
মোখলেসুর রহমান সুমন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মোটামুটি মাস ছয়েক বাকি। সারাদেশে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এসব নির্বাচনের উত্তেজনা-উত্তাপ সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকা ছাপিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে ইসলামি ঘরানার দলগুলো। বিশেষ করে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সরব উপস্থিতি চায়ের দোকান থেকে শুরু করে মিডিয়া পাড়া পর্যন্ত আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে। এমনকি চিরবৈরী এই দুই দলের সমর্থকরা সরকার বিরোধিতার প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের সম্ভাবনাও দেখতে শুরু করেছেন। যদিও নিজস্ব রাজনৈতিক বলয় ও মতাদর্শগত বিরোধ দূরে ঠেলে এই দুই দলের মধ্যে টেকসই ঐক্যের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, অতি সম্প্রতি ইসলামি দলগুলো যতটা উত্তাপ ছড়িয়েছে, সেক্যুলার বা বাম ঘরানার দলগুলো তা পারে নি।
রাজনীতির মাঠে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর এই সরব উপস্থিতিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অনেকেই ইতিবাচকভাবে নিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন যেখানে থেকে যায়, তা হলো, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার চর্চা এদেশে নতুন নয়। স্বাধীনতার আগে থেকেই কিছু সুবিধাবাদী শ্রেণি ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে একে ব্যবহার করে এসেছে। সম্প্রতি বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তা নতুন করে আমাদের সামনে এলো।
চরমোনাইয়ের সিনিয়র নায়েবে আমির ফয়জুল করিম এই নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে এ কথা বলতে দ্বিধা করেন না যে, তার দলকে ভোট দিলে ‘ভোটটি পাবেন আল্লাহর নবী’। এমনকি হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থীর জয়-পরাজয়ে ‘গাজী বা শহীদ ভোট’ তত্ত্বের প্রবক্তাও এই চরমোনাই। বলা চলে ধর্মকে এক ধরনের পৈত্রিক সম্পত্তি বানিয়ে তাকে রাজনীতিতে ব্যবহার করছেন তারা। যদিও এসবের মধ্য দিয়ে ধর্মের মাহাত্ম্য বা সৌন্দর্য তুলে ধরতে ব্যর্থ চরমোনাই ও অন্যান্য ইসলামিক দল।
আমরা বরাবরই দেখে এসেছি, পর্দা রক্ষার অজুহাতে নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়ার ঘোর বিরোধী চরমোনাই। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, সমাপ্ত বরিশাল সিটি নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার কাজে তারা তাদের নারী সমর্থকদের দলবেঁধে মাঠে নামিয়ে দেন। রাজনীতির মাঠে এ ধরনের পল্টিবাজি চলে, কিন্তু ধর্মকে নিয়ে পল্টিবাজি মানুষের মনে রাজনীতির পাশাপাশি ধর্মের ব্যাপারেও বিরূপ মনোভাব, অবজ্ঞা ও অনাস্থার জন্ম দেয়, এটা ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিকদের মনে রাখা উচিত।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা দেখলাম, চরমোনাইয়ের নারী সমর্থকেরা ঘরে ঘরে গিয়ে নারী ভোটারদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক, সব দলের কর্মীরাই এমনটা করে থাকেন। কিন্তু নিজেদের ভোট বাড়ানোর জন্য এখানে ইসলামি আন্দোলনের নারীরা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহারের যে চেষ্টা করেছেন, তা ছিল এক কথায় ‘জঘন্য’! তারা বহু ভোটারদেরকে দিয়ে পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁইয়ে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে, তারা যেন হাতপাখা ছাড়া অন্য কোথাও ভোট না দেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভোটের বাক্স ভরার স্বার্থে ধর্মকে নিয়ে এ ধরনের জঘন্য রাজনীতি আর কাউকে করতে দেখা যায়নি।
চরমোনাই পীরের দল বহুদিন থেকে এ দেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে আসছে, কিন্তু ধর্মের শিক্ষা তাদের মধ্যে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত তা নিয়ে প্রশ্ন আছে সাধারণ মানুষের মনে। আমরা দেখলাম, ফয়জুল করিম ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে গেলে সেখানে কর্মীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির একটা ঘটনা ঘটেছে। কারো ধাক্কায় ফয়জুল করিম কিছুটা চোটও পেয়েছেন যার ফলে তার ঠোঁটের কোনায় ও নাকে খানিকটা কেটে গেছে যা তিনি ভিডিওতে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। নিঃসন্দেহে এ ঘটনাটি নিন্দনীয়। কিন্তু এ ঘটনার পর ফয়জুল করিম যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন তাতেও মানুষ বিস্মিত হয়েছে। ঘটনার পর প্রকাশ্যে হামলাকারীদের উপর অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপর আল্লাহর গজব কামনা করতে দেখা গেছে তাঁকে। তাঁর এ আচরণের পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কি রাসুলের নীতি? সামান্য আহত হয়ে এভাবে গজব বর্ষণের অভিশাপ কি রসুলাল্লাহর শিক্ষা? নাকি এ ফয়জুল করিমের আত্মিক ও চারিত্রিক দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি, ভোটের লড়াই তাদের কাছে এক প্রকার ‘জিহাদ’। আর জিহাদের ময়দানে রক্তপাত সাধারণ ঘটনা। মার খাওয়া, মার দেওয়া, হত্যা করা, নিহত হওয়া, সবই জিহাদের অংশ। কিন্তু সামান্য একটু চোট পেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ফয়জুল করিম যেভাবে পুলিশের কাছে বিচার দিতে গিয়ে এবং গণমাধ্যমের সামনে কান্না করেছেন, তাতে বলতেই হবে তথাকথিত ‘জিহাদের ময়দানে’ খুবই দুর্বল শ্রেণির ‘মুজাহিদ’ তিনি। এতটা দুর্বলতা নিয়ে আর যাই হোক, জিহাদ হয় না। উপরন্তু যখন ধাক্কাধাক্কির ঘটনাটি ঘটে তখনই তার অনুসারীরা ‘ইয়া আল্লাহ’ বলে যেভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মাতম করেছেন তাতেও বোঝা গেছে তারা কী জাতীয় মুজাহিদ বাহিনী।
আমি আবারো বলছি, এবং পরিষ্কার ভাষায় বলছি, ফয়জুল করিমের উপর হামলার সাফাই গাওয়া কিংবা ভোটকে কেন্দ্র করে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনাকে সমর্থন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কোনো সুস্থ মানুষ ভোটকেন্দ্রিক এরকম অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে সমর্থন করতে পারে না, আমিও করছি না। কিন্তু যাদের গগণবিদারী ‘জিহাদ জিহাদ’ চিৎকার শুনে মুরিদরা আবেগে মুর্ছা যায়, কখনো আবার বাঁশ বেয়ে লাফিয়ে ওঠে, সেই পীরদের ‘ঈমানী শক্তি’ কতটুকু তা নিয়ে আমার সংশয়ের কথাটাই বলতে চেয়েছি।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মের মতো একটি পবিত্র বিষয়কে রাজনীতির নোংরা মাঠে এতটা জঘন্যভাবে ব্যবহার করার ফল কী? স্পষ্টত এর মাধ্যমে ধর্মকেও রাজনীতির মতোই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছেন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। মানুষ রাজনীতির মাঠে প্রতারণা, পল্টিবাজি, ধাপ্পাবাজি দেখে এসেছে। কিন্তু ধর্মকে মানুষ পবিত্র হিসেবেই জানে। সেই পবিত্র ধর্মকে যখন রাজনীতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে, মানুষ ধর্ম আর রাজনীতি মিলে নতুন যে রূপটা দেখতে পাচ্ছে, তা মোটেই ধর্মের জন্য ইতিবাচক নয়।
এখানে আরেকটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এসব করে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে কি না। দুনিয়ার সবচেয়ে বিশুদ্ধ, সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে পুজনীয় ব্যবস্থা মনে করে যে তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আমরা চর্চা করে এসেছি, তার কদাকার রূপটি আমরা এরই মধ্যে দেখে ফেলেছি। এই কথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতি সাধারণের কাছে এতটাই পচে গেছে যে, মানুষ ‘রাজনীতি’ শব্দটাকেই এখন ঘৃণা করে। রাজনৈতিক আলোচনা না করার জন্য হোটেল রেস্তোরায় নোটিশ টানিয়ে দেয়। এই কুৎসিত নোংরা দুর্গন্ধময় পদ্ধতিতে ধর্ম প্রতিষ্ঠা সম্ভব, এটা সুস্থ মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। আরেকটি বাস্তব সত্য হলো আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম বলতে নিজেরা যা বুঝে, সাধারণ মানুষকে ধর্ম বলতে তারা যা গেলাতে চায়, ধর্মের নামে তারা যা বিশ্বাস ও চর্চা করে, তা আদতে ধর্ম নয়। একে বরং ‘ধর্মান্ধতা’ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। এরা প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষী, আরবীয় লেবাস ও আরবি ভাষা সর্বস্ব কিছু বিষয়কে ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। আল্লাহর রসুলের কাছে ধর্মের মানে এটা ছিল না। তাঁর কাছে ‘ইসলাম’ ছিল সমস্ত পৃথিবীতে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার এক মহান মিশনের নাম। আর এ কারণেই এ দীনের নামই ‘ইসলাম’ অর্থাৎ ‘শান্তি’। চৌদ্দশ’ বছরের ব্যবধানে সেই মিশনের জায়গায় যখন দাঁড়ি, টুপি, নারী, আরবি ভাষা, আরবীয় লেবাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠলো, তখন ধর্ম আর ধর্মের জায়গাই রইলো না। ধর্মের এই বিকৃত রূপটিই এখন রাজনীতির মাঠে চর্চা করা হচ্ছে। ফলে নিজের স্বাভাবিক সুন্দর রূপ হারিয়ে ধর্ম কখনো হয়ে উঠেছে প্রতারণার কৌশল, কখনো হাসির বস্তু। আমরা মনে করি রাজনীতির মাঠে এই বিকৃত ধর্মচর্চার ফলে মানুষ রাজনীতি ও ধর্ম উভয়ের প্রতি মানুষের অনাস্থা ও অবিশ্বাস বেড়ে চলেছে। তাই ধর্মের নামে এসব ভাঁড়ামোর বিরুদ্ধে ইসলামপ্রিয় মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১০০৫০২৫]