
রিয়াদুল হাসান
ইসলামকে যারা ব্যক্তিগত জীবনের আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে কল্পনা পারেন না, ইসলামের যুগোপযোগিতা ও বাস্তব দুনিয়ায় এই দ্বীনের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করতে পারেন না তাদের একটি ধারণা হলো- দুনিয়ায় শান্তি বা অশান্তি বিরাজিত থাকার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের দৃষ্টিতে দ্বীন ও দুনিয়া আলাদা। দ্বীন হচ্ছে নামাজ, রোজা ইত্যাদি করে সওয়াব কামাই করা- যার উদ্দেশ্য কেবলই পারলৌকিক মুক্তি। আর দুনিয়া হচ্ছে খাওয়া, পরা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন-কানুন, বিচার ইত্যাদি। এই দ্বীন ও দুনিয়ার পৃথকীকরণে চূড়ান্ত পরিণতি হয়েছে এই যে, সারা পৃথিবী আজ অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, রক্তপাতে ভরে গেছে, কিন্তু সেই অন্যায় অবিচার থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার স্বাভাবিক মানবিক আবেদনটুকুও দুনিয়াবিমুখ ধার্মিকরা অনুধাবন করতে পারছেন না। অথচ ইসলামের প্রকৃত আকীদা হচ্ছে- যুগে যুগে আল্লাহ দ্বীন পাঠিয়েছেন মানুষের ইহজাগতিক শান্তির লক্ষ্যেই। বস্তুত মানবজাতির ইহজাগতিক শান্তির উপরই নির্ভর করে মানুষের পারলৌকিক মুক্তি। বিষয়টা ব্যাখ্যা করছি।
মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্নে আল্লাহ যখন মালায়েকদের ডেকে বললেন আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা সৃষ্টি করতে চাই, (বাকারা ৩০) তাতেই মালায়েকরা বুঝে গেল আল্লাহ তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে যে সৃষ্টিটি করতে চাচ্ছেন তার মধ্যে নিশ্চয়ই আল্লাহর রূহ থাকবে, আর যার মধ্যে আল্লাহর রূহ থাকবে তার মধ্যে আল্লাহর অন্যান্য সিফত বা গুণগুলোর মত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিও চলে আসবে। সে ইচ্ছা হলে আল্লাহর হুকুম মানবে, ইচ্ছা না হলে মানবে না। মানলে তো ভালোই, কিন্তু অমান্য করলে অশান্তি ও রক্তপাতে পতিত হবে। তাই মালায়েকরা একটু আপত্তির সুরে বলল- তারা তো পৃথিবীতে ফাসাদ (অন্যায়-অশান্তি) ও সাফাকুদ্দিমা (রক্তপাত) করবে। (বাকারা ৩০)
মালায়েকদের এই কথাটির মধ্যেই মানবজাতির ইতিহাসের বিরাট রহস্যটি লুকিয়ে আছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে সেই আদম (আ.) থেকে আজ পর্যন্ত মানবজাতির প্রধান সমস্যাই ছিল এই অন্যায়-অশান্তি-রক্তপাত, যার আশঙ্কা মালায়েকরা করেছিল। যাহোক, আল্লাহ বললেন- আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। (বাকারা ৩০) তারপর আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন। আদমের মধ্যে রূহ ফুঁকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সেই সৃষ্টিটি হয়ে গেল আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে উচ্চতা, মাহাত্ম্য, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে অনন্য। আল্লাহর হুকুমে সমস্ত মালায়েক আদমকে সেজদাহ করল, কেবল ইবলিশ অংহকার করে সেজদাহ করল না। (হিজর ২৯-৩১) শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ যখন ইবলিশকে বিতাড়িত ও অভিশপ্ত করলেন তখন ইবলিশ আল্লাহর কাছে চ্যালেঞ্জ করল যে, তুমি যদি আমাকে শক্তি দাও আমি মাটির তৈরি তোমার ঐ সৃষ্টিটার দেহের, মনের ভেতর প্রবেশ করতে পারি তবে আমি প্রমাণ করে দেখাব যে, ঐ সৃষ্টি তোমাকে অস্বীকার করবে, আমি তাদেরকে বিপথগামী করব (হিজর ৩৯, নিসা ১১৮-১১৯) আমি যেমন এতদিন তোমাকে প্রভু স্বীকার করে তোমার আদেশ মতে চলেছি, এ তা চলবে না। আল্লাহ ইবলিশের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং আদমকে পৃথিবীতে পাঠাবার সময় স্পষ্টভাবে বলে দিলেন যে, তিনি তাঁর প¶ থেকে বনি আদমের জন্য হেদায়াহ বা দিক-নির্দেশনা পাঠাবেন, যারা তার অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই (বাকারা ৩৮)। কীসের ভয় নেই? ঐ যে মালায়েকরা (যাদের মধ্যে ইবলিশও ছিল) বলেছিল মানুষ পৃথিবীতে অন্যায়-অশান্তি ও রক্তপাত সৃষ্টি করবে- সেই অন্যায় অশান্তি রক্তপাত এবং পরকালে জাহান্নামের ভয় নেই। আর যারা আল্লাহর পাঠানো হেদায়াহ অস্বীকার করবে তারা পৃথিবীতে যেমন ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমায় পতিত হবে, পরকালে জাহান্নামে জ্বলবে (বাকারা ৩৯)।
এ কারণে আল্লাহ যুগে যুগে তাঁর নবী-রসুলদের মাধ্যমে যে দ্বীন মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন তার নাম রেখেছেন ইসলাম, বাংলায় শান্তি। দ্বীনের নাম ‘শান্তি’ রাখা হয়েছে, কারণ এই দ্বীন প্রয়োগ করলে মানবজীবনে নেমে আসবে অনিবার্য শান্তি। যে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমার আশঙ্কা মালায়েকরা করেছিল এবং ইবলিশ আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে, সে হেদায়াহ থেকে সরিয়ে বনি আদমকে বিপথগামী করে ঐ ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমায় পতিত করবে, সেই ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমার হাত থেকে মানুষ র¶া পাবে। আর এটাই আল্লাহর অভিপ্রায়। কেননা পৃথিবীতে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা না থাকার মানে ইবলিশের চ্যালেঞ্জে আল্লাহর জয়। আর ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা থাকার মানে ইবলিশের জয়। মানুষের দায়িত্বটা (এবাদত) হচ্ছে তারা আল্লাহর দেওয়া দিক-নির্দেশনা মোতাবেক পৃথিবীকে পরিচালনা করে ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত রেখে আল্লাহকে জয়ী করবে। আল্লাহ যে বললেন ‘পৃথিবীতে খলিফা পাঠাব’- খলিফার কাজ কিন্তু এটাই, শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে আল্লাহকে জয়ী করা।
ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে তওহীদ। তওহীদ অস্বীকার করা তো যাবেই না, তওহীদে কোনো অংশীদারিত্ব স্থাপন করাও শিরক, ¶মার অযোগ্য অপরাধ। এগুলো সবারই জানা। কিন্তু তওহীদের ব্যাপারে এই কড়াকড়ির কারণটা কি আমরা জানি? কারণটা হচ্ছে ঐ ‘শান্তি’। আল্লাহ জানেন তাঁর হুকুম অমান্য করলে মানবজাতি অনিবার্য ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমায় পতিত হবে। যেহেতু আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ বা হুকুমদাতা হিসেবে না মানলে শান্তি আসবে না, আল্লাহ বিজয়ী হবেন না, সে কারণেই তওহীদের উপর এত কড়াকড়ি। এই কড়াকড়ি মানুষের ভালোর জন্য, মানুষের পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণের জন্য, মানুষের শান্তির জন্য। সুতরাং পৃথিবীকে অশান্তিতে রেখে, সেই অশান্তি দূর করার প্রচেষ্টা না করে, দুনিয়াবিমুখ আত্মকেন্দ্রিক-স্বার্থপরের মতো বেঁচে থেকে ও ব্যক্তিগত জীবনে কিছু উপাসনা, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা করেই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের আশা করেন যারা তারা কতটুকু বাস্তবসম্মত চিন্তাভাবনা করেন তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।