Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / ধর্মবিশ্বাস বিলীন হবার নয়: বিশ্বাসের শক্তি ব্যবহৃত হোক কল্যাণকাজে - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

ধর্মবিশ্বাস বিলীন হবার নয়: বিশ্বাসের শক্তি ব্যবহৃত হোক কল্যাণকাজে

June 03, 2024 12:40:39 PM   অনলাইন ডেস্ক
ধর্মবিশ্বাস বিলীন হবার নয়: বিশ্বাসের শক্তি ব্যবহৃত হোক কল্যাণকাজে

মো. মশিউর রহমান:
ইউরোপীয় রেনেসাঁ হয়েছিল খ্রিষ্টধর্মের গোড়ামি থেকে মানুষের চিন্তাকে মুক্ত করার জন্য। এর কারণ মধ্যযুগের খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা বিজ্ঞানবিরোধী ছিলেন, বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারকে তারা ধর্মবিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বহু বিজ্ঞানী ও যুক্তিশীল মানুষকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। তখন থেকেই ধর্মবিরোধী একটা মনোভাব ইউরোপকে পেয়ে বসেছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে ইউরোপ যখন শিল্পবিপ্লব ঘটালো, তখন তারা এত বেশি পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করার সক্ষমতা অর্জন করল যে সেই পণ্যের বাজার সৃষ্টি এবং সস্তায় শ্রমিক সংগ্রহের লক্ষ্যে তারা বাকি দুনিয়ায় নিজেদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করল। তখন তাদের মাধ্যমে ধর্মবিরোধী সেই মানসিকতাও তাদের উপনিবেশগুলোতে বিস্তার লাভ করল। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেও ধর্মবিরোধী, ধর্মহীন একটি শিক্ষিত গোষ্ঠী উপনিবেশগুলোতে সৃষ্টি করা হল যারা মানসিকভাবে পাশ্চাত্য প্রভুদের দাস আর পেশাগতজীবনে উপনিবেশের কেরানি।

এভাবেই গত কয়েকশ বছর ধরে ধর্মবিদ্বেষ আমাদের সমাজে ও মননে ঠাঁই গেড়ে বসেছে। চলমান রাষ্ট্রকাঠামোতে ধর্মের কোনো গুরুত্ব বা কর্তৃত্ব নেই। ধর্ম এখানে কেবল ব্যক্তিগত উপাসনা ও বিশ্বাসের জায়গায় রয়েছে। তবুও রাষ্ট্রনায়কদেরকে সদা-সর্বদা ধর্মীয় উগ্রবাদ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। এমনকি ধর্মই হয়ে দাঁড়িয়েছে গোটা বিশ্বের মূল সংকট, প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু। কারণ একে ব্যবহার করেই হয় ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হুজুগ-গুজবের বিস্তার, নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে ধর্ম একটি বড় ফ্যাক্টর। এজন্য ঘোর নাস্তিক কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধানদেরকেও দেখা যায় হজ করতে, ধর্মীয় লেবাস ধারণ করে ইসলাম কতটা শান্তিপ্রিয় সে বিষয়ে বক্তব্য দিতে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে দেখা যায় মস্কোর বুকে ইউরোপের বৃহত্তম মসজিদ ক্যাথেড্রাল মস্ক নির্মাণ করতে।

প্রশ্ন হল, ধর্ম এত বাজে, এত সেকেলে, এত অচল, এত আফিম- তবু কেন এত চেষ্টা করেও ধর্মকে মানুষের জীবন থেকে বাদ দেওয়া গেল না? মুক্তবুদ্ধির চর্চার নামে ধর্ম থেকে মুক্তির জন্য কত কিছুই না করা হচ্ছে, অশ্লীল সাহিত্য রচনা করা হচ্ছে, কুৎসিতভাবে আল্লাহ-রসুলকে আক্রমণ করা হচ্ছে, তবু কেন ঘুরে ফিরে ধর্মই আমাদের জীবনের প্রধান আলোচিত বিষয় হয়ে রয়ে যাচ্ছে? এর কারণ-

ক. প্রতিটি মানুষের মধ্যে যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই স্রষ্টার আত্মা, রূহ আছে (সুরা হিজর ২৯)। যে তাঁকে বিশ্বাস করে না, তার মধ্যেও স্রষ্টার আত্মা রয়েছে। এর শক্তিশালী প্রভাব মানুষের চিন্তা-চেতনায় ক্রিয়াশীল থাকে। এজন্য যখনই তারা অসহায় অবস্থায় পড়ে তখন তারা সর্বশক্তিমান সত্তার কাছে আশ্রয় চায়। স্রষ্টাকে বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট নির্দশন প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেগুলো বিবেচনা করেও মানুষ সেই মহান সত্তার সামনে মস্তক অবনত করে। একটি শ্রেণির দেখাদেখি বা অন্যের কথা শুনে তারা নাস্তিক হয়ে যায় না। উপরন্তু আল্লাহর নাজেলকৃত ধর্মগ্রন্থগুলোর বেশ কয়েকটি এখনও মানুষের কাছে আছে যেগুলো স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বাক্ষর বহন করছে। মানুষ সেগুলো সম্মানের সঙ্গে পড়ছে, জানছে, বিচার বিশ্লেষণ করছে। এগুলোর স্বর্গীয় গাম্ভীর্য তাদের আত্মার গভীরে প্রভাব ফেলছে। তাই অধিকাংশ মানুষ সেগুলোকে পবিত্র জ্ঞান করে সম্ভ্রমের সাথে পড়ছে, সন্তানকে যেমন যত্ন করা হয় সেভাবে যত্ন করছে। সুতরাং যতদিন সৃষ্টিজুড়ে স্রষ্টার নিদর্শন টিকে থাকবে, ধর্মগ্রন্থগুলো থাকবে, মানুষের ভিতরে স্রষ্টার আত্মা বিরাজিত থাকবে ততদিন মানবজাতিকে ধর্মহীন করে ফেলার চেষ্টা করা অবান্তর।

খ. অতীতে হাজার হাজার বছর মানুষকে শান্তি দিয়েছে ধর্মভিত্তিক জীবনব্যবস্থা। সে ইতিহাস মানুষের জানা আছে। সময়ের সেই বিশাল ব্যাপ্তির তুলনায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির শাসনামল এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র এবং এগুলোর অভিজ্ঞতাও চরম নৈরাশ্যকর, অশান্তিময়। অধিকাংশ মানুষ এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে একমাত্র স্রষ্টার বিধানেই শান্তি আসা সম্ভব। কাজেই পাশ্চাত্য মতাদর্শের প্রচার তাদেরকে যতই অন্য দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক, তারা শান্তির আশায় বারবার ধর্মের পানেই মুখ ফেরায়। উপরন্তু প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে, শেষ যুগে (কলিযুগ, আখেরি যামানা, The Last hour), আবার ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে, সত্যযুগ প্রতিষ্ঠিত হবে, কোনো অবিচার, অন্যায় শোষণ থাকবে না, পৃথিবীটা জান্নাতের মত শান্তিময় (Kingdom of Heaven) হবে। এ বিশ্বাস তাদের ঈমানের অঙ্গ, একে মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

গ. মানুষকে ধর্মভিত্তিক জীবনবিধান থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন বিকল্প এমন একটি জীবনব্যবস্থা রচনা করা যা তাদেরকে সেই কাক্সিক্ষত নিরাপত্তা, শান্তি ও সমৃদ্ধি দিতে পারবে, একই সঙ্গে আত্মার প্রশান্তিও বিধান করতে পারে। কিন্তু মানুষ সেটা আজ পর্যন্ত করতে পারে নি এবং কোনো কালে পারবেও না। বহু চেষ্টা করেছে কিন্তু সবই মাকাল ফল, বাইরে থেকে সুন্দর, ভিতরে তিক্ত। বর্তমান স্রষ্টাবর্জিত জীবনব্যবস্থাগুলো মানুষকে স্বার্থপর, ভোগসর্বস্ব, অমানবিক জীবে পরিণত করেছে। কাজেই মানুষ এখন আবারও ডান দিকে অর্থাৎ ধর্মের দিকে ফিরে যেতে চাচ্ছে। সুতরাং মানুষকে ধর্মহীন করার যে চেষ্টা করা হয় সেটা কোনোদিন সফল হয় নি, হবেও না।

এখন একটাই করণীয়, মানুষের ঈমানকে, ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে চালিত করা, এর শক্তিকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানো।

পাশ্চাত্য সভ্যতা ধর্মকে মানবজীবন থেকে আলাদা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তারা এখন সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান হিসাবে প্রচার করছে যে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের একমাত্র পন্থা। তারা বলছে, ধর্ম ব্যক্তিগত জীবনে থাকুক কিন্তু রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের কোনো স্থান নাই। কিন্তু বাস্তবতা আলাদা। বাস্তবে ধর্ম রাজনীতির একটা প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতা লাভ করার জন্য এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মীয় দলগুলোকে সমীহ করছেন। সেক্যুলার এমনকি বামপন্থী দলগুলোও তাদের সাথে জোটবদ্ধ হচ্ছে। এই সুযোগে তারা ধর্মকে ইস্যু হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন, ধর্মের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছেন। ধর্ম তাদের কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি। তাদের কাছে ধর্মবিরোধী প্রচারণা মূল্যহীন। এটা এখন সেমিনারের আলোচনায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু গণমানুষের চিন্তা ও দেশের পরিস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ ধারণা রাখি।

২০২২ এর শীতকালে নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে হেযবুত তওহীদের মাননীয় এমাম স্কুল প্রাঙ্গনে একটি পিঠা উৎসবের আয়োজন করেন। মেলায় আমাদের নারী সদস্যরা অন্তত দু’শ রকমের পিঠা বানিয়ে নিয়ে গেছেন। এ ঘটনা নিয়ে যে কী পরিমাণ ফতোয়াবাজি, বিরোধিতা ও হুমকির সম্মুখীন আয়োজকদেরকে হতে হয়েছে তা কল্পনাতীত। অথচ আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হচ্ছে পিঠা-পায়েস। একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী একে খ্রিষ্টানদের বড়দিনের উৎসব অপপ্রচার করেছে। কারণ সেটা বড়দিনের সময় ছিল। তারা মানুষকে মেলায় যেতে নিষেধ করেছে, এমনকি এই পিঠা খাওয়া হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছে।

কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ওয়াহিদুজ্জামান ভাইভা বোর্ডে ছাত্রীর চেহারা সনাক্ত করার প্রয়োজনে মুখ দেখাতে বলায় তাকে নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে একটি উগ্রগোষ্ঠী বিক্ষোভ মিছিল করছে, তাকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। আজকে যিনি প্রফেসর, কাল তিনি দস্যু। অর্থাৎ কারো কথা বলার অধিকার নাই, কথা বললেই সেটাকে বিকৃত করা হবে আর ধর্মান্ধতার কাছে সবাইকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হবে। ঠিক যেমন হয়েছিল ইউরোপের মধ্যযুগে। এটাই ছিল রেনেসাঁর পটভূমি।

নতুন একটি রেনেসাঁ সৃষ্টির জন্য যে আদর্শ ও শক্তিশালী বক্তব্য প্রয়োজন সেটা হেযবুত তওহীদের কাছে রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞতাবশত বা অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে অনেকেই হেযবুত তওহীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না। প্রথম কথা হচ্ছে, হেযবুত তওহীদ সম্পর্কে আগে সকল প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হতে হবে, স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে হবে। আমাদের মসজিদে প্রতিটি জুমায় হাজার তিনেক মুসুল্লি অংশগ্রহণ করেন। খুতবায় হেযবুত তওহীদের এমাম কোর’আনের আয়াত উল্লেখ করে কথা বলেন। যে ইসলামের দোহাই দিয়ে উগ্রবাদীরা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ায়, জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদের বিস্তার ঘটায়, ধ্বংসাত্মক কাজে মানুষকে লেলিয়ে দেয়, মাননীয় এমাম কোর’আনের আয়াত দেখিয়ে মানুষকে সেইসব ভ্রান্ত যুক্তির খণ্ডন করেন, কোর’আন দ্বারা তিনি মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেতনা জাগ্রত করেন। কাজেই হেযবুত তওহীদ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা রাখতে হবে। তারপর হেযবুত তওহীদের বক্তব্য সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।