা।
হেযবুত তওহীদের স্পষ্ট বক্তব্য হলো, আজকে দুনিয়াজোড়া যে ইসলামটা আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়, এটা তার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ও বিকৃত একটি ইসলাম। আল্লাহ অশেষ করুণা করে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সেই প্রকৃত ইসলামের রূপরেখাটি আবার গৌড়ের কররানি সুলতান পরিবারের উত্তরসূরি, টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী জমিদার পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে দান করেছেন। তিনি প্রকৃত ইসলামের সেই রূপটি মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছেন যে রূপটি আজকে পৃথিবীর কোথাও প্রতিষ্ঠিত নেই। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- ইসলাম আবির্ভূত হয়েছে নানা মতাদর্শে বিভক্ত মানুষকে এক আল্লাহর হুকুমের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে এক পরিবারভুক্ত করতে, সমাজের সমস্ত অসঙ্গতি দূর করে সাম্য-মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করতে, মানুষকে আত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে ন্যায়নিষ্ঠ, সত্যবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে, সমাজে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, নিরাপত্তা, শান্তি নিশ্চিত করতে। হেযবুত তওহীদ চেষ্টা করছে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সেই সামাজিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে যা রসুল (সা.) করেছিলেন। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে বারবার তারা ধর্মব্যবসায়ীদের মিথ্যাচারের তোপের মুখে পড়েছে, পড়ছে। শুধু তাই নয়, হতাহত ও নিহত পর্যন্ত হতে হচ্ছে।
আমাদের কথা হলো তারা যদি সত্যি মো’মেন মুসলিম হয়ে থাকে তাহলে তারা কীভাবে কারো বিরুদ্ধে মিথ্যাচার-অপপ্রচার করতে পারে? তারা কি আল্লাহর বিধান ও রসুল (সা.) এর দিক-নির্দেশনা সম্পর্কে অবগত নন? নাকি তারা জেনেশুনে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। আর যদি তারা জেনে বুঝে এই মিথ্যাচারগুলো করে থাকেন তাহলে তারা কি আদৌ মো’মেন মুসলিম থাকেন? থাকেন না। সকল শ্রেণির সচেতন মানুষের প্রতি আমাদের আহ্বান, আপনারা যারা ইসলামকে ভালোবাসেন, ইসলামের বদনাম হোক এমন কিছু চান না, তাদের উচিত হবে এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, এর প্রতিবাদ করা এবং ন্যায়সঙ্গত কথা বলা।
[লেখক: আমির, রংপুর বিভাগ, হেযবুত তওহীদ; যোগাযোগ: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৭১১-৫৭১৫৮১, ০১৬৭০-১৭১৬৫১]