
রুফায়দাহ পন্নী:
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পরিবার টাঙ্গাইলের করটিয়ার পন্নী পরিবার। অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী এই পরিবারে ১৯২৫ সনের ১১ মার্চ শবে বরাতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর চরিত্রে ছিল আধ্যাত্মিক ও জাগতিক গুণাবলীর অপূর্ব সংমিশ্রণ। তিনি ছিলেন সত্যের মূর্ত প্রতীক। ঘটনাবহুল ৮৬ বছরের জীবনে তাঁর একটি মিথ্যা বলারও নজির নেই।
সুলতানী যুগে গৌড়ের সুলতান (কররানি যুগ) হিসাবে, মুঘল আমলে আতিয়া পরগনার সুবেদার হিসাবে এবং ব্রিটিশ যুগে করটিয়ার সুবৃহৎ এলাকার জনদরদি জমিদার হিসাবে এই ঐতিহ্যবাহী আফগান পন্নী পরিবার শাসনকার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলার সালতানাতকে মুঘল আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে গিয়ে সুলতান দাউদ খান কররানি ঐতিহাসিক রাজমহলের যুদ্ধে (১৫৭৬) প্রাণ উৎসর্গ করেন। বাংলার মুসলমানদের নবজাগরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল পন্নী জমিদারগণ। এমামুয্যামানের প্রপিতামহ হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা ‘মাহমুদিয়া যন্ত্র’ থেকে মৌলভী নইমুদ্দিন অনূদিত পবিত্র কোর’আনের প্রথম বঙ্গানুবাদ (২৩ পারা) প্রকাশ করেন। এই ছাপাখানা থেকেই তিনি প্রকাশ করতেন ‘আখবারে এসলামীয়া’ নামে মাসিকপত্র যা বাংলার মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার পক্ষে কথা বলত। প্রাচ্যের আলীগড় বলে খ্যাত ‘সা’দাত কলেজের’ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওয়াজেদ আলী খান পন্নী। তিনি প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি। এমন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা এবং অর্থদাতা নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ছিলেন এমামুয্যামানের মায়ের নানা।
তাঁর ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বগুড়া (এমামুয্যামানের খালু) ছিলেন সমগ্র পাকিস্তানের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৩-১৯৫৫)। পাকিস্তান আমলেও মাননীয় এমামুযযামানের পরিবারের আরো অনেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। চাচাতো ভাই খুররম খান পন্নী ছিলেন আইন পরিষদের চিফ হুইপ ও ফিলিপাইনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। আরেক চাচাতো ভাই হুমায়ুন খান পন্নী ছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার। ভ্রাতুষ্পুত্র ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী। এমামুযযামানের মায়ের মামা সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী। এমনিভাবে আরো বহু বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল করটিয়ার এই জমিদার পরিবার।
শিক্ষাজীবন:
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় করটিয়ার রোকাইয়া উচ্চ মাদ্রাসায়। দুই বছর মাদ্রাসায় পড়ার পর তিনি ভর্তি হন এইচ. এম. ইনস্টিটিউশনে। এখান থেকে তিনি ১৯৪২ সনে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর সা’দাত কলেজে কিছুদিন পড়ে ভর্তি হন বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে। দ্বিতীয় বর্ষে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চ মাধ্যমিক সমাপ্ত করেন।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এমামুয্যামান:
কলকাতায় তাঁর শিক্ষালাভের সময় কলকাতা ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। তরুণ এমামুয্যামান ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেই সুবাদে তিনি এই সংগ্রামের কিংবদন্তিতুল্য নেতৃবৃন্দের সাহচর্য লাভ করেন যাঁদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদি, কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্, অরবিন্দু ঘোস, শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী অন্যতম। তিনি আল্লামা এনায়েত উল্লাহ খান আল মাশরেকীর ‘তেহরীক এ খাকসার’ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি খুব দ্রুত তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের ছাড়িয়ে পূর্ববাংলার কমান্ডারের দায়িত্ব লাভ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি দুঃসাহসী কর্মকাণ্ড ও সহজাত নেতৃত্বের গুণে সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে ঝঢ়বপরধষ অংংরমহসবহঃ এর জন্য নির্বাচিত ৯৬ জন ‘সালার-এ-খাস হিন্দ’ এর অন্যতম হিসাবে মনোনীত হন। তখন এমামুয্যামানের বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। দেশভাগের অল্পদিন পর তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
চিকিৎসক ও সমাজসেবক:
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর তিনি হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং কর্মজীবনে তিনি দেশসেরা একজন হোমিওপ্যাথে পরিণত হন। ১৯৫৬-১৯৫৮ সনের কলেরা মহামারীর সময় তিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাজার হাজার মানুষকে ভ্যাকসিন প্রদান করেন। ১৯৬৩ সনে তিনি করটিয়ায় হায়দার আলী রেডক্রস ম্যাটার্নিটি এ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ার হসপিটাল প্রতিষ্ঠা করেন যার দ্বারা এখনও উক্ত এলাকার বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মেডিকেল বোর্ডে তিনিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠারও তিনি ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। ১৯৯৮ সনে তিনি সা’দাত ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন নামে প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান আবু সাঈদ চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি তাঁর রোগীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
দুর্ধর্ষ শিকারী:
বাল্যকাল থেকে সত্তর দশকের গোড়া পর্যন্ত তিনি পাহাড়ে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বহু হিংস্র পশু শিকার করেছেন। তাঁর লেখা ‘বাঘ-বন-বন্দুক’ বাংলাদেশের জঙ্গলে শিকারের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা প্রথম বই যা শহীদ মুনির চৌধুরীর সুপারিশে দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
চৌকস ক্রীড়াবিদ:
তিনি ছিলেন একজন শ্যুটার, ফুটবলার ও মোটর সাইকেল স্ট্যান্ট। ১৯৫৬ সালে তিনি মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অলিম্পিকে জাতীয় দলের অন্যতম শ্যুটার হিসাবে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডিকে আবার জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তিনি ‘তওহীদ কাবাডি দল’ প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি দেশজুড়ে বহু টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে এবং জাতীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্টেও কৃতিত্বের পরিচয়ও দিয়েছে।
লেখক ও প্রকাশক:
বেগম সুফিয়া কামাল এমামুয্যামানের নিকটাত্মীয় ছিলেন। তার কাব্যগ্রন্থ ‘মন ও জীবন’ এর প্রকাশক ছিলেন এমামুয্যামান (১৯৫৭)। পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৮ সনে তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ‘তওহীদ প্রকাশন’। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা ৯, এর মধ্যে এ ইসলাম ইসলামই নয়, দাজ্জাল? ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’!, ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা, ইসলামের প্রকৃত সালাহ, ঞযব খড়ংঃ ওংষধস উল্লেখযোগ্য।
পার্লামেন্টের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য:
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক যুগ পরে এমামুযযামান আবার রাজনীতিতে ফিরে আসেন। ১৯৬৩ সনে টাঙ্গাইল-বাসাইল এলাকা থেকে ছয়জন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত করে তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য (এম.পি.) নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সনে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের উপর হামলা ও গণহত্যা আরম্ভ হয়। এমামুযযামান দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলোয় গিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঙ্গা প্রতিহত করেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেকে রাজনীতি থেকেই পুরোপুরি গুটিয়ে নেন, কারণ প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না।
নজরুল একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য:
সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তাঁর ছিল দৃপ্ত পদচারণা। তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীত ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। জাতীয় কবি নজরুলও ছিলেন একই গুরুর শিষ্য। নজরুলের কীর্তি সংরক্ষণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত নজরুল একাডেমীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি।
হেযবুত তওহীদ প্রতিষ্ঠা:
বুদ্ধি হবার পর থেকেই তিনি দেখতে পান সমস্ত মুসলিম জগৎ কোনো না কোনো পাশ্চাত্য প্রভুর গোলাম, যারা কিনা এক সময় জ্ঞানে বিজ্ঞানে, সামরিক অর্থনৈতিক শক্তিতে সমগ্র দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। তাদের এই করুণ পরিণত কেন হল? একসময় আল্লাহর অশেষ রহমে এ প্রশ্নের জবাব তিনি পেতে আরম্ভ করলেন। একটু একটু করে, সারা জীবন ধরে তিনি বুঝতে পারলেন কোথায় সে শুভঙ্করের ফাঁকি, যে ফাঁকিতে পড়ে আজ যাদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হবার কথা, তারা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম জাতিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বুঝলেন, চৌদ্দশ বছর আগে মহানবী (সা.) যে দীনকে সমস্ত জীবনের সাধনায় আরবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে দীনটি আর আজ আমরা ‘ইসলাম ধর্ম’ বলে যে দীনটি অনুসরণ করি এ দু’টি দীন পরস্পর-বিরোধী, বিপরীতমুখী দু’টো ইসলাম। ফলে রসুলের নিজ হাতে গড়া জাতিটি এবং বর্তমানের মুসলিম জনসংখ্যাটিও সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। ইসলামের সঠিক আকিদা, তওহীদের মর্মবাণী, এবাদতের অর্থ, মো’মেন, মুসলিম, উম্মতে মোহাম্মদী হবার শর্ত, হেদায়াহ-তাকওয়ার পার্থক্য, সালাতের (নামাজের) সঠিক উদ্দেশ্য, দাজ্জালের পরিচয়, দীন প্রতিষ্ঠার তরিকা, পাঁচ দফা কর্মসূচি এবং কীভাবে তাকে প্রয়োগ করতে হয় ইত্যাদিসহ আরো বহু বিষয় তিনি আল্লাহর দয়ায় বুঝতে পারলেন।
১৯৯৫ সনে তিনি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রচারের এ প্রয়াসকে সাংগঠনিক রূপ দিতে ‘হেযবুত তওহীদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ আন্দোলনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, পশ্চিমা সভ্যতার ব্যর্থতার কারণ যেমন তুলে ধরেন, তেমনি প্রকাশ করেন ইসলামের সামগ্রিক ধারণা। উগ্রবাদ ও ধর্মান্ধতার মোকাবেলা করতে গিয়ে তিনি তাঁর নিজের সমস্ত সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন এবং সামাজিক অবস্থানকে নির্দ্বিধায় পরিত্যাগ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সারাদেশে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলে উগ্রবাদী ধর্মান্ধ শ্রেণী। ফলে একাধিকবার তাঁকে বৃদ্ধ বয়সে গ্রেফতারও করা হয়েছে। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাহায্যে হেযবুত তওহীদ নিরন্তরভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হাজার বছরের ফিকাহ, তাফসির আর ফতোয়ার পাহাড়ের নিচে যে সহজ-সরল (সিরাতুল মুস্তাকিম) ইসলাম চাপা পড়ে রয়েছে সে ইসলামকে তার মৌলিক, অনাবিল রূপে উদ্ধার করে মানুষের সামনে উপস্থিত করতে।
শেষ উপদেশ:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের হেদায়াহ দান করেছেন। আল্লাহ তাঁর রসুলকে (সা.) যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে বলেছিলেন সেই ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আমাদেরকে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে তা এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ না করার নির্দেশ দিয়ে ২০১২ সনের ১৬ জানুয়ারি মাননীয় এমামুয্যামান আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার গোড়াইতে অবস্থিত পারিবারিক গোরস্তানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আল্লাহ তাঁকে চিরশান্তিতে রাখুন।