
আজিমুল হক
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ২৩ বছর এবং ১৯৭১ এ স্বাধীনতার পর পরবর্তী ৫২ বছর একটা জাতির জীবনে লম্বা সময়। বিশেষ করে বর্তমান পৃথিবীর এই দ্রুত জীবনগতির পরিপ্রে¶িতে হাজার বছর আগে একটা জাতির জীবনে পাঁচ’শ বছরে যে পরিবর্তন আসত, আজ তা প্রায় পঁচিশ বছরেই এসে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশের অর্ধশত বছর বয়স কম নয়। এই অর্ধশত বছরে আমারা কী পেয়েছি? তা দেখা প্রয়োজন এবং নতুন করে পথনির্দেশিকা ঠিক করা প্রয়োজন।
স্বাধীনতার পর থেকে আমরা ইউরোপ আমেরিকার বস্তুতান্ত্রিক অগ্রগতির পেছনে দৌঁড়িয়েছি। জাতীয় চেতনা তথা দায়িত্ববোধ ভুলে গরিব জনসাধারণকে আরও দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিয়েছি পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতার অনুকরণে। ফলে দেশের মানুষের আত্মা কলুুষিত করে গরীবের শোষণের মাধ্যমে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তা সীমাবদ্ধ হয়েছে অল্পসংখ্যক লোকের হাতে। রাজনীতির বেলায়ও একই কথা। আমাদের এককালের প্রভু ব্রিটিশের রাজনৈতিক দর্শনকে হীনমন্যতাবশত অনুকরণের ব্যর্থ প্রয়াস হয়েছে। দেখা দিয়েছে চরিত্রহীন ও অপরিণামদর্শী, স্বার্থকেন্দ্রিক দলাদলি, হীন পন্থায় সরকার বদলাবদলি আর গদির কোন্দল। শি¶া¶েত্রের অবস্থা আরও শোচনীয়। স্বাধীনতার আগে যে শি¶ানীতি প্রচলিত ছিল, তা ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের তৈরি করা। তাদের নিজেদের দেশের জন্য নয়, বিশেষ করে ভারতবর্ষের জন্য। কারণ তারা দেখতে পেয়েছিলো যে, এই বিরাট দেশকে শাসন করতে যে লোক সংখ্যার প্রয়োজন তা বিলেত থেকে আমদানি করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে এদেশের মানুষকেও সত্যিকার শি¶িত করে তোলা ঠিক হবে না, তাহলে বিপদ হতে পারে। তাই তী¶্নবুদ্ধির ব্রিটিশ জাতি ভারতের জন্য এমন একটা শি¶াব্যবস্থা তৈরি করল যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। অর্থাৎ ভারতবাসীকে ইংরেজি অংক, ভূগোল, বিজ্ঞান কিছু বিকৃত ইতিহাস শি¶া দিলো, কিন্তু সাবধাণ রইল যেন কোন শত্রু সৃষ্টি না হয়। আর তারা যে এ কাজে সফল হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান কর্তব্য ছিলো পরাধীন শি¶াব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে নতুন এমন এক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যা একটা স্বাধীন জাতির জন্য প্রযোজ্য; যা দেশের ভবিষৎ নাগরিকদের শি¶িত করবে, মানুষ করবে। কিন্তু নেতারা ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে গদি নিয়ে এমন মারামারি কাটাকাটিতে ব্যস্ত রইলেন যে, তা করা আজও হয়নি। আজ কি অবস্থা? শি¶া মানে লেখাপড়া নয়। শি¶ার প্রধান দানÑ বিনয়, নম্রতা, নিষ্ঠা, সততা ইত্যাদি। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতার পরবর্তী ৫০ বছরে ৮০ জন ছাত্র খুন হয়েছে শুধুমাত্র প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ জন ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১০০ জনের বেশি (প্রথম আলো)। হাজার হাজার শি¶ক শি¶িকা লাঞ্ছিত, অপমানিত, মারধর এমনকি খুনও হয়েছেন। আর বন্দুকযুদ্ধ ছুরি মারামারি, আহততের সংখ্যার তো কোন সীমা পরিসীমা নেই, সঠিক কোন পরিসংখ্যানও নেই। এই হচ্ছে ঘৃণ্য রাজনীতির ফল।
আর আর্থিক অবস্থা? যে ব্রিটিশ জাতি দু’শতাব্দী ধরে আমাদের শাসন করল, তারা যাবার সময় তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে তাদের পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও আমাদের নেতাদের হাতে তুলে দিয়ে গেল। আর আমাদের নেতারা নির্বিচারে সেই ব্যবস্থা চালু রাখলেন, এমন কি কোন রদ-বদল পর্যন্ত করলেন না। একটি পরাধীন জাতিকে শোষণ করে তার জনসাধারণকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলাই ছিলো যে অর্থনেতিক কাঠামোর উদ্দেশ্য, সেটাই চালু রইলো একটা স্বাধীন দেশের অর্থব্যবস্থা হিসাবে।
এখন প্রশ্ন হলোÑ এমন কেন হলো? আমাদের নেতারা এমন নির্বিচারে বিদেশী সমাজব্যবস্থা কেমন করে মেনে নিয়ে তা দেশের ওপর চাপিয়ে দিলেন? এ প্রশ্ন নিয়ে লম্বা আলোচনা এ ছোট নিবন্ধে সম্ভব নয়। কিন্তু অল্প কথায় শুধু এটুকু বলা সম্ভব যে, দীর্ঘদিন পরাধীনতা এবং গোলামি শি¶ার অন্যতম ফলস্বরূপ আমরা গভীর হীনমন্যতায় ভুগছি। পাশ্চাত্য সভ্যতার সবকিছুই আমাদের কাছে চরম ভালো মনে হচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সর্বশ্রেষ্ঠ, তাদের অর্থনৈতিক সমাধানের ওপর আর কোন সমাধান নেই, মোট কথা তারাই সব, তারাই শ্রেষ্ঠ। আমরা জন্মেছি তাদেরই অন্ধ অনুসরণ করার জন্য। আমাদের কোন জীবনাদর্শ নেই, কোন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থা নেই। আমাদের বড় বড় নেতারা আর তাদের অনুসারীরা কেউ আমেরিকা, কেউ ব্রিটেন তো কেউ জার্মানির পূজারি। এই হলো পঞ্চাশ বছরের হীনমন্যতার বিকৃত মনোবৃত্তির কুফল।
ব্রিটিশের দেওয়া পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী ফলরূপে পাকিস্তান আমলে দেখা দিলো সামরিক শাসন। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসন শেষ হবার পর আমাদের আবার এক সম্ভাবনা আল্লাহ দিয়েছিলেন নতুন করে পথ বেছে নেবার। আমরা আবার ভুল করি। আমাদের মধ্যে আজ পর্যন্ত সেই ভুলকে কাটিয়ে উঠার মতো ধী-শক্তির উত্থান ঘটেনি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা আজ মোটামুটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। কয়েকটি দল পশ্চিমা গণতন্ত্র এবং ব্রিটিশ-আমেরিকা তথা পশ্চিমাদের অনুকরণে পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। কয়েকটি দল সমাজতন্ত্র এবং রাশিয়া ও চীনা কমিউনিজমকে সর্বব্যাধির মহৌষধ মনে করেন। তৃতীয় দল ইসলামি সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ মনে করেন। এই দলগুলোর আবার বেশ কয়েকটি উপদলও আছে। এখন আমাদের কী করণীয়? করণীয় হচ্ছে তাদের প্রত্যেকটি দল উপদলের ভিত্তি কি সেটা ভালো করে যাচাই করা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ম পন্থা নির্ধারণ করা।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে মতামতের কথা বললাম, তাদের প্রথম দুটি ভাগ হলো গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই দু’টিই হীনমন্যতার দরুণ বিদেশ থেকে আমদানি করা আদর্শ। মানুষ পরের জিনিস কখন গ্রহণ করে? যখন সে মনে করে তার নিজের কিছু নেই বা থাকলেও পরেরটার চেয়ে খারাপ। তখনই মানুষ পরেরটা গ্রহণ করে। দু’শো বছর শাসন করে ব্রিটিশ তার শি¶াব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের মনে বসিয়ে দিয়ে গেল যে আমাদের কোন জীবনব্যবস্থা নেই কিংবা থাকলেও তা নিকৃষ্ট। এই হীনমন্যতা থেকে আমাদের নেতারাও বাদ ছিলেন না। কারণ তারাও ঐ শি¶াই পেয়েছিলেন তাই পাকিস্তান হবার পর তাদের শেখানো সেই বস্তুবাদী পশ্চিমা ব্যবস্থাই তারা আমাদের ঘাড়ে চাপালেন। ফল কী হলো? ফল সবারই মনে আছে। বিদেশী শাসকের বিকৃত শি¶ার বিষময় ফল যে গভীর হীনমন্যতা আমাদের মন ও মগজে ঢুকেছে, বিশেষ করে আমাদের তথাকথিত শি¶িত সমাজে তা থেকে খানিক¶াণের জন্য মনকে মুক্ত করতে না পারলে আমার কথা বোঝা সম্ভব নয়।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ আছেন কি না? যদি বলেন নেই, তাহলে আর কোন কথা নেই। কারণ আমার যা কিছু বলার, তা সমস্তই আল্লাহকে ভিত্তি করে। অথব যারা মনে করেন আল্লাহ আছেন তাদের উদ্দেশ্যেই আমার পরবর্তী আলোচনা।
সৃষ্টির সর্বপ্রথম মানুষ আদম (আ.)-কে আল্লাহ নবী করে পাঠিয়েছেন এবং তাকে দান করেছেন জীবনবিধান। এমনি করে আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসূল পাঠিয়ে মানুষকে জীবনপথ দিয়েছেন। এভাবে চলে এসেছে ল¶ ল¶ বছর। তাঁরা এসে মানুষকে বলেছেন আল্লাহর জীবনবিধানকে গ্রহণ করে নিতে। মানুষ তা গ্রহণ করেছে এবং তার ফলে তাদের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত জীবন সুখে-স্বাচ্ছন্দে ভরে উঠেছে। কিন্তু তারপর কী হয়েছে? দু’চারশ’ বছর পরই মানুষের ভেতরকার শয়তান মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। অহংকার, লোভ, হিংসা, যশ এবং নেতৃত্বের মোহের বশবর্তী হয়ে তারা আল্লাহর মনোনীত জীবনবিধানের বিকৃতি সাধন করেছে, সবচেয়ে ¶তিকর যেটা করেছে তা হচ্ছে ঐ জীবন-পথের ভেতরকার আসল মর্ম ভুলে গিয়ে শুধু বাহ্যিক অনুষ্ঠান বা কঙ্কালটা নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমন কি তারা আল্লাহ্র দেওয়া গ্রন্থে নিজেদের স্বার্থপ্রণোদিত মতামত ঢুকিয়ে বা বাদ দিয়ে তার বিকৃতি ঘটিয়েছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফলরূপে দেখা দিয়েছে আবার অন্যায়, অশান্তি, রক্তপাত।
তখন আল্লাহ পুনরায় নবী পাঠিয়ে মানুষদের শান্তির পথে উঠিয়েছেন তাঁর দেওয়া জীবনব্যবস্থা দিয়ে। এই জীবনব্যবস্থা কখনও এসেছে একটা জাতির জন্য, কখনও একটা সম্প্রদায়ের জন্য, কখনও একটা গোষ্ঠীর জন্য। সে সব জীবনব্যবস্থার রূপগুলো নির্ভর করেছে সেই সেই জাতি, গোষ্ঠী বা পরিবারের অবস্থার ওপর। কিন্তু বেসিক অর্থাৎ বুনিয়াদ একই থেকেছে কিন্তু অপে¶াকৃত কম প্রয়োজনীয় আদেশ- নির্দেশগুলো ঠিক সেই সময়ের সেই অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আল্লাহ দান করেছেন। কিন্তু বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) কে আল্লাহ পাঠালেন সমগ্র মানবজাতির জন্য। তিনি এসে শেষ জীবনবিধান মানুষের সমষ্টিগত জীবনে কার্যকরী করার ফলে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি অংশ অর্থাৎ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুবিচার নিশ্চিত করেন। একজন যুবতী মেয়ে একা শত শত মাইল পথ ভ্রমণ করত, তার মনে কোন প্রকার ¶তির আশঙ্কাও জাগ্রত হত না। মানুষ রাতে শোওয়ার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না, রাস্তায় ধনসম্পদ হারিয়ে ফেললেও তা পরে যেয়ে যথাস্থানে পাওয়া যেত, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানী প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, আদালতে মাসের পর মাস কোন অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসত না এমন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
আর অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিটি মানুষ এমনভাবে স্বচ্ছল হয়েছিল যে, মানুষ যাকাত ও সদকা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মতো লোক পাওয়া যেত না। শহরে নগরে লোক না পেয়ে মানুষ মরুভূমির অভ্যন্তরে যাকাত দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াত। মানবরচিত কোন জীবনব্যবস্থাই এর একটি ভগ্নাংশও মানবজাতিকে উপহার দিতে পারে নাই। এই অকল্পনীয় শান্তিময় অবস্থা কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল? এর একমাত্র কারণ, মানুষ মানবরচিত সকল ব্যবস্থা, বিধান প্রত্যাখ্যান করে তার স্রষ্টার দেওয়া জীবনব্যবস্থা গ্রহণ এবং জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে সামগ্রিকভাবে প্রয়োগ করেছিল অর্থাৎ ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া আর কারও বিধান গ্রহণ করি না) এই মূলমন্ত্রের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করেছিল।
এখানে আমি যে জীবনব্যবস্থা (দীন) প্রতিষ্ঠার কথা বলছি আর বর্তমানে ইসলাম বলে যে ধর্মটি চালু আছে এই দু’টি এক জিনিস নয়। আমি সেই প্রকৃত ইসলামের কথা বলছি যা আল্লাহ তাঁর নবী-রসুলের মাধ্যমে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, যে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে অর্ধ-দুনিয়ার মানুষকে অতুলনীয় শান্তি ও নিরাপত্তার স্বর্ণযুগ উপহার দিয়েছিলো। সেই প্রকৃত ইসলাম গত চৌদ্দশ বছরের কালপরিক্রমায় বিকৃত হতে হতে বর্তমানে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। তথাকথিত আলেম শ্রেণী এই বিকৃত ইসলামটিকে তাদের রুটি রুজির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। এখন মানবরচিত সমস্ত ব্যবস্থা, তন্ত্র ব্যর্থ হবার পর আল্লাহর দেওয়া দীন (জীবনব্যবস্থা) আবার কার্যকরী করে দেখা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই মানবজাতির সামনে সেটা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।