
সৈয়দপুর প্রতিনিধি, নীলফামারী:
নীলফামারীর সৈয়দপুরে শ্রমিক থেকে কারখানার মালিক শাহাজাদা, আলোকিত করছেন নারীদের জীবন । শ্রমিক থেকে এখন নিজেই কারখানা গড়ে তুলেছেন গোলাহাট এলাকার মোহাম্মদ শাহাজাদা। বর্তমানে তার কারখানায় কাজ করছেন ২৫ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ । মূলত তার কারখানায় সুগন্ধি ছাড়া আগরবাতি তৈরি হয়।
বিভিন্ন কোম্পানি তার কাছ থেকে আগরবাতি কিনে সুগন্ধি যুক্ত করে নিজস্ব ব্র্যান্ডে বাজারজাত করে থাকেন । শুধু শাহাজাদাই নন তার মতো আরও অনেকেই সৈয়দপুরে গড়ে তুলেছেন আগরবাতির কারখানা। আর এই আগরবাতি তৈরিতে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে সৈয়দপুরের প্রায় ১০ হাজার নারীর। প্রায় দুই যুগ ধরে তৈরি হচ্ছে এ আগরবাতি। সৈয়দপুরে অবস্থিত ২২টি বিহারি ক্যাম্পের অধিকাংশ নারীরা আগরবাতি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন।
বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, মন্দির, মসজিদ ও গির্জায় জ্বালানো হয় আগরবাতি। এছাড়া সুগন্ধি হিসেবেও অনেকে ঘরে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ব্যবহার করেন এ পণ্য। ব্যবসায়িক শহর হিসেবে খ্যাত নীলফামারীর সৈয়দপুর। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্প রয়েছে এ শহরে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ছোট ছোট অর্ধশত কারখানা। একসময় বাড়ি বাড়ি আগরবাতি তৈরি করা হতো। এখন কারখানায়ই তৈরি হচ্ছে সুগন্ধি এ পণ্য। জানা যায়, কয়লার গুড়া, কাঠের ভুসি ও বিজলার ছালের পাউডার একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় মেশিনে। এরপর সামান্য পানি দেওয়ার পর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলেই তৈরি হবে পেস্ট। সেই পেস্ট ছোট ছোট মেশিনের পাত্রে রেখে আরেক পাশে কাঠের কাঠিতে ঢুকিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন রকমের আগরবাতি। বিভিন্ন রকমের আগরবাতি তৈরির পর শুকানো হয় রোদে। এরপর পাঠানো হয় কোম্পানিগুলোতে। সুগন্ধি যুক্ত করে এসব আগরবাতি বাজারজাত করে এসব কোম্পানি।
সরেজমিন সৈয়দপুর শহরের পাড়া-মহল্লায় দেখা যায়, বাড়ির আঙিনা বা দরজার সামনে বসে ছোট মেয়ে বা নারীরা কাঠের পিঁড়িতে বসে আরেক পিঁড়ির ওপর হাত দিয়ে ঘষে আগরবাতি বানাচ্ছেন। মহাজনরা আগরবাতি তৈরির উপকরণ বাড়িতেই দিয়ে যান। এসব উপকরণ নিয়ে অবসর সময়ে বাড়ির নারী সদস্যরা আগরবাতি বানাতে বসে যান। প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ হাজার আগরবাতি বানাতে পারেন তারা। এ থেকে আয় হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এছাড়া কিছু আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে এ শিল্পে। অনেকে স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট মেশিন কিনে সেটা দিয়েও আগরবাতি তৈরি করছেন। শহরের ২২টি বিহারি ক্যাম্পের অধিকাংশ নারীসহ উপজেলার প্রায় নারী অবসর সময়ে আগরবাতি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন।
বাঁশবাড়ী এলাকার সাদরা লেনের আগরবাতি কারখানার মালিক মাসুম বলেন, আগে নারীরা হাত দিয়েই আগরবাতি তৈরি করতেন। কিন্তু যখন থেকে কারখানায় মেশিন বসিয়েছি, তখন থেকে তাদের খাটনি কমে গেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে শহরসহ উপজেলার পাড়া-মহল্লায় এমন একটা বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বাড়ির নারীরা আগরবাতি বানাচ্ছেন না। এখন তাদের খাটনি কমে গেছে, মজুরিও পাচ্ছেন ভালো।
সৈয়দপুরের বাঁশবাড়ীর ফারজান বলেন, ‘আমরা বাড়ির কাজ শেষ করে অবসর সময়ে আগরবাতি বানাই। এক দিনে ২ থেকে ৩ হাজার পিস বানাতে পারি। আগরবাতি বানিয়ে আমরা অতিরিক্ত কিছু টাকা আয় করতে পারি। যা আমরা আমাদের শখ-আহ্লাদ পূরণে খরচ করি।’
শহরের গোলাহাট বিহারি ক্যাম্পের ফরিদা পারভীন বলেন, ‘আমরা বাড়ির কাজ শেষ করে অবসর সময়ে আগরবাতি তৈরি করি। এক দিনে ২ থেকে ৩ হাজার পিস আগরবাতি তৈরি করতে পারি। মজুরি যা পাই, তা দিয়ে আমরা পরিবারের সদস্যদের শখণ্ডআহ্লাদ পূরণ করতে পারি।’ ওই ক্যাম্পের বিলকিস বলেন, ‘আগরবাতি তৈরির সঙ্গে আমি ২০ বছর ধরে জড়িত। শুরুর দিকে আগরবাতির কাঁচামাল বিভিন্ন মহল্লার নারীদের দিয়ে আসতাম। ওইসময় হাত দিয়ে তৈরি করা আগরবাতির ফিনিশিং ভালো হতো না। এখন মেশিন দিয়ে তৈরি করা আগরবাতির ফিনিশিং অনেক ভালো। এতে ব্যবহারকারীর চাহিদা বেড়েছে। নারী কারিগর আমেনা বেগম বলেন, আমি আগরবাতি কারখানায় ৮ থেকে ৯ বছর ধরে কাজ করছি। এই কাজ করে যা টাকা পাই তা দিয়ে সংসারের কিছুটা অভাব দূর হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারতেছি। তাতে করে স্বামীর ওপর কিছুটা চাপ কমে। আগরবাতি তৈরির কারিগর শমামী বলেন, ‘এ কাজের সঙ্গে আমি ৩০ বছর ধরে জড়িত। আগে আমরা কাঁচামাল বিভিন্ন মহল্লার নারীদের দিয়ে আসতাম। হাত দিয়ে তৈরি করা বাতির ফিনিশিং ভালো হতো না, এখন মেশিন দিয়ে তৈরি করা হয়, ফিনিশিংও ভালো। এতে কাজেরও গতি বেড়েছে। এক দিনে ১৫০ (১ হাজার পিসে ১ বান্ডেল) বান্ডেল তৈরি করা যায়। প্রতি বান্ডেল ৬০ টাকা দরে বাজারে কেনাবেচা হয়।’
আগরবাতি কারখানার স্বত্বাধিকারী শাহাজাদা বলেন, সৈয়দপুরের ২২টি বিহারি ক্যাম্পের অনেক নারী আগরবাতি তৈরির সঙ্গে যুক্ত। অনেক নারী এ কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। নিজেদের উদ্যোগে অনেকের বাসায় ছোট ছোট কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ শিল্পে স্বল্প ঋণ সুবিধা ও সরকারি অনুদান পাওয়া পেলে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের উপব্যবস্থাপক হুসনে আরা বলেন, উদ্যোক্তাদের আমরা সবসময় প্রাধান্য দিয়ে আসছি। আগরবাতির ক্ষেত্রেও কারিগরি প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের সহযোগিতার পাশাপাশি অর্থও দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিসিক নীলফামারী জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক চারু চন্দ্র বর্মন বলেন, এটা আমাদের বেশ খুশির বিষয় যে সৈয়দপুরে উদ্যোক্তারা আগর শিল্পের কাঁচামাল প্রস্তুত করে দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে সরবরাহ করছে। সৈয়দপুরের যেসব উদ্যোক্তা আগর শিল্প প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তার ক্ষেত্রে বিসিক নীলফামারী জেলা কার্যালয় সব সময় সহযোগিতা করবে।