Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / বিচারব্যবস্থা সংস্কার: জাতি খালাস পাবে তো? -ওবায়দুল হক বাদল - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

বিচারব্যবস্থা সংস্কার: জাতি খালাস পাবে তো? -ওবায়দুল হক বাদল

November 24, 2024 11:15:11 AM   স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
বিচারব্যবস্থা সংস্কার: জাতি খালাস পাবে তো?  -ওবায়দুল হক বাদল

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যে দু’টি বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামনে এসেছে তার মধ্যে একটি হলো রাষ্ট্র সংস্কার আরেকটি সুষ্ঠু নির্বাচন। ইতোমধ্যে বেশকিছু সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। রদবদল, বহিষ্কার, পদত্যাগ ইত্যাদি নানা উপায়ে কাঠামোগত কিছু সংস্কার ইতোমধ্যে আমরা দেখেছিও। 
বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রশ্ন আসলেই প্রথমে যে বিষয়টি সামনে আসে সেটি হলো স্বাধীন বিচার বিভাগ বা স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। অর্থাৎ সুবিচার, ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ করে বিচার বিভাগগে পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয়া।  
সত্যি বলতে, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে যখন স্বাধীন করার প্রসঙ্গ আসে, তখন বিষয়টি হাস্যকর লাগে আমার কাছে। স্বাধীনতার পর আজকের দিনটি পর্যন্ত কোনো একটি সরকারের আমলে বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে কি পেরেছে? 
প্রশ্নটা একারণেই আসে যে, প্রত্যেকবার সরকার পরিবর্তনের পর অনেক বিচারপতিদের উপর দলীয়করণ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ ওঠে। দোষটা একপাক্ষিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়াটা সুবিচার হবে না এর অর্ধেকটা না হলেও কিছুটা হলেও বিচারপতিদের উপরও বর্তায়। তা না হলে দলীয়করণ হন কিভাবে একজন বিচারক? এক্ষেত্রে বিচারপতি নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতার পাশাপাশি সততা, ন্যায়নিষ্ঠতাকে কতটা প্রাধান্য দেওয়া হয় সেই প্রশ্নও আসে বৈকি। 
এছাড়াও, মামলার জট, মামলার দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতিসহ নানা বিষয়ও সামনে আসে। 
বর্তমানে তেতাল্লিশ লাখ মামলা আদালতে বিচারাধীন। সরকার পতনের পর হাজার হাজার মামলা হচ্ছে। মামলা বাণিজ্যও হচ্ছে সমানে। কেবল রাজনৈতিক দলগুলোই নয় জুলাই-আগস্ট এর অভ্যুত্থানে শহীদের অভিভাবকদের বিরুদ্ধের মামলা বাণিজ্যেও অভিযোগ উঠছে।  
প্রশ্ন হচ্ছে- বিচারব্যবস্থা না হয় স্বাধীন হলো কিন্তু তাতে কি এই জট ছাড়বে, মামলা বাণিজ্য বন্ধ হবে, মামলার দীর্ঘসূত্রতার সমাধান সম্ভব হবে? যেখানে প্রতিটি মামলার সাথে জড়িত উকিল, মুহুড়ীদের রুটি-রুজি, যেখানে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির সাথে তাদের আয় লোপ-বৃদ্ধির বিষয় জড়িত?
আর যে সমাজে অপরাধ দিনকে দিন ধাই ধাই করে বাড়তে থাকে এবং হানাহানি, দলাদলি, ধাপ্পাবাজির রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম আছে সেখানে মামলার জট কিভাবে কমানো সম্ভব? 
আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, বর্তমান বিচারব্যবস্থায় একজন বিচারপ্রার্থীকে ন্যায় বিচার পেতে যুগ যুগ ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরপাক খেতে হয়। বাপ মামলা লড়তে লড়তে মারা যাবার পর উত্তরাধিকার সূত্রে সেই মামলা এসে পড়ে সন্তানদের ঘাড়ে। সেই মামলা লড়তে লড়তে ছেলেও বার্ধক্যে পৌঁছে এমন নজিরও কম নয়। 
আর আমাদের জেলখানাগুলোও তো পরিশোধনাগার হয়ে ওঠেনি। এই জেলখানায় যে একবার ঢোকে সে পরিশুদ্ধ হবার বদলে আরো বড় অপরাধী হয়ে বের হয়। চোর আরো বড় চোর হয়। ডাকাত আরো বড় ডাকাত হয়। অপরাধীরা আরো ম্যাচিউরড হয়ে বের হয়। যে যতবার জেল খেটেছেন তার অভিজ্ঞতা তত বেশি। জেলের ভিতরে বাইরে উভয় জায়গায় সে সিনিয়র। ভিতরে তিনি সম্মানীয় আর বাইরে ভয়ঙ্কর। 
মাদকব্যবসায়ীরা জামিনে বের হয়ে পুনরায় মাদকব্যবসা চালু করে সেই আয় দিয়েই মামলার খরচ চালায়। এ কারণেই দেখা যায়, অধিকাংশ অপরাধীর নামে একাধিক মামলা। অর্থাৎ দণ্ড ভোগ করে কিংবা জামিনে এসে যেন সোৎসাহে নতুন উদ্যমে নতুন ট্যাকটিস ফলো করে বহুমুখী অপরাধের সাথে জড়িত হন তারা। মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমার লক্ষণ নেই। 
পক্ষান্তরে কোনো অপরাধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রভাবশালী কোনো মহলের রোষাণলে পড়ে কোনো ক্রমে মিথ্যা মামলায় যদি কেউ দণ্ডপ্রাপ্ত হন তিনি বরং নিজেকে শুধরে নেন। ভুলেও কোনো দিন আর কোনো অপরাধের প্রতিবাদ করার সাহস করেন না। এসব ব্যাপারে একশ’ হাত দূরে থাকার নীতি অবলম্বন করেন। অবস্থা এমন যেন তার শিক্ষা হয়ে গেছে! প্রতিবাদী মানুষটা নির্বিবাদী মনোভাব নিয়ে একেবারে সমাজের নিষ্ক্রিয় প্রাণিতে পরিণত হন। 
চলমান বিচারব্যবস্থায় একজন নিম্ন আয়ের সাধারণ নাগরিকের, সাধারণ বিচারপ্রার্থীর ন্যায় বিচার পেতে অনেকক্ষেত্রে আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। দুই শতাংশ জমি নিয়ে মামলায় বছরের পর বছর আদালতে ঘুরতে হয়। এতে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের অর্থের যে ক্ষতিসাধন হয় মামলার রায়ের পরে হিসাব কষলে দেখা যায় জমির মূল্যকে তা ছাড়িয়ে গিয়েছে। সময় আর দুশ্চিন্তার কথা বাদই দিলাম। দুই শতাংশ জমি নিয়ে চলমান মামলার খরচ চালাতে ১০ শতাংশ জমি বিক্রির নজিরও রয়েছে। লুঙ্গি পড়া লোকটা কোর্ট পড়া লোকগুলোর জন্য প্রত্যেক মাসে মাসে হাজিরার টাকা জোগাড় করে নিয়ে যাচ্ছে। হয়ত বাজার খরচ কমিয়ে, নয়ত ছেলের পরীক্ষার ফি না দিয়ে, মায়ের ওষুধ না কিনে টাকা বাঁচিয়ে, মেয়ের বিয়ের খরচের জন্য রাখা গাছটি বিক্রি করে, হয়ত ধার করে উকিল, মুহুড়ি, পেস্কারদের ভিজিট জোগাড় করতে করতে তার জীবনের বড় একটা অংশ চলে যায়। যারা দরিদ্রতার কাছে হেরে যান তারা ‘ভিক্ষা লাগবে না কুত্তা থামা’ নীতি অবলম্বন কওে শেষমেস রণে ভঙ্গ দিয়ে বিচারটা উপরওয়ালার হাতে সোপর্দ করে দেন।  
বিচার প্রক্রিয়ায় বিচারপ্রার্থীকে অর্থ ব্যয় করতে হবে কেন? বিচার পাওয়া জনগণের অধিকার আর ন্যায় প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মানুষকে তার অধিকার দিতে হবে আর রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে সংস্কারের কথা বলে লাভ নেই।  
এই যে বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্ব, বিচারপতিদের দলীয়করণ, বিচারপতি নিয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, লক্ষ লক্ষ মামলার জট, হয়রানিমূলক ও মিথ্যা মামলার দৌরাত্ম, মামলা পরিচালনার সীমাহীন ব্যয়ভার ইত্যাদি সমস্যা কিভাবে দূর করবেন? 
আজকে যারা বিচারব্যবস্থা হতে হবে স্বাধীন, বিচারকদের উপর শাসক শ্রেণির কোনো খবরদারি থাকতে পারবে না ইত্যাদি বলে গলা ফাটান তারা এর সমাধান হিসেবে পশ্চিমা দুনিয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে থাকেন, স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে তাদেরকেই দেখেন। অথচ চলমান এই ব্যবস্থাটা পশ্চিমাদেরই দিয়ে যাওয়া। 
আমি আপনাদের সামনে একটা বিকল্প স্ট্যান্ডার্ড উপস্থাপন করছি, যেকোনো কারণেই হোক যেদিকে হয়ত আপনাদের তাকানোর ফুসরত হয় না! 
ক্স একটি বিকল্প স্ট্যান্ডার্ড:
ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.) একদিন কুফার বাজারে একজন ইহুদিকে একটি বর্ম বিক্রি করতে দেখলেন। তিনি বর্মটি দেখেই চিনতে পারলেন। এটা ছিল তার নিজের বর্ম, যেটা তিনি সিফ্ফিনের যুদ্ধের সময় হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি ইহুদি লোকটির কাছে দাবি করলেন, বর্মটি তাঁর। তুমি এটা হয় কুঁড়িয়ে পেয়েছ, নয় চুরি করেছ। কিন্তু ইহুদি লোকটি বর্ম তার নিজের বলে দাবি করলো।
খলিফা চাইলে তখনি বর্মটি কেড়ে নিতে পারতেন। কিন্তু ইসলামে স্বেচ্ছাচারের কোনো সুযোগ নেই। খলিফা কুফার কাজীর দরবারে গিয়ে ইহুদি ব্যক্তির বিরুদ্ধে নালিশ করলে কাজী মহোদয় ইহুদিকে তলব করেন। সেখানেও লোকটি বর্মটি তার নিজের বলে দাবি করলো। কাজী মহোদয় আলী (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, এই বর্মটি যে আপনার, এ ব্যাপারে প্রমাণ কী? যেহেতু এখন বর্মটি ইহুদি ব্যক্তির কাছে, তাই প্রমাণ ছাড়া আমি তা আপনার হাতে তুলে দিতে পারি না। আলী (রা.) বললেন, আমার পুত্র হাসান ও আমার এক ভৃত্য এ ব্যাপারে সাক্ষী আছে। তারা দেখলেই এটা চিনতে পারবে। কাজী বললেন, আপনার পুত্র হাসানের একার সাক্ষ্যই যথেষ্ট, কেননা তিনি সত্য ব্যতীত মিথ্যা বলতে পারেন না। কিন্তু তিনি আপনার পুত্র, তাই পিতার পক্ষে পুত্রের সাক্ষী আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়। তেমনি একজন মনিবের পক্ষে তার ভৃত্যের সাক্ষীও আদালতের গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে আর কোনো সাক্ষী আছে কি? আলী (রা.) বললেন, তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলতে পারবে না।
কাজী তখন ইহুদি ব্যক্তির পক্ষে রায় দিলেন। আলী (রা.) বিনা বাক্যব্যয়ে সেই রায় মেনে নিলেন। 
ঐ ইহুদির নাম ছিল কাহিনাস। নাহজুল বালাগায় ও অন্যান্য ইতিহাসগ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, ঐ ঘটনার পর তিনি অনুতপ্ত হয়ে আলীর (রা.) কাছে আসেন এবং ইসলামের ন্যায়বিচার ও নীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নাম পরিবর্তন করে মুসলিম নাম গ্রহণ করেন।
একে বলে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। এই হলো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ন্যায় বিচারের দৃষ্টান্ত। এমন বহু দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাস থেকে দেওয়া যায়। বিচারব্যবস্থায় যদি এমন স্বাধীনতা আনতে পারেন তাহলে ওয়েলকাম। আর যদি তা না পারেন তাহলে সংস্কারের ধোয়া তুলে লাভ নেই। পূর্বের শহীদদের মতো এবারের শহীদদের রক্তও বৃথা যাবে। শাসক আসবে শাসক যাবে জাতির জাতি খালাস পাবে না। সাময়িক জামিন পেতে পারে কিন্তু মুক্তি মিলবে না। 
নিউইয়র্কের আদালতে ঘুষ কেলেঙ্কারি, ব্যবসায়িক নথি জাল সংক্রান্ত মামলা, ক্যাপিটল হিল সহিংসতায় নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার চেষ্টা মামলা এবং হোয়াইট হাউজের নথি সংক্রান্ত মোট চারটি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্বাভাবিক নিয়মে এসব অপরাধে ট্রাম্পের ৪ বছরের সাজা হতে পারে। আপনারা যারা কথায় কথায় ইউরোপ-আমেরিকার দৃষ্টান্ত টানেন তাদের সেই স্বর্গরাজ্যের প্রেসিডেন্টের আমলনামা হলো এই। 
যদি তার ৪ বছরের সাজা হয় তাহলে তিনি কি করবেন? প্রেসিডেন্টগিরি করবেন নাকি সাজা ভোগ করবেন? অবশ্য সাজা হবার কোনো কারণই নেই। তিনি যত বড় অবরাধই করে থাকেন না কেন তিনি এখন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তার সাত খুন মাফ। 
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে আইনজ্ঞরা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় ট্রাম্পের কারাভোগের আশঙ্কা নেই। তবে তিনি বিচার বিভাগে বিভিন্ন পরিবর্তন এনে নিজেকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 
এই হচ্ছে আপনাদের স্ট্যান্ডার্ড। সব খাতায় আছে কিন্তু গোয়ালে নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জায়গায় একজন সাধারণ মানুষ হলে কি তিনি সাজা থেকে রক্ষা পেতেন? অবশ্যই না। আইন তখন নিজস্ব গতিতে ফুল স্পিডেই চলত। 
অথচ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছিল ইসলাম। 
ক্স একটি দৃষ্টান্ত: 
একদিন তীর ছোঁড়া অভ্যাস করার সময় শাহী বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের একটি তীর দৈবক্রমে এক বিধবার পুত্রকে আঘাত করে। বিধবা কাজী সিরাজুদ্দিনের নিকট এর প্রতিকার প্রার্থনা করে। তখন কাজী সুলতানকে আদালতে তলব করেন এবং একজন আসামির সাথে যেমন আচরণ করা উচিত তেমনটাই করেন। তারপর সুলতান বিধবাকে তার পুত্রকে আঘাত করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপুরণ দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করেন। এরপর কাজী সানন্দে উঠে দাঁড়িয়ে সুলতানকে সম্মান প্রদর্শন করেন। তখন সুলতান তাঁর তলোয়ার বের করে বললেন, ‘কাজী সাহেব, পবিত্র আইনের বিধান অনুযায়ী আমি আপনার আদালতে উপস্থিত হয়েছি। আপনি যদি আইনের বিধানের একচুল ব্যতিক্রম করতেন, তাহলে এই তরবারি দিয়ে আমি আপনার শিরñেদ করতাম। আল্লাহর শুকরিয়া যে সব ঠিক মত হয়ে গেল।” 
তখন কাজীয় তার মসনদের নিচে থেকে একটি বেত বের করে বললেন, “যদি আজ আমি আপনাকে আল্লাহর পবিত্র আইনের বিধান বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম করতে দেখতাম, তাহলে এই বেতের আঘাতে আপনার পিঠ লাল ও কালো করে দিতাম। একটা বিপর্যয় উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু ভালোয় ভালোয় মিটে গেল।”
এই হলো ন্যায়বিচার। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, একমাত্র ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা এতটা নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা উপহার দিতে পারে নি, পারবেও না।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে দৃষ্টান্ত খুঁজতে ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে হবে কেন! এত হীনম্মন্য কেন আমরা? কোন জুজুর ভয় আমাদের পেয়ে বসেছে? ব্রিটিশরা তো আমাদের শাসন করেনি, শোষণ করেছে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সেই শোসকগোষ্ঠীর পদ্ধতিই কেন অন্ধভাবে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে প্রয়োগ করে যেতে হবে! তার ফল যদি মিষ্ট হতো তাহলে না হয় কথা ছিল। যে গাছ বিষফল দেয় সেই গাছে যতই কীটনাশক ছিঁটানো হোক যতই পরিচর্যা করা হোক সে কখনো অমৃত দেবে না। 
সময় এসেছে ঔপনিবেশিক যুগের অন্ধ অনুকরণকারী শোষণমূলক, বৈষম্যমূলক বিচারব্যবস্থা পরিহার করার। মনে রাখতে হবে, এটা মানুষের তৈরি বিচারব্যবস্থা, তাই এর মধ্যে ত্রুটি বা গলদ রয়েছে আর সেগুলোর সংশোধনের জন্য কথা বলা মানে আদালত অবমাননা নয়। 
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। আল্লাহর দেওয়া সেই জীবনব্যবস্থা মেনে ইসলামী বিচারব্যবস্থা চালু করতে দোষটা কোথায়? শান্তি, সুবিচার, নিরাপত্তাই যদি চান তাহলে এর বিকল্প নেই। 
ইউরোপীয় ব্রিটিশ খ্রিষ্টানরা একটি সিস্টেম চালু করেছে বলেই সেটা একেবারে পরিত্যাজ্য এমন কথাও আমরা বলছি না, এবং সেটা যৌক্তিকও নয়। আমরা বলছি, প্রত্যেকটা ব্যবস্থার সঙ্গে আল্লাহর হুকুমের সম্পর্ক থাকতে হবে। দীনের বুনিয়াদি নীতির সাথে সম্পৃক্ত না থাকলে যে কোনো ব্যবস্থাই সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন, বস্তুবাদী, আত্মাহীন ও দুনিয়াদারী ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়। আল্লাহর হুকুমই হবে চূড়ান্ত, তাই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি বিচারপদ্ধতি ও আইন-কানুন সবই সংস্কারের আওতায় আসবে আর যেগুলো আল্লাহর দেওয়া মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় তা বাদ যাবে। সংস্কার যদি করতে হয় তাহলে এভাবেই করা উচিত।  
আমরা ইতিহাস থেকে জানি, রসুলাল্লাহ (সা.) যখন সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করেছেন তখন বছরের পর বছর আদালতে অপরাধ সংক্রান্ত কোনো মামলাই আসতো না। মামলার জট তো দূরের কথা। আবু বকরের (রা.) খেলাফতের যুগে উমর (রা.) মদিনায় বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। তাঁর দায়িত্ব পালনকালে বিচারপ্রার্থী মানুষ এতটাই ন্যায়বিচার পেত যে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাঁর কাছে খুব কম সংখ্যক মামলাই আসতো। পরে, হযরত আবু বকর (রা.) তাঁকে একবার বলেন, “তোমার কাছে তো কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে আসে না।” (মুয়াত্তা- ইবনে মালিক, তাবাকাত- ইবনে সাদ)। 
ক্স একটি ভয়ের অপনোদন: 
বর্তমানে ইসলামের শরিয়াহ নিয়ে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে যে মনে করা হয় ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলে কারো হাত থাকবে না। একটা মুরগি চুরি করলেও চোরের হাত কেটে ফেলা হবে। বস্তুত এটা একটা প্রোপাগান্ডা, কারণ এটা যদি সত্য হত তাহলে আরবের ঐ সমাজে ঘরে ঘরে হাতকাটা লোক পাওয়া যেত। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। ঐতিহাসিকদের মতে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সাড়ে তিনশ বছরে চুরির দায়ে হাত কাটা হয়েছে মাত্র ৬ জন ব্যক্তির (ওংষধস: অ গরংঁহফবৎংঃড়ড়ফ জবষরমরড়হ নু গড়যধসসধফ কঁঃঁন)। ইসলামের হুকুম ও মূল্যবোধ সমাজে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তা মানুষের চরিত্রে এমন পরিশুদ্ধি এনে দিয়েছিল যে বহু মানুষ অপরাধ করার পর অনুতপ্ত হয়ে নিজেই এসে নিজের অপরাধের দণ্ড কামনা করত, সেটা যদি প্রাণদণ্ডও হয়। কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বা সাক্ষ্য না দেওয়া সত্ত্বেও।
গত ৫২ বছরে নির্বাচন হোক আর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হোক দেশে ক্ষমতার পালাবদল কম হয়নি। এবং প্রত্যেক সরকারই বিভিন্ন সংস্কারে সচেষ্ট ছিলেন। সংবিধানকেও ১৭ বার কাঁটাছেড়া করতে দেখেছি আমরা। কিন্তু দৃশ্যত কোনো ফলাফল জাতি পায়নি।  
ইউরোপের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর মূল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের কোনো বিষয়ে ধর্মের বা স্রষ্টার কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। ধর্মকর্ম যার যার ব্যক্তিজীবনে আবদ্ধ থাকবে। তারা আমাদের এদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাও সেই কাঠামো অনুযায়ী গড়ে তুলেছিল। এক শতাব্দির বেশি সময় ধরে সেই কাঠামো অনুসারে সমাজ পরিচালনার পর এর যে ত্রুটিগুলো প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো থেকে মুক্তি পেতে আবার আমাদেরকে সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। 
ব্রিটিশ প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে চালু রেখে আমরা জাতির যাবজ্জীন দণ্ড কার্যকর করেছি। এই ব্যবস্থা গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে আল্লার দেওয়া সিস্টেম কায়েম করতে হবে। রাষ্ট্রকাঠামোর মূলনীতি হবে, সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুমকে প্রাধান্য দেয়া। যদি সেটা করতে না পারেন তাহলে সকল সংস্কারই দিনশেষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। জাতি হয়ত সাময়িক জামিন পেতে পারে কিন্তু খালাস মিলবে না। অন্ধকারায় পচে মরতে হবে।
[লেখক ও কলামিসস্ট, ফোন: ০১৮৫২১৮০৯০৬]