
বাংলাদেশের বৃহত্তর নৃগোষ্ঠী ত্রিপুরাদের মাতৃভাষা ‘ককবরক’ ভাষায় অনূদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি। প্রায় দুই বছর ধরে এই পাণ্ডুলিপিটি অনুবাদ করেছেন শ্রীমঙ্গলের ডলুছড়া ত্রিপুরাপল্লীর সদস্য ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী যুবরাজ দেববর্মা। তিনি ‘ককবরক’ ভাষায় বইটির নাম দিয়েছেন ‘পাইথাকয়া লাংমা’। যার এর অর্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
পৃথিবীর প্রায় ২০টি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাণ্ডুলিপিটি অনূদিত হলেও দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষায় প্রথম। প্রথম জাতির পিতার পাণ্ডুলিপি অনুবাদ করতে পেরে উচ্ছ্বাসিত দেববর্মা। তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করা যাবে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসা এসব নৃগোষ্ঠী ভাষার শব্দগুলোও ফিরিয়ে আনা যাবে। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ২০২০ সালকে মুজিব শতবর্ষ ঘোষণা করেন সেসময় থেকেই আমার মধ্যে নিজের জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কিছু করার ইচ্ছা জাগে। তাই অনুবাদের পথটি বেছে নেয়া। যেন এক সঙ্গে নিজেদের ভাষাকেও উপস্থাপন করতে পারি, পাশাপাশি যে মানুষটা মহান স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তার আদর্শটাও একটু ভিন্নভাবে ছড়িয়ে দিতে পারি। এছাড়াও বর্তমানে ককবরক ভাষাটি বিলুপ্তপ্রায়। আমাদের পরের প্রজন্ম হয়তো আর এ ভাষার অনেক অর্থই জানবে না। তাই নিজেদের ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াসও বলা যায় এটাকে।’ মাত্র দুই বছর সময়ে ৩৩৩ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিটি অনুবাদ করেন তিনি। কিভাবে কাজ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ একজন ছাত্রের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে কি রকম চাপ থাকে তা আপনারা জানেন। এতকিছু সামলে কাজটা করার মূহুর্তগুলো বলে বুঝাতে পারব না। একটা সময় মনে হয়েছিল হাল ছেড়ে দেই, আমার পক্ষে সম্ভাব না। কিন্তু কিছু মানুষের অনুপ্রেরণা আমাকে পুরো পাণ্ডুলিপিটি অনুবাদ করতে সাহস যুগিয়েছে।’ এবার পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ করতে চান যুবরাজ দেববর্মা। এরই মধ্যে কয়েকটি জায়গায় যোগাযোগও করেছেন তিনি। জানতে চাইলে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কিউরেটর, সাবেক শিক্ষা সচিব ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে তার সহকারীর মাধ্যমে যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছেন, আমাকে জানাবে। বাকিটা স্যারের সঙ্গে কথা বলার পর বলতে পারব।’
শিক্ষার্থীর এমন অর্জনে উচ্ছ্বাসিত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও কুবি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এন এম রবিউল আউয়াল চৌধুরী বলেন, ‘বিভাগের শিক্ষার্থী থাকাকালে সবসময়ই সে একটু ভিন্নধর্মী চিন্তা করত, তারই একটা রিপ্লেকশন বলা যায় এটা। আর বঙ্গবন্ধু চিন্তাভাবনা আমরা যতবেশি মানুষকে জানাতে পারব ততোই কল্যাণ। আর এটা যেহেতু সে তাদের ভাষায় করেছে সেহেতু তাদের জাতিগোষ্ঠীর জন্যও বঙ্গবন্ধুকে জানতে সহজ হবে।’প্রসঙ্গত, ত্রিপুরারা ভারতীয় উপমহাদেশের এক প্রাচীন জাতি। পাহাড়, বন ও প্রকৃতিকে আঁকড়ে বসবাস করা এ নৃগোষ্ঠীটি বাংলাদেশের তিন পার্বত্য অঞ্চল ছাড়াও সমতল এলাকার কুমিল্লা, সিলেট, চাঁদপুর, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর অঞ্চলে বসবাস করে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশেপ্রায় দুই লাখ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস। ত্রিপুরা রাজাদের ১ হাজার ৩৬৮ বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হলেও ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের পর এ ভাষা অবহেলার শিকার হয়। তবে ১৯৭৯ সালে ‘ককবরক’ আবার ত্রিপুরা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে পড়ালেখার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি।