
এইচ এম রাকিব, নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা গতকাল মঙ্গলবার উদযাপন করেছেন মহানবমী পূজা। দিনভর রাজধানীর পূজামণ্ডপগুলোয় ছিল ভক্ত-দর্শনার্থীদের ঢল। মণ্ডপে মণ্ডপে ভক্তরা দিয়েছেন অঞ্জলি ও ভোগ। নবমী পূজা ও সন্ধ্যা আরতি শেষে বাজতে শুরু করেছে বিদায়ের সুর। আজ বুধবার বিজয়া দশমীতে ভক্তদের কাঁদিয়ে কৈলাসে ফিরে যাবেন দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা। প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাঁচ দিনের দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয় গত শনিবার (১ অক্টোবর)। টানা পাঁচ দিনের আনন্দ উৎসবের পর আজ বুধবার বিজয়া দশমীর দিন দেবী বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে এই আয়োজন। গতকাল মঙ্গলবার মহানবমীর সন্ধ্যায় আরতি শেষে দেবীর বন্দনায় প্রতিটি পূজামণ্ডপে বিষাদের সুর বাজতে শুরু করে। তার আগে সকাল ৬টায় শুরু হয় নবমী পূজা। সকাল সাড়ে ১০টায় দেওয়া হবে পুষ্পাঞ্জলি। সকাল ১০টায় কল্পারম্ভ ও বিহিতপূজার মাধ্যমে শুরু হয় নবমীর আনুষ্ঠানিকতা। পূজা শেষে ভক্তরা দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করেন। দিনভর চলে চণ্ডীপাঠ আর ভক্তদের কীর্তন-বন্দনা। হিন্দু শাস্ত্র মতে, নবমী তিথিতে রাবণবধের পর শ্রী রামচন্দ্র এই পূজা করেছিলেন। নীলকণ্ঠ ফুল যজ্ঞের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় নবমী বিহিতপূজা। নবমী পূজার মাধ্যমে সম্পদ লাভ হয় মানবকুলে। তাই শাপলা, শালুক ও বলিদানের মাধ্যমে পূজা হয়েছে দশভুজা দেবীর। নীল অপরাজিতা ফুল নবমী পূজার বিশেষ অনুষঙ্গ। নবমী পূজায় যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহুতি দেওয়া হয়। ১০৮টি বেলপাতা, আম কাঠ ও ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে দেখা যায় বৃষ্টি উপেক্ষা করে, অঞ্জলি দিতে পূজামণ্ডপে এসেছেন ভক্তরা । সব মণ্ডপে দেওয়া হয় কয়েক দফা পুষ্পাঞ্জলি। বিদায় বেলায়ও চলেছে ঢাক আর শঙ্খধ্বনি, টানা মন্ত্রপাঠ, উলুধ্বনি, অঞ্জলি, সঙ্গে ধুনচি নৃত্য। সন্ধ্যায় আরতির পাশাপাশি মণ্ডপে মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করতে বৃষ্টি উপেক্ষা করে মহানবমীতে মন্দির ও মণ্ডপে ছিল ভক্ত-দর্শনার্থীর উপচে পড়া ভিড়। রাজধানীর উত্তরা তিন নম্বর সেক্টর মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই অনেক ভক্ত অঞ্জলি দিচ্ছেন। ওই মণ্ডপে শ্যামলী নামের এক ভক্ত জানান, সরাসরি মণ্ডপে এসে অঞ্জলি দেওয়ার মর্যাদা আলাদা। ভক্তদের প্রার্থনায় সকল রোগ যরা শেষ করে সমৃদ্ধি নিয়ে আসে বাংলাদেশের জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যেন প্রতিষ্ঠিত হয় এই কামনা ছিলো দেবি ভক্তদের। অনেকটা একই চিত্র দেখা গেছে জয়কালী মন্দির, বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির, রমনা কালীমন্দির, শ্যামবাজার শিবমন্দির, খামারবাড়ি মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, স্বামীবাগ ইসকন মন্দিরসহ নগরীর অন্য মণ্ডপগুলোতে। অবশ্য ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে ভিড় ছিল বেশি। সন্ধ্যার পর এই ভিড় আরো বাড়তে থাকে।
আজ বিজয়া দশমীতে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ নিবন্ধ। গত দু্ইবছর করোনা মহামারির কারণে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয়েছিলো। উৎসব সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরিহার করে সাত্ত্বিক পূজায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিলো। সন্ধ্যায় আরতির পরই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো পূজামণ্ডপ। ছিলো না সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা। স্বাস্থ্যবিধির দিকে খেয়াল রেখে পূজায় প্রসাদ বিতরণ ও বিজয়া দশমীর শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। কিন্তু এবছর করোনা পরিস্থিত স্বাভাবিক থাকায় যথাযথ ভাবেই বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা উদযাপন করেছে শারদীয় দুর্গাপূজা।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক, সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি মনীন্দ্র কুমার নাথ, সাবেক সভাপতি ও সাবেক সচিব শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার, উপদেষ্টা জয়ন্ত সেন দীপু, নারীবিষয়ক সম্পাদক পদ্মাবতী দেবী ও সদস্য দীপালি চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন। এসময় বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক বলেন, আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক হিসেবে আলাদা করে পরিচিত হতে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। এ চিন্তা-চেতনা বাহাত্তরের সংবিধান পরিপন্থি। ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে কাজ করলেও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা খুবই কম। এ বৈষম্য দূর করতে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বানন জানান।
অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে দুর্গাপূজার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সারাদেশের মণ্ডপগুলোতে ২৪ ঘণ্টা আনসার সদস্যদের রাখা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। সচিবালয়ে গত রোববার দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত সভাশেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। দুর্গাপূজায় কোনো নিরাপত্তা শঙ্কা আছে কিনা—এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দাদের কাছে তেমন কোনো খবর নেই। এবার সব মণ্ডপে আনসার স্থায়ীভাবে থাকবে। ‘আমরা বলেছি, প্রতিটি মণ্ডপে সিসিটিভি থাকতেই হবে। পাশাপাশি নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক থাকবে।’ এসব ব্যবস্থার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতও তৎপর থাকবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দেশে পূজা করতে পারবে না, বড়দিন করতে পারব না, বৌদ্ধপূর্ণিমা হবে না বা ঈদ হবে না— এটি কখনো করতে দেওয়া হবে না।’