
রিয়াদুল হাসান:
ইসলাম এসেছে সালাম শব্দ থেকে যার আক্ষরিক অর্থ শান্তি। আর রাষ্ট্র শব্দটির বুৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ধাতু ‘রাজ’ থেকে যার অর্থ রাজ্য। যে ভূখণ্ডে বা রাজ্যে আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত ও রসুলাল্লাহ কর্তৃক অনুসৃত পদ্ধতি, রীতিনীতি (সুন্নাহ) অনুসরণের মাধ্যমে মানবজীবনের সর্ব অঙ্গনে সুখ শান্তি ন্যায়বিচার, মানবতা, মানবাধিকার, সাম্য, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে সেটাই হল ইসলামি রাষ্ট্র। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ সাম্য ও ন্যায়বিচার লাভ করবে। এখানে মানবজাতির বৈচিত্র্যময়তাকে (Cultural diversity) পুরোপুরি স্বীকার করা হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ধর্ম, পোশাক-আশাক, সংস্কৃতি, ভাষা, রুচি, খাদ্যাভ্যাস ও বিশ্বাস নিয়ে কোনো জবরদস্তি বাড়াবাড়ি কোনোভাবেই করা চলবে না। প্রশ্ন আসতে পারে ইদানীং যে দেশগুলোতে শরিয়াহ আইন চালু আছে বা হয়েছিল সেগুলোর সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থার পার্থক্য কী? এই পার্থক্য বোঝার জন্য রসুলাল্লাহর (সা.) জীবনের অজস্র ঘটনা থেকে দুটো ঘটনা উল্লেখ করছি। একটি ঘটনা ইসলামের একদম প্রাথমিক যুগের আরেকটি একেবারে তাঁর জীবনের শেষ দিকের।
প্রথম ঘটনাটি হচ্ছে এমন: একদিন আল্লাহর রসুল (সা.) কা’বা শরীফের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। সময়টা ছিল অত্যন্ত কঠিন। তিনি ও তাঁর সাহাবীগণের (রা.) ওপর প্রচণ্ড বাধা এবং অবর্ণনীয় নির্যাতন নিপীড়ন চলছিল। এমন সময় একজন সাহাবা, খাব্বাব (রা.) তাঁকে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! এই অত্যাচার নিপীড়ন আর সহ্য হচ্ছে না। আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন আমাদের বিরোধীরা সব যেন ধ্বংস হয়ে যায়।’ কথাটাকে আল্লাহর রসুল যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেন। তিনি সোজা হয়ে বসলেন এবং ঐ সাহাবাকে বললেন, ‘তুমি কী বললে?’
‘ইয়া রসুলাল্লাহ! এত নির্যাতন নিপীড়ন আর সহ্য হচ্ছে না। আপনি বরং ওদের ধ্বংস হবার দোয়া করে দিন।’ - খাব্বাব (রা.) তার কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। কিন্তু আল্লাহর রসুল খাব্বাবের অনুরোধ শুনে ধ্বংসের দোয়া করলেন না। তিনি বললেন, ‘শোন, শীঘ্রই সময় আসছে যখন কোনো যুবতী মেয়ে গায়ে গহনা পরে একা সা’না থেকে হাদরামাউত যাবে। তার মনে এক আল্লাহ এবং বন্য জন্তু ছাড়া আর কোন ভয় থাকবে না।’ [খাব্বাব (রা.) থেকে বোখারী ও মেশকাত]।
এই হাদীসটি থেকেই আমরা ইসলামের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে জানতে পারি। প্রথমত, আল্লাহর রসুল উদাহরণস্বরূপ বললেন- মেয়ে লোক, কোনো পুরুষের কথা বললেন না। কারণ নারীদের প্রাণ ও সম্পদ ছাড়াও আরও একটি জিনিস হারাবার সম্ভাবনা আছে যা পুরুষের নেই। সেটা হল ইজ্জত, সতীত্ব, সম্ভ্রম। দ্বিতীয়ত, ঐ নারী বয়সে যুবতী। অর্থাৎ লোভাতুরদের কাছে আরও লোভনীয়। তৃতীয়ত, অলঙ্কার গহনা পরিহিত, চোর ডাকাতের জন্য লোভনীয়।
এতগুলো লোভনীয় বিষয় থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর রসুল বলছেন, অনুরূপ একটি অলঙ্কার পরিহিত যুবতী নারী একা সা’না শহর থেকে প্রায় সাড়ে ছয়শো কিলোমিটার দূরবর্তী হাদরামাউতে যেতে পারবে, যা অন্তত কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার, এত দীর্ঘ পথে তার ধনসম্পদ বা ইজ্জত হারানোর কোনো আশঙ্কা থাকবে না। সেই নারী কোন ধর্মের বা গোত্রের তারও উল্লেখ রসুল করেননি। অর্থাৎ, সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের নারীর জন্যই এই অভাবনীয় নিরাপত্তাটি কায়েম হবে। বর্তমানে যেসব এলাকায় শরিয়াহ আইন চালু আছে বা হয়েছিল সেসব দেশে কি নারীর চলাচলের এই অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়? হয় না। বরং পরিবারের পুরুষ সদস্য ছাড়া কোনো নারীকে বাইরেই যেতে দেওয়া হয় না।
কাজেই ইসলামের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা যেখানে কোনো হিংসাত্মক ঘটনা ঘটবে না, কোনো ভয়ভীতি, আতঙ্ক থাকবে না, নিরাপত্তাহীনতা থাকবে না। ইতিহাস সাক্ষী রসুলাল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়নি। বাস্তবেই তেমন একটি শান্তিময় ও নিরাপদ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। (আদি ইবনে হাতেম (রা.) থেকে বোখারি, হাদিস নং ৩৫৯৫)। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ মো’মেনদেরকে এমন একটি সমাজেরই ওয়াদা করেছেন। তিনি বলেছেন, সেখানে তিনি মো’মেনদেরকে শাসনকর্তৃত্ব (খেলাফত) দান করবেন, সেখানে আল্লাহর পছন্দের জীবনব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করবেন এবং তাদেরকে ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই নিরাপত্তা (আমান) দান করবেন। (সুরা নুর ২৪:৫৫)।
দ্বিতীয় ঘটনা: অষ্টম হিজরীর মক্কা বিজয়ের দিন। আজ আল্লাহর রসুল মক্কার সর্বেসর্বা, এমন কেউ নেই তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকায়। সেদিন তিনি বেলালকে (রা.) বললেন কাবার ছাদে উঠে আযান দিতে। ইতিহাস বলে- সেদিন বেলালের (রা.) ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো কাপড় ছিল না, মাথায় পাগড়ির তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু লজ্জাস্থান ঢাকার মতো এক টুকরো কাপড় কোমরে প্যাঁচানো ছিল। সেই অর্ধ-উলঙ্গ বেলালকে (রা.) আল্লাহর রসুল কাবার ছাদে উঠিয়ে দিলেন (আসহাবে রসুলের জীবনকথা-১ম খণ্ড)। তারপর বেলাল (রা.) উচ্চঃস্বরে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের আযান দিলেন। হাজার হাজার সাহাবী তখন বাধভাঙা আবেগে আপ্লুত। সেদিন মহাপবিত্র বায়তুল্লাহর উপরে দণ্ডায়মান কোরায়েশদের ক্রীতদাস বেলাল (রা.), নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি বেলাল (রা.)।
আল্লাহর রসুল অন্য কোনো উঁচু স্থানে তাঁকে ওঠাতে পারতেন, অন্য কোনো সম্মানিত কোরায়েশ সাহাবিকে ওঠাতে পারতেন। কিন্তু তিনি কাবার ছাদে উঠালেন হাবশি ক্রীতদাস বেলালকে (রা.)। এর দ্বারা তিনি মানবজাতির জন্য একটি শিক্ষা রেখে যেতে চেয়েছেন যে, মো’মেনের সম্মান আল্লাহর কাছে কাবারও ঊর্ধ্বে, যদিও বা সেই মো’মেন সমাজের সবচাইতে দুর্বল মানুষটি হয়, সবচাইতে অবহেলিত নির্যাতিত অবজ্ঞাত উপেক্ষিত মানুষটি হয়, এমনকি কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস হয়। প্রকৃতপক্ষে জাত্যাভিমানে অন্ধ কোরায়েশদের গালে এই ঘটনা ছিল এক সজোর চপেটাঘাত। এ ঘটনার দ্বারা তিনি প্রমাণ করে দিলেন, ইসলামে মানুষের মর্যাদা তার বংশগৌরব ও প্রভাব-প্রতিপত্তির মাপকাঠিতে নির্ধারিত হবে না, নির্ধারিত হবে তার চরিত্র দিয়ে, তার কর্ম দিয়ে।
এই দুটি ঘটনা থেকে আমরা ইসলাম আগমনের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য জানতে পারি। সেটি হলো, শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। এ বিষয়ে আরও একটি হাদিস উল্লেখ করা যায়, সেটি হলো- ‘রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন- ইসলাম একটি ঘর, সালাত (নামাজ) তার খুঁটি এবং জেহাদ হলো ছাদ [হাদিস- মুয়ায (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মেশকাত]।’ এখানে রসুলাল্লাহ (সা.) ইসলামকে ঘরের সাথে তুলনা করেছেন, কারণ ঘর যেমন মানুষকে প্রতিকূল আবহাওয়া, চোর ডাকাত বা জীব জন্তুর হাত থেকে রক্ষা করে, তেমনি ইসলামও একটি ঘরের মত মানবজাতিকে শান্তি ও নিরাপত্তা দেবে। অর্থাৎ ইসলামের উদ্দেশ্য এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে মানুষ তার জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা পাবে, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার থাকবে না, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা থাকবে না। সমস্ত রকম অন্যায়-অপরাধ থেকেই মুক্তি পাবে মানবজাতি। আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই কাক্সিক্ষত পরিবেশ সৃষ্টি করা যে অসম্ভব নয় সেটিও আল্লাহর রসুল তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রমাণ করে গেছেন। আজও যদি মানবজাতি আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন গ্রহণ করে নেয় তাহলে সন্দেহ নেই যে, এই ধরাপৃষ্ঠ থেকে অচিরেই সমস্ত অন্যায় ও অত্যাচারের কালিমা মুছে যাবে, সমগ্র পৃথিবী আবৃত হবে ন্যায়, সাম্য, মানবাধিকার ও নিরাপত্তার চাদরে। সেখানে বেলালের (রা.) মত নিপীড়িত মানুষেরাও মর্যাদা পাবে। একা একটি মেয়ে মানুষ শত শত মাইল পথ নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করবে।
এই দুটো ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য কী? ইসলাম কেবল মানুষের জীবনে বিধি-বিধান কায়েম করে না, বরং মানুষের আত্মায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনে, যা একটি সমাজকে শান্তিময় করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন মানুষের সম্পর্কে অপর একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের পারস্পরিক আচরণকে প্রভাবিত করে। ইসলাম যে সভ্যতা কায়েম করতে চায়, তাতে মানুষের পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এমন:
আমি যে রকম একজন মাটির তৈরি মানুষ, তেমনি সেও আমার মতো আরেকজন মাটির তৈরি মানুষ। আমাদের উভয়েরই প্রভু একজন- আল্লাহ/স্রষ্টা। আমরা উভয়ই তাঁর বান্দা।
আমরা সকলেই এক পিতা-মাতা আদম-হাওয়ার সন্তান, কাজেই আমরা এক পরিবার। আমরা ভাই-বোন। কাজেই অন্যের সাথে আমার আচরণ হবে নিজ পরিবারের মতোই।
আমার ভিতরে যেমন আল্লাহর রুহ (আত্মা) আছে, তেমনি তার ভিতরেও আল্লাহর রুহ আছে।
এই বিশ্বের আলো, পানি, মাটি, বাতাসের উপর আমার যেমন অধিকার আছে, তারও তেমন অধিকার আছে। আমরা উভয়ই বিশ্বনাগরিক হিসাবে সমান, আমরা একই জাতি।
আমি যেমন আল্লাহর খলিফা হিসাবে সৃষ্টি হয়েছি, সেও তেমনি আল্লাহর খলিফা হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সে আর আমি সম-মর্যাদার অধিকারী।
আমার যেমন বাক-স্বাধীনতা ও জীবন ধারণের অধিকার, নিজ ধর্মবিশ্বাস লালন ও প্রচারের অধিকার রয়েছে, তেমনি তারও সমপরিমাণ অধিকার রয়েছে। তাই আমি তার আল্লাহ প্রদত্ত কোনো অধিকার হরণ করতে পারি না।
এই বুনিয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিগুলো স্মরণে রেখে আল্লাহ ও তাঁর রসুল মানুষের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি (আকিদা) নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মানব! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচত হতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাবান যে অধিক মুত্তাকি।’ (সুরা হুজরাত ৪৯:১৩, সুরা নিসা ৪:১)।
বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘আজকের এই দিন ও এই মাস যেমন পবিত্র; তোমাদের জান-মাল কিয়ামত পর্যন্ত তেমনই পবিত্র। হে লোকসকল! জেনে রেখো, তোমাদের রব একজন এবং তোমাদের পিতাও একজন। জেনে রেখো, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং আরবের ওপরও অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর ওপর সাদার এবং সাদার ওপর কালোরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র ভিত্তি তাকওয়া।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৪৮৯) তিনি আরো বলেছেন, ‘সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। অতএব আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি যে তার সৃষ্টির প্রতি উত্তম আচরণ করে।’ হাদিস: বায়হাকি, মেশকাত
কাজেই মানুষের মধ্যে বিভাজন হবে মাত্র দুই প্রকার - মো’মেন ও কাফের অর্থাৎ সত্যের অনুসারী ও মিথ্যার অনুগামী। (সুরা তাগাবুন ৬৪:২)। এর বাইরে ইসলাম জাতিগত, ধর্মীয়, সামাজিক, বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, শিক্ষাগত বা আর্থিক অবস্থা (ধনী-দরিদ্র) কিংবা অন্য কোনো ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বিভেদ বা বৈষম্য সৃষ্টির অনুমতি দেয় না। ইসলামে সকল মানুষের সমান মর্যাদা এবং অধিকার স্বীকৃত, এবং এসব ভেদাভেদের সূত্র ধরে কোনো ধরনের বৈষম্য বা সংঘাত সৃষ্টির সুযোগ ইসলামে নেই।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১২৩০৯৭৫]