
এইচ এম রাকিব:
দেশে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে টানা বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে রোগীর চাপ। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারা দেশে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু রোগীর যে হিসাব দিচ্ছে, বাস্তবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আক্রান্তের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালের পুনরাবৃত্তি হতে পারে, যা পরিস্থিতি জটিল করতে পারে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে তাদের।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড ৬৩৫ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে গত ২৮শে সেপ্টেম্বর দেশে একদিনে সর্বোচ্চ ৫২৪ ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়েছিল। এ নিয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুরোগী সংখ্যা দাঁড়াল ২ হাজার ১৫৮ জনে। এ সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ভর্তি হওয়া ৬৩৫ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫১৮ এবং ঢাকার বাইরে ১১৭ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৫৮ জনে।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু বাংলাদেশে বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে আছে। ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিবছর বহু মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, মানুষ মারাও যাচ্ছে। ২০১৬ সালে সারা দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ৬ হাজার ৬০ জনের। এর মধ্যে ঢাকায় শনাক্ত হয় ৬ হাজার ২৩ জনের, ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয় ৩৭ জনের। ২০১৭ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ২ হাজার ৮৮৫ জনের। এর মধ্যে ঢাকায় শনাক্ত হয় ২ হাজার ৭৬৯ জনের, ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয় ১১৬ জনের। ২০১৮ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১০ হাজার ১৬২ জনের। ওই বছর ঢাকায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১০ হাজার ১৪৮ জনের, ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয় ১৪ জনের। এরপর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এক লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জনের। এর মধ্যে ঢাকায় শনাক্ত হয় ৫১ হাজার ৮১০ জনের, ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয় ৪৯ হাজার ৫৪৪ জনের। ২০২০ সালে সংক্রমণ কমে আসে। ওই বছর ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এক হাজার ৪০৫ জনের। এর মধ্যে ঢাকায় শনাক্ত হয় ১ হাজার ২২৪ জনের, ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয় ১৮১ জনের। গত বছর (২০২১) ডেঙ্গুর প্রকোপ আবার বেড়ে যায়। শনাক্ত হয় ২৮ হাজার ৪২৫ জনের। এর মধ্যে ঢাকায় শনাক্ত হয় ২৩ হাজার ৬১৩ জনের, ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয় ৪ হাজার ৮১২ জনের।
চলতি বছরের শুরু থেকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১০ হাজার ২৩২ জনের (হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর তথ্য)। এরপর গত এক সপ্তাহেই (২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ২ হাজার ৬৪৩ জন শনাক্ত হয়। এর মধ্যে ঢাকায় শনাক্ত হয় ১ হাজার ৯২২ জন। আর ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয় ৭২১ জন। এই এক সপ্তাহে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। এর আগের সপ্তাহে (৮ সেপ্টেম্বর-১৫ সেপ্টেম্বর) ২ হাজার ২৮১ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এর মধ্যে ঢাকায় শনাক্ত হয় এক হাজার ৬৪৭ জনের। আর ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয় ৬৩৪ জনের। ওই সপ্তাহে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৯ জন।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৩টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলো হলো- ১, ১১, ১৪, ১৬, ১৯, ২০, ২১, ২৪, ২৮, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৯ নং ওয়ার্ড। জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনেরও (ডিএসসিসি) ১৪টি ওয়ার্ড অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে উঠে এসেছে। এলাকাগুলো হলো- ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৪, ৩৪, ৩৮, ৩৯, ৪১, ৪২, ৪৮, ৫১ নং ওয়ার্ড। জরিপ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডিএনসিসির ৪০ ওয়ার্ডের ৪৮টি সাইট এবং ডিএসসিসির ৫৮টি ওয়ার্ডে ৬২টি সাইটসহ মোট ১১০টি সাইটে ৩ হাজার ১৫০টি বাড়িতে সার্ভে পরিচালনা করা হয়েছে। ২১টি টিমের মাধ্যমে ১০ দিনব্যাপী এই স্টাডি পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিটি টিম অন্তত ১৫টি সাইট সার্ভে করে। জরিপে পাওয়া ফলাফলে দেখা গেছে, ১৫৯টি বাড়িতে ডেঙ্গুর ফল পজিটিভ এসেছে। মোট পজিটিভ আসা বাড়িগুলোর মধ্যে ৬৩টি বাড়ি ডিএনসিসিতে এবং ৯৬টি বাড়ি ডিএসসিসিতে অবস্থিত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ তখনই বাড়ে, যখন মশার সংখ্যা বাড়ে। অথবা মশাকে মেরে ফেলা না যায়। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে সবার আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে হাসপাতালগুলোতে রোগী বৃদ্ধি। এখন মশা না মারলে রোগী আপনি কীভাবে কমাবেন? শুধু মশা মারলেই হবে না, সঙ্গে সঙ্গে মশার উৎপত্তিস্থল নষ্ট করতে হবে এবং সবাইকে এই কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা জানি স্থানীয় সরকার এই কাজ দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে, এখন এই কাজটি আরেকটু জোর দিয়ে করলেই হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল ডা. মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধি আমাদের জন্য উদ্বেগের। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গত বছরের তুলনায় কিছুটা সফলও হয়েছি। তবে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মিডিয়াগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, আমাদের হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রয়েছে। যারাই হাসপাতালে আসছেন, আমাদের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের সর্বাত্মক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, কেউ যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, সেটা ভালো। কারণ হাসপাতালে থাকলে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ আর সেবার মধ্যে থাকে। এতে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকিটা কমে যায়। সচেতনতা প্রসঙ্গে মহাপরিচালক বলেন, এ বছর এখনো বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টি হলে বাসাবাড়িতে পানি জমে থাকে, ফলে এডিস মশার জন্ম হয়। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে যেন নিজ বাসাতেই ডেঙ্গু উৎপাদন না হয়। বিশেষ করে আবাসিক এলাকাগুলোর ছাদ বাগানে যাতে পানি না জমে সেদিকে বেশি খেয়াল লাখতে হবে।