Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা কতটুকু? - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা কতটুকু?

December 03, 2024 02:30:43 PM   শাহাদৎ হোসেন
বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা কতটুকু?

ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে পাঁচ আগস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটা প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা বিরাজ করছে ছাত্রজনতার মাঝে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, রাজনৈতিক নেতা, বিপ্লবের নায়কসহ সচেতন মহল মাত্রই এই বিষয়ে সজাগ। সকলেই প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে সতর্ক থাকার জন্য বলছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও একাধিকবার বিগত সরকারের সহযোগীদের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র এবং প্রতিবিপ্লবের উদ্দেশ্যে দেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করে হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশঙ্কা হলো প্রতিবিপ্লব। আশঙ্কা যে, পুরোনো আওয়ামী সরকারের অনুগত আমলা, কর্মীবাহিনী কি আবার জেগে উঠবে, ছিনিয়ে নিবে বিপ্লবে অর্জিত ক্ষমতা, পুনরুদ্ধার করবে ক্ষমতার মঞ্চ!

প্রতিবিপ্লব এমন একটি অবস্থাকে বোঝায়, যেখানে বিপ্লব পরবর্তী সময়ে, সমাজের একাংশ বা পুরোনো রাজনৈতিক শক্তি পুরনো শাসনব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে, বা নবগঠিত শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই ধরনের আন্দোলন বা পরিবর্তন প্রক্রিয়া সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, কিংবা রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় জনগণের ক্ষোভ এবং অসন্তোষের ফলস্বরূপ ঘটে। প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা যখন প্রবল হয়, তখন তা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি হয়। আজকের বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলির বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইতিহাস বলে, প্রতিবিপ্লবের পেছনে যে মূল কারণগুলি কাজ করে, তা প্রায়শই সেই সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশাল মতবিরোধ, একত্রিত না হওয়া, সমন্বয়ের অভাব এবং জনগণের অসন্তোষের উপর নির্ভর করে। প্রতিবিপ্লব এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়, যেখানে মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে যখন তারা উপলব্ধি করে যে তাদের দাবি বা আশা পূর্ণ হয়নি বা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনকে অনেকে আগস্ট বিপ্লব আবার অনেকেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করছেন। দেশে বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান যাই ঘটুক না কেন, সেই পরিবর্তনকে পাল্টে দেওয়ার যেকোনো চেষ্টা বা ষড়যন্ত্রকে প্রতিবিপ্লব বলা হচ্ছে।

বিশ্ব ইতিহাসে প্রতিবিপ্লবের অনেক উদাহরণ রয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে কিভাবে প্রতিবিপ্লব একটি জাতির জন্য একটি সংকটজনক মুহূর্ত সৃষ্টি করতে পারে। ফ্রান্সের ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পর, যখন নবগঠিত শাসনব্যবস্থা জনগণের আশা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তখন প্রতিবিপ্লবের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। একদিকে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণকারী নবগঠিত সরকার, আরেকদিকে পুরনো শাসকদের সমর্থকরা প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল। এর ফলস্বরূপ, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রবল আকারে বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীতে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি হয়। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে, একটি বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবের উত্থান কিভাবে সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। অপরদিকে রাশিয়ার ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পরও প্রতিবিপ্লবের পেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। বলশেভিক বিপ্লবীরা প্রথমে ক্ষমতা দখল করে নেয়, কিন্তু শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনটি এতটা সহজ ছিল না। পুরনো শাসনব্যবস্থার সমর্থকরা তাদের পুরনো আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবিপ্লবের উদ্যোগ নেয়, যার ফলে রাশিয়ায় একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এটি আমাদের একটি শিক্ষা দেয় যে, প্রতিবিপ্লবের ফলে একটি জাতি রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হতে পারে এবং সেই অস্থিরতা দীর্ঘকালীনও হতে পারে।

বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন একটি অবস্থায় দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠছে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি, আইনশৃংখলা, আদালত, বাজার ব্যবস্থা, প্রশাসন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন এমন এক অবস্থানে রয়েছে, যেখানে জাতীয় ঐক্যের ভীত খুব মজবুত না হওয়ায় অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা দিন দিন বাড়ছে। একদিকে সরকার, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শিক মতপার্থক্য, শক্তির প্রতিযোগিতা এবং রাজনৈতিক সমন্বয়ের অভাব -এই সবই প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কাকে প্রকট করে তুলতে পারে। এরমধ্যে ছাত্র আন্দোলন, প্রশাক শিল্পে অস্থিরতা, নানান ইস্যুতে আন্দোলন চলছে।

৫ আগস্টের পর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সহিংসতা, আন্দোলনও প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কার পালে হাওয়া দিয়ে আসছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পুলিশ সদস্যদের কর্মবিরতি, মব সৃষ্টি করে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মাজারে হামলা, ভারতীয় মিডিয়ার উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচার, সাবেক প্রধান বিচারপতির ফুল কোর্ট সভা, পাবর্ত্য এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, আনসার ইস্যু, চাকরির ন্যূনতম বয়স ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন, ডাকাত আতঙ্ক, পোশাক শিল্পে চলমান অস্থিরতা-শ্রমিক অসন্তোষ, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত, ঋণের প্রলোভনে শাহবাগে হঠাৎ হাজারো মানুষ, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ব্যানারে শাহবাগ অবরোধ, চিন্ময় অনুসারীদের সহিংস বিক্ষোভ, তাকে গ্রেফতারের পর ত্রিমুখি সংঘাতে আইনজীবী সাইফুল ইসলামের মৃত্যুপরবর্তী দাঙ্গা সৃষ্টির আশঙ্কা ইত্যাদি নানান সমস্যা প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কাকে প্রকট করে তুলেছিল।

এছাড়াও প্রতিটি স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, সোস্যাল এক্টিভিস্টদের সরকারবিরোধী প্রচারণা -এই পরিস্থিতি একটি প্রতিবিপ্লবী শক্তির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য না থাকলে, একটি প্রতিবিপ্লবের উত্থান খুব দ্রুত ঘটতে পারে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে, বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা বিরোধ এবং একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি, প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা তৈরি করেছে। পরিস্থিতিগুলো যখন তীব্র হয়, তখন জাতি এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। এমন একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, অন্তর্বর্তী সরকারকে মানুষ সাধুবাদ জানালেও এ সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে খুব একটা সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি। দেশজুড়ে আইন-শৃংখলার অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতি, আন্দোলন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, দাবি-দাওয়া পূরণে অক্ষমতা ইত্যাদি কারণে সরকারের প্রতি সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরূপ মনোভাবও সৃষ্টি হচ্ছে। এই ব্যর্থতা বাড়তে থাকলে সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বাড়তে পারে। এমনকি, সরকার যদি জনগণের চাহিদা ও অভিযোগের প্রতি যথাযথ মনোযোগ না দেয়, তবে তা প্রতিবিপ্লবের শক্তিকে সুযোগ করে দিবে।

অপরদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে আরো জটিল হয়ে উঠেছে, বিশেষত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা উত্তেজনা যখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তখন তা পরাজিত শক্তির জন্য একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান অস্থিরতা, সীমান্ত সমস্যা, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জনগণের মধ্যে বিরোধ এবং পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারতে অবস্থান, সবই প্রতিবিপ্লবের পরিবেশকে আরও উত্তেজিত করতে পারে। বাংলাদেশের জনগণের ধারণা, শেখ হাসিনা ভারতে বসে ভারতকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা চালাচ্ছেন আর এই কারণে জনগণ ভারতকে সহজে প্রশ্রয় দিতে চায় না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই টানাপোড়েন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দেয়, যা প্রতিবিপ্লবী শক্তির জন্য একটি শক্তিশালী পটভূমি তৈরি করতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এক অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা দেশটির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তোলে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নতি বা অবনতি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনার উপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতাদের জন্য কোনও বৃহত্তর রাজনৈতিক দিশা বা অবস্থান নেই। তাদের এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে তারা একটি শক্তিশালী বক্তব্য দেওয়ার নৈতিক অবস্থানেও নেই। সাবেক শাসক দলের নেতাদের মধ্যে এক ধরনের নীরবতা এবং নৈতিক সংকট লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে দেশের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, দেশব্যাপী শৃঙ্খলা থাকুক বা না থাকুক, পরাজিত হওয়ার পর তারা পুনরায় সংঘবদ্ধ হবার প্রয়াস চালাবে এটাও স্বাভাবিক। হাসিনার ফাঁস হওয়া কল রেকর্ডে নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করার বিষয়টিও পরিষ্কার। প্রয়োজনে তারা দেশে শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে ঠেলে দিয়েও প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা চালাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থাৎ যেভাবেই হোক ক্ষমতার মঞ্চ পুনরায় দখল করতে তারা নানা কৌশল এবং মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টা চালাবে।

পরিস্থিতি অন্তর্বর্তী সরকারের অজানা নয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা মাথায় রেখেই ঘুমাতে যায় সরকার। রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্যহীনতা, জনগণের বিরূপ মনোভাব, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি, এবং সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ষড়যন্ত্র -এই সমস্ত উপাদান মিলিয়ে একটি গভীর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তুলছে। যদিও যেকোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর সমাজে কিছুটা অস্থিরতা থাকে, তবে অচিরেই দেশের সকল সমস্যা নিয়ন্ত্রণে এনে দেশের হাল শক্তভাবে না ধরা হলে, জাতির ভবিষ্যত অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারে।