
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম:
মুসলিম জাতির গত এক শতাব্দির ইতিহাস যেন এক বিভীষিকা। যুদ্ধ, রক্তপাত, হত্যা, গুম, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, উৎখাত, উচ্ছেদ অভিযান, গণহত্যা যেন মুসলমানদের ভাগ্যের লিখন। একেকটা মুসলিমপ্রধান দেশ যেন একেকটা কসাইখানা। এসব যুদ্ধভূমিতে শিশুদের ঘুম ভাঙে বোমার শব্দে কিংবা বুলেটে বুক ঝাঁঝরা হওয়া স্বজনের আর্তচিৎকারে। সাম্রাজ্যবাদীরা সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিগত ৭৭ বছরে মুসলমান নিধনযজ্ঞের পরিসংখ্যান দেখলে যেকোনো সুস্থ মানুষের গা শিউরে উঠবে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য)
এ তো গেল কেবল গত কয়েক দশকের মুসলিম গণহত্যার একটি পরিসংখ্যান। আমরা যদি, আরো পেছনে যাই সেখানেও দেখব মুসলিম গণহত্যার রক্তাক্ত ইতিহাস। ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানদের উপর প্রথম আক্রমণ ও গণহত্যা চালায় ক্রুসেডাররা। এ হামলায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১৭ লক্ষ মুসলমানকে। এরপর দ্বিতীয় আক্রমণে হালাকু খান বাগদাদে হামলা চালিয়ে পুরো নগরীকে মৃত্যুপুরীতে রূপ দেয়। হালাকু খানের বাহিনী প্রায় ২০ লক্ষ মুসলমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের মাথা দিয়ে পিরামিড বানায়। অল্প সময়ের মধ্যে এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে হত্যা করে যে পুরো নগরী রক্তের নদীতে পরিণত হয়। একই কায়দায় গণহত্যা চালায় চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং। এর কিছুকাল পরে মুসলমান জাতিটির উপর সর্বশেষ আক্রমণ করে ইউরোপীয় প্রভুরা। ১৬ শতকের শেষদিকে ইউরোপীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খ্রিষ্টান জাতি কর্তৃক আক্রমণ, গণহত্যা, লুণ্ঠন অতঃপর দুইশো' বছরের দাসত্ব মুসলমান জাতিকে মুক, অন্ধ ও বধির করে দেয়। সেই থেকে আর মুসলমানরা মাথা তুলতে পারে নি। তারা অন্য জাতিগুলোর কাছে ফুটবলের মতো লাথি খেয়ে তাদের অনুগ্রহ, অনুকম্পা নিয়েই বেঁচে আছে। যে যেভাবে পারছে মুসলমানদের উপর চেপে বসছে, তাদের উপর অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম করছে, শোষণ করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। যখন স্বার্থ ফুরিয়ে যাচ্ছে তখন অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে তাদের ভূখণ্ড কেড়ে নিয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় এগারো কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু। তাদের নিজেদের দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত। তাদের না আছে কোন আবাসস্থল, না আছে কোন বেঁচে থাকার অধিকার। তাদের দেখার কেউ নেই। তখন সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিষ্ঠা করা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন আসে ত্রাণের সামগ্রী নিয়ে। তাদের দয়া-অনুকম্পা ছাড়া উদ্বাস্তু মুসলমানদের আহারও জোটে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলমানদের এই শোচনীয় পরিণতির কারণ কী? যে মুসলমানরা ছিল দুনিয়াতে সেরা জাতি, অর্ধ পৃথিবীর শাসক, যারা কিনা একদা পৃথিবীর দুই সুপার পাওয়ার রোম ও পারস্যকে পরাজিত করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল, যাদের শক্তি, শৌর্য, বীরত্বের কাছে মাথা নত করেছিল অর্ধেক দুনিয়া, মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি, শিক্ষা-দীক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল যে জাতি তারা আজ কেন অন্য জাতির দাসত্বের শেকলে বন্দি? কেন তারা নিজেদের শক্তি, গৌরব, মর্যাদা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে? এর কারণ, যে মহান আদর্শবলে আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁর উম্মাহ গঠন করেছিলেন, যে তওহীদ-কালেমা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের উপর পুরো জাতিকে এক উম্মাহতে পরিণত করেছিলেন সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে তারা সরে গিয়েছে। দুনিয়াময় আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার যে মহান দায়িত্ব রসুলাল্লাহর (সা.) তাঁর উম্মাহর উপর অর্পণ করেছিলেন সেই দায়িত্ব বাদ দেওয়ার অনিবার্য ফলস্বরূপ মুসলমানরা আজ দুর্বল, শক্তিহীন হয়ে অন্য জাতির দাস বা গোলামে পরিণত হয়েছে। মুসলমানদের এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য অনেকেই অনেক উপায় বলছে। কেউ বলছে মুসলিমদের প্রচুর শিক্ষিত হতে হবে, কেউ বলছে তাদের ঈমান দুর্বল হয়ে গেছে, আরো বেশি নামাজ পড়তে হবে, কেউ বলছে মাতৃভাষায় কোর’আন পড়তে হবে। মাহফিলে এস্তেমায় মুসলিমদের কল্যাণকামনায় দোয়ার বন্যা বইয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনকিছুই মুসলমানদের ভাগ্য ফেরাতে পারছে না। এখন মুসলমানদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে কেবল একটি উপায়ে তা হলো, যদি তারা আবারও একমাত্র আল্লাহর তওহীদের উপর ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুনিয়াময় আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। তবেই মুসলমানদের এই শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং তারা তাদের হারানো গৌরব ও মর্যাদা ফিরে পাবে।
আল্লাহর রসুল যখন আরবে ইসলাম প্রচার শুরু করলেন তখন পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী ছিল আরবরা। রোমান ও পারস্যের শাসকরা আরবদেরকে দেখত অবহেলার চোখে। সেই আরবদের মধ্যে যখন ইসলামের আবির্ভাব ঘটল, ইতিহাসের মোড় ঘুরে গেল। রসুলাল্লাহ এসে আরবের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন গোত্রগুলোকে একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচির উপর ঐক্যবদ্ধ করলেন। অবহেলিত আরবসন্তানরা জেগে উঠল নতুন প্রাণের উল্লাসে! তাদের মাঝে এমন যুগান্তকারী সভ্যতার উন্মেষ ঘটল যার সম্মুখে সমসাময়িক সকল আদর্শ, সকল মতবাদ আবেদন হারিয়ে বর্ণহীন হয়ে গেল। পি কে হিট্টির ভাষায়, ‘সম্ভাবনাহীন উপাদান বা শূন্য’ থেকে জন্ম হলো বিরাট এক বটবৃক্ষের। সেই বৃক্ষের ছায়াতলে আসলো অর্ধ দুনিয়া। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-সভ্যতায় তারা এমন স্বর্ণযুগ প্রতিষ্ঠা করল যে বাকি বিশ্ব বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে থাকত মুসলমানদের দিকে।
কিন্তু এরপর ঘটে গেল মহা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। যে মহান আদর্শের উপর ঐক্যবদ্ধ করে দুনিয়াময় আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তিনি তাঁর উম্মাহর উপর অর্পণ করে চলে গেলেন উম্মাহ সেই দায়িত্ব ভুলে গেল। দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বাদ দিয়ে, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভুলে জাতির শাসক শ্রেণিটি অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের মতো ভোগ বিলাসিতায় ডুবে গেল। জাতির অন্য আরেকটি শ্রেণি দীনের ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে চুলচেরা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করে হাজার হাজার ফেরকা, তরিকা, মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেল। অন্য শ্রেণিটি দীন প্রতিষ্ঠার কাজকে বাদ দিয়ে আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদকে বড় জেহাদ মনে করে আত্মার ঘষামাজা চালিয়ে যেতে লাগল। এভাবে জাতির একেকটি অংশ একেকভাবে দীন নিয়ে চর্চা করে তাদের নেতার অর্পিত দায়িত্ব ভুলে গিয়ে, লক্ষভ্রষ্ট ও পথহারা হয়ে গেল। আকিদা ও লক্ষ্য হারানোর অনিবার্য ফলস্বরূপ তারা আজ অন্য জাতির কাছে পরাজিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত।
এমতাবস্থায় আমরা হেযবুত তওহীদ আবারও মানুষের কাছে ইসলামের সেই হারিয়ে যাওয়া প্রকৃত রূপটি তুলে ধরছি। মানবজীবনে বিরাজিত যাবতীয় অন্যায় অশান্তি রক্তপাত নির্মূল করে শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য যে জীবনবিধান আল্লাহ তাঁর শেষ নবীর মাধ্যমে নাজিল করেছিলেন, সেই জীবনবিধান সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হেযবুত তওহীদ মানুষকে আহ্বান করছে।
[লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ; ফোন: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]