
পৃথিবীর সকল শান্তিকামী মানুষকে জানাই পবিত্র ঈদুল আজহার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা, মোবারকবাদ ও স্বাগতম। ঈদ শব্দের অর্থ খুশি বা আনন্দ যা ফিরে ফিরে আসে, আর আজহা শব্দের অর্থ ত্যাগ। অর্থাৎ ঈদুল আজহা হলো আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ করতে পারার আনন্দ। এই ত্যাগের মাধ্যমে সুখী হওয়ার শিক্ষালাভের দিন হলো ঈদুল আজহার দিন।
প্রতিবছর এমন সময় বছরের ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টে আসে এই জিলহজ মাস। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হয় ঈদুল আজহা। কোটি কোটি পশু কোরবানি হয়। লক্ষ লক্ষ হাজি জমায়েত হয় পবিত্র ঘর কাবায়। হাজিদের লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় কাবা প্রাঙ্গণ।
এত ইবাদত, এত প্রার্থনা কিন্তু মুসলিম বিশ্বের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। মুসলিম বিশ্বের অবস্থা কত ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঐক্যহীন, লক্ষ্যহীন, নেতৃত্বহীন এই জনগোষ্ঠী সারা বিশ্বে আজ নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। মুসলিম দেশগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফিলিস্তিনে চলছে গণহত্যা। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী গত কয়েকমাসে প্রায় আটত্রিশ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। এরপরও তাদের হত্যার নেশা বন্ধ হচ্ছে না। সারা বিশ্বে কোটি কোটি মুসলমান আজ উদ্বাস্তু।
বাংলাদেশসহ মুসলিম দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই ভয়াবহ। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হানাহানি, অনৈতিকতায় ছেয়ে আছে সর্বত্র। সুদের জালে পেচিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ধুঁকছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সিন্ডিকেটের কবলে বাণিজ্য ব্যবস্থা। দেশের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। সংসদ সদস্যরা খুন হচ্ছে নৃশংসভাবে। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য। মানুষ আজ দিশেহারা, পাগলপাড়া। মুক্তির পথ তারা দেখছে না।
১৪শ’ বছর আগে আইয়্যামে জাহিলিয়াতে আরবের সমাজেও ঠিক একই দৃশ্য ছিল। সমাজের সার্বিক অবস্থাও ছিল এমনই করুন। তখন আল্লাহ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-কে প্রেরণ করলেন হেদায়াহ ও সত্যদীন দিয়ে (সুরা সফ ৯, ফাতাহ ২৮, তওবাহ ৩৩) যেন তিনি সে দীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমস্ত মানবজাতির মধ্য থেকে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, জুলুম- এক কথায় সকল অশান্তি নির্মূল করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম, কঠোর অধ্যবসায় ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে আরবের আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার দূর করে একটি ন্যায় ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করলেন। ঐক্যহীন, পারস্পরিক দাঙ্গায় লিপ্ত, অশিক্ষা-কুশিক্ষা চর্চাকারী, পশ্চাৎপদ ও অন্ধকারে নিমজ্জিত এক জাতিকে তিনি এমন এক জাতিতে পরিণত করলেন যারা ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ, অকুতোভয়, সুসভ্য, যুক্তিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক ও সুশৃঙ্খল। তাহলে প্রশ্ন আসা কি স্বাভাবিক নয় যে, এ আমূল পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? এ আমূল পরিবর্তন সম্ভব হওয়ার মূল কারণই ছিল আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য। এক আল্লাহকে ইলাহ বা হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নেয়ার ফলে সকলেই তাঁর হুকুমের আনুগত্য শুরু করল আর ফলস্বরূপ শত্রু ভাইয়ে পরিণত হলো, অভাব ও দারিদ্র্য বিমোচন হলো এবং সর্বত্র সমৃদ্ধি, প্রগতি ও শৃঙ্খলা পরিদৃষ্ট হলো।
আমরাও সেই কাজটিই করছি। আমাদের দেশেরপত্র পত্রিকার মধ্য দিয়ে আমরা সেই মুক্তির পথ তুলে ধরছি। এটি কোনো বিজ্ঞাপনসর্বস্ব বাণিজ্যিক পত্রিকা নয়। এই পত্রিকার মাধ্যমে মানুষকে আমরা প্রকৃত কালেমার দিকে, এক আল্লাহর হুকুমের দিকে ডাকছি। মানুষের মুক্তির বার্তা তুলে ধরতেই এই পত্রিকা ছাপা হয়।
সবাই যখন ঈদকে ঘিরে আনন্দ, উৎসবে মেতে আছে। পরিজন, আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগী করছে তখন আমরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পথে পথে ছুটে বেড়াচ্ছি মানুষের কাছে মুক্তির বার্তা পৌঁছে দিতে। এটাই আমাদের ঈদ, এই আমাদের আনন্দ।
আজকের এ পবিত্র দিনে ইব্রাহিম (আ.) ঘটনার মূল শিক্ষা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমি বলতে চাই- তিনি যেরূপ নেক নিয়তে, পরিশুদ্ধ হৃদয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রাণপ্রিয় পুত্রকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেছিলেন, ঠিক তেমনি, আমাদেরকেও এখন একইভাবে নিজেদের জীবন, সম্পদ ও জ্ঞানকে মানুষের মুক্তির জন্য, শান্তির জন্য মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করতে হবে। এটিই হবে আমাদের প্রকৃত কোরবানি। আমাদের সৃষ্টির ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না, ভুললে চলবে না আমরা একই বাবা মা আদম (আ.) ও হাওয়ার সন্তান। আমাদের ধর্ম-বর্ণ-দেশ আলাদা হতে পারে কিন্তু আদিতে আমরা সকলেই এক জাতি, একই পরিবারের সদস্য। কাজেই আমি আশা করব, কোরবানির এ প্রকৃত শিক্ষা আমরা সকলেই উপলব্ধি করব এবং আমাদের বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করব।
বর্তমানে কোরবানির প্রকৃত আকিদা বিকৃত হয়ে গেছে। কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে আজকের সমাজের মুসলিমরা পুরোপুরিভাবেই অসচেতন। ইসলামে প্রত্যেকটি কাজের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যবিহীন কোন কিছুরই কোন মূল্য থাকে না। কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা আছে, গরু জবাই হচ্ছে, ঈদের নামাজ পড়া হচ্ছে সবই হচ্ছে কিন্তু আত্মিক পরিশুদ্ধির বিষয়টি হচ্ছে না, জীবনের লক্ষ্যে কোনো পরিবর্তন আসছে না। এর কারণ আজকের সমাজে যারা কোরবানি করেন, তাদের কেউ নিজেকে অতি উত্তম মুসলিম পরিচয় দেওয়ার জন্য কোরবানি করেন, তাদের কোরবানি মূল লক্ষ্যই থাকে লোকদেখানো এবং গোশত খাওয়া।
কিন্তু আল্লাহর নির্দেশিত কোরবানি হলো দীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন সম্পদের মায়া ত্যাগ করা, শুধুমাত্র পশু জবাই করে গোশত খাওয়া নয়। এই জাতি গত ১৩শ’ বছরে কত কোটি গরু-ছাগল আর উট বকরি জবাই করেছে তার কোনো হিসাব নেই। যদিও আমরা এইগুলিকে কোরবানি বলছি কিন্তু এই কোরবানি আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য এনে দেওয়া দূরে থাক, তিনি আমাদের দিকে সামান্য দৃষ্টিপাতও করছেন না। যদি করতেন তাহলে দুনিয়াজোড়া এদের প্রতি এই লানত, অভিশাপ ও গজব থাকতো না। অন্যায়, অবিচার, হানাহানি, ষড়যন্ত্র, মিথ্যা, প্রতারণা, যুদ্ধ, রক্তপাত এক কথায় ভয়াবহ অশান্তি বিরাজ করতো না এবং এ জাতিও পৃথিবীর সকল জাতির হাতে এখাবে লাঞ্ছিত হতো না। কাজেই এই অন্যায়পূর্ণ সমাজ থেকে উত্থিত অসহায় মানুষের হাহাকার বলে দেয়, আল্লাহর দরবারে এই কোরবানি কবুল হচ্ছে না।
ঈদ-উল-আজহারে এই দিনে, আনন্দের এই দিনে সবার আগে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের জীবন ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার শপথ নেওয়া। তাহলেই এই জাতির সকল প্রকার আমল আল্লাহ কবুল করবেন। এটিই মোমেনদের প্রকৃত কোরবানি। প্রার্থনা করি আল্লাহ সকলকে ইসলামের সত্য অনুধাবন ও কোরবানির শিক্ষা ধারণ করার তওফিক দিন। আমিন।
[লেখক: হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম, এমাম, হেযবুত তওহীদ। যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১-৫৭১৫৮১]