
রাকীব আল হাসান
ইসলাম ধর্মের অবমাননা কোনো মুসলিমই সহজে মেনে নিতে পারবে না এটা স্বাভাবিক। কারণ আমরা মুসলিমরা রসুলকে নিজেদের প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি, কোর’আনকে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে পবিত্র বস্তু বলে বিবেচনা করি। যদি কেউ মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের উদ্দেশ্যে এর অসম্মান করে, তাহলে অবশ্যই তার প্রতিবাদ হওয়া উচিত। আমাদের দেশেও প্রতিবাদ হয়, কিন্তু সেই প্রতিবাদের ভাষা কতটা ইসলাম সম্মত, রসুলাল্লাহর সুন্নাহ সম্মত সেটা আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়।
কিছুদিন পর পর আমাদের দেশে কোর’আন ‘অবমাননা’র অভিযোগকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, দোকানপাটে হামলা করে ভাঙচুর চালায় ক্ষিপ্ত জনতা। সব সময়ে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন মতাদর্শের স্বার্থবাদী রাজনৈতিক দল ওঁৎ পেতেই থাকে। তারাও সুযোগ পেয়ে এ জাতিয় সন্ত্রাসের আগুনে ঘি ঢালে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এগুলো সবই করা হয় ধর্মের নামে। ভারতে হয় হিন্দু ধর্মের নামে, আর বাংলাদেশে ইসলামের নামে। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই বৃহত্তর শান্তিপ্রিয় শান্তিকামী ধর্মপ্রাণ উপাসকদের বাইরেও বর্তমানে একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রাবল্য সৃষ্টি হয়েছে। তারাই নানারকম ইস্যু সৃষ্টি করে, সেগুলো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মাঝখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ নিরীহ মানুষ।
উপরন্তু উভয়ধর্মের মধ্যেই পশ্চিমা বস্তুবাদী, নাস্তিকতাবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধর্মবিদ্বেষী শ্রেণিরও উদ্ভব হয়েছে, যারা প্রতিনিয়ত ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বেড়ায়। তাদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী যে গোষ্ঠীটি সারা বছর ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ায় তারা এ ধরনের ইস্যুকে ব্যবহার করে নানা ধরনের বক্তব্য, ঘৃণাসূচক পোস্ট অনলাইনে প্রচার করে। ফলে মানবজাতির কাছে ইসলাম সম্পর্কে ভয়ানক নেতিবাচক বার্তা যায় যে, ইসলাম একটি সন্ত্রাসের ধর্ম, ইসলাম পরমতসহিষ্ণু নয়, আধুনিক সভ্যযুগে সভ্য মানবসমাজে ইসলাম খাপ খায় না, মুসলিমরা সন্ত্রাসী, মুসলিমরা জঙ্গি, মুসলিমরা পাশবিক, বর্বর, নৃশংস ইত্যাদি।
কিন্তু শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহার করে যারা এই যে হিংসা ও সন্ত্রাসের চর্চা করে চলছে- তারা কি আদৌ রসুলাল্লাহর অনুসারী? যারা রসুলকে ভালোবাসেন, ইসলামকে ভালোবাসেন তাদের সামনে মহানবীর গৃহীত কর্মনীতি আলোচনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। চলুন দেখি তিনি এ জাতিয় ঘটনার ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, একবার এক বেদুঈন মসজিদে নববীতে পেশাব করে দিল। লোকেরা তা দেখে তেড়ে এল। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাকে তার কাজ শেষ করতে দাও এবং এক বালতি পানি ঢেলে স্থানটি ধুয়ে দাও। মনে রেখ, তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে জীবনকে সহজ করার জন্য, কঠিন করার জন্য নয় (হাদিস- বোখারি, কিতাবুল ওজু ১/৩৫)। এরপর রসুলাল্লাহ লোকটিকে শান্তভাবে বুঝিয়ে বললেন যে মসজিদ আল্লাহর ঘর, এখানে সালাহ কায়েম করা হয়। এটা পবিত্র স্থান। এখানে এই কাজ করা উচিত নয়। আরববাসীর অজ্ঞতা সম্পর্কে রসুলাল্লাহ সচেতন ছিলেন। তাই এ বিষয় নিয়ে অন্যান্য সাহাবিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়াতে দিলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে হস্তক্ষেপ করে সুন্দর ও স্বাভাবিক সমাধান করে দিলেন।
পক্ষান্তরে আজকে যদি এ ধরনের ঘটনা কেউ ঘটায় তাহলে মসজিদ কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এর সমাধান দেওয়ার আগেই স্বার্থান্বেষী ঐ গোষ্ঠীটি গুজব ছড়িয়ে দিত। ফলে তার কপালে কী ঘটবে তা সহজেই অনুমেয়। প্রমাণ- মাত্র কিছুদিন আগে লালমণিরহাটে জুয়েল নামে একজন নির্দোষ ব্যক্তির উপর কোর’আন অবমাননার অভিযোগ এনে শেষ পর্যন্ত তাকে পিটিয়ে হত্যা তো করাই হয়েছিল, তারপর তার মরদেহ আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল পাশবিক উল্লাসে। কিন্তু বেচারার দোষ ছিল এটাই যে, মসজিদের উঁচু তাক থেকে কোর’আন নামাতে গিয়ে একটি কোর’আন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। বেচারা হাজার বার কোর’আনে চুমু খেয়েও, পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েও রক্তপিপাসু উন্মাদদের হাত থেকে বাঁচতে পারল না। এই মানুষগুলো আসলেই কি সেই নবীর অনুসারী যিনি অজ্ঞ বেদুইনকে মসজিদের ভিতরে অমন কাজ করতে দেখেও বিন্দুমাত্র ক্ষিপ্ত হন নি? তারা কি আসলেই মহানবীর আদর্শ ধারণ করেছেন? রসুলাল্লাহ তো জেহাদ করেছেন সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, এবং সেই জেহাদের একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও কর্মসূচি ছিল। তাঁর জেহাদ ছিল বহুগুণ শক্তিশালী শক্তির বিরুদ্ধে। তিনি তো দুর্বল অসহায় মানুষের বিরুদ্ধে শক্তিপ্রদর্শন করেন নি।
মক্কায় ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন ছিল আবু জাহেল আর মদিনায় সবচেয়ে বড় দুশমন ছিল মোনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল। এই দুজনের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন উবাই ছিল বেশি ভয়ানক, কারণ সে প্রকাশ্যে নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করত, মসজিদে গিয়ে জামাতে সালাহ কায়েম করত, সকল আলোচনার মধ্যেও উপস্থিত থাকতো, এমন কি জেহাদের আয়োজনেও অংশ নিত। কিন্তু এর পাশাপাশি মো’মেনদের একতা আর মনোবলে ভাঙন ধরানোর জন্য সে সারাক্ষণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতো। রসুলাল্লাহর হাত থেকে মদিনার নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়াই ছিল তার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন। ওমর (রা.) সহ অনেক সাহাবি, এমন কি তার নিজের ছেলেও তাকে হত্যা করার জন্য নবীজির কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছেন, কিন্তু রসুলাল্লাহ অনুমতি দেন নি। তিনি ধৈর্য ধারণ করেছেন যাতে করে আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের ভণ্ডামির মুখোস আপনা থেকেই খসে পড়ে আর তার অনুসারীরা তাদের নেতার কদর্যতার পরিচয় লাভ করতে পারে। তিনি বলেছেন, “যদি আমি তাকে হত্যা করি তাহলে লোকেরা বলবে, দেখ, মোহাম্মদ (সা.) দেখ তার সঙ্গীদেরকে কীভাবে হত্যা করেছে।”
এহেন মোনাফেক সর্দার যখন মারা গেল রসুলাল্লাহ তার দাফনকার্যে যোগ দান করলেন। তিনি যখন সেখানে পৌঁছান ততক্ষণে তাকে কবরে নামানো হয়ে গেছে। তিনি তার লাশ কবর থেকে বের করার নির্দেশ দেন। এরপর তার লাশ স্বীয় হাঁটুর ওপর রাখেন, নিজের মুখের পবিত্র থুথু তার শরীরে লাগিয়ে দেন এবং নিজের পরিধেয় জামা তাকে পরিয়ে দাফন করেন। (হাদিস- বোখারি, কিতাবুল জানাইয ১/১৮২)
এই ছিল রসুলাল্লাহর সহিষ্ণুতার মাত্রা। আজ যারা রসুলাল্লাহর উম্মত দাবি করে ভিন্নধর্মের বা ভিন্নমতের মানুষের উপর পৈশাচিক উন্মত্ততায় হামলে পড়ছে, সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধনের জন্য আঘাত হানছে, তাদের সামনে মহানবীর এই সহনশীলতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উদাহরণ তুলে ধরা অতি জরুরি।
রসুলাল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা মন্দ ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, তা জঘন্য মিথ্যা। তোমরা একে অন্যের ছিদ্রান্বেষণ করবে না, একে অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াবে না, প্রতারণা করবে না, পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না, একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাবে না; বরং আল্লাহর বান্দা হিসেবে সকলে ভাই ভাইয়ে পরিণত হবে। -হাদিস বোখারী ২/৮৯৬
যায়েদ নামের এক ইহুদি রাব্বাই মহানবীর সাথে একটি অগ্রিম কেনা-বেচা করল। নির্ধারিত সময়ের ২/৩ দিন পূর্বেই সে এসে মাল পরিশোধের দাবি করল। এমনকি চাদর মুবারক টেনে নবীজীর সঙ্গে বেয়াদবি করল। বিকৃত চেহারায় রূঢ় কণ্ঠে নবীজীর দিকে তাকিয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে চিনি। তোমরা আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর, বড় টালবাহানাকারী।’
সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওমর ফারুক (রা.)। নবীজীর সাথে লোকটির এ অশিষ্ট আচরণ দেখে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে তাকে ধমক দিলেন। কিন্তু রসুলাল্লাহ ওমরকে (রা.) বললেন, ওমর! আমি ও এ ব্যক্তি তোমার থেকে অন্যরূপ আচরণ পাবার হকদার ছিলাম। দরকার তো ছিল তুমি আমাকে সত্বর তার প্রাপ্য আদায় করার পরামর্শ দিতে, আর তাকে কথায় ও আচরণে নম্রতা অবলম্বনের তাগিদ দিবে। এরপর তিনি ওমরকে (রা.) প্রাপ্য পরিশোধের নির্দেশ দেন এবং তাকে আরো ২০ সা বেশি খেজুর দিতে বলেন, যা ছিল ওমর (রা.) কর্তৃক লোকটিকে ধমক দেওয়ার বদলা। খেয়াল করুন, ভিন্ন ধর্মের লোককে সামান্য একটা ধমক দেওয়াও রসুলাল্লাহ বরদাশত করলেন না।
মহানবীর এ সহিষ্ণু আচরণ লোকটির ইসলাম গ্রহণের কারণ হয়। যাওয়ার পথে যায়েদ ওমরকে (রা.) বললেন, হে ওমর! আমি হচ্ছি ইহুদি-আলেম যায়েদ ইবনে সানা। আসলে লেনদেন আমার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং মহানবীর ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা পরীক্ষা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কারণ শেষ নবীর অন্যতম গুণ হবে এই যে, তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ক্রোধের ওপর প্রবল থাকবে। যতই রূঢ় আচরণ করা হবে তার ক্ষমা ততই বৃদ্ধি পাবে। অতএব ওমর! আমি যা চেয়েছি তা পেয়ে গেছি। এরপর তিনি নবীজী সা. এর হাতে খালেসভাবে ঈমান আনেন এবং তাঁর অঢেল সম্পদের অর্ধেক উম্মতের জন্য দান করে দেন। -মুসনাদে আহমদ, ৩/১৫৩, আখলাকুন্নাবী পৃ. ১২৪
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সহনশীলতার চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে সহনশীলতা অবলম্বনের শক্তি দান করবেন, আর সহনশীলতা থেকে অধিক উত্তম ও ব্যাপক কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দান করা হয়নি।’ (হাদিস- বোখারি ও মুসলিম)
হামজা (রা.) ছিলেন রসুলাল্লাহর প্রাণপ্রিয় চাচা এবং অভিভাবক। ইসলামে প্রবেশের পর যিনি অনেক জেহাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ওহুদের যুদ্ধে শাহদাত লাভ করেন। তাঁর শাহদাতের পর রসুলাল্লাহ এত কেঁদেছিলেন যে, অন্য কোনো জানাজায় তাঁকে এমন কাঁদতে দেখা যায়নি। আবু সুফিয়ানের প্রতিহিংসাপরায়ণ স্ত্রী হিন্দা নিজে হামজা (রা.)-এর পেট চিরে তাঁর কলিজা বের করে চিবায়। এমন বর্বর পৈশাচিক কাজ করার পরও রসুলাল্লাহ মক্কা বিজয়ের পর আবু সুফিয়ানের স্ত্রীকে ক্ষমা করে দেন। হিন্দার আগের জীবন এবং কর্ম নিয়ে রসুলাল্লাহ কখনোই তাকে কটাক্ষ করেননি।
রসুলাল্লাহ বলেন, ‘যে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার সাথে তুমি মিলে যাও, যে তোমার ওপর জুলুম করে তাকে ক্ষমা করে দাও, যে মন্দ আচরণ করে, তার সাথে সদাচরণ কর।’
খায়বারে ইহুদিদের শোচনীয় পরাজয়ের পর জয়নব বিনতে তাহারাত নামের এক ইহুদি রমণী ভেড়ার গোশত রান্না করে রসুলাল্লাহকে দাওয়াত করেন । রসুলাল্লাহ (সা.) এবং বশির বিন বারা (রা.) খাওয়া শুরু করেন। খাবার মুখে দিয়েই রসুলাল্লাহ (সা.) বিষ দেওয়া হয়েছে বুঝতে পেরে তা ফেলে দেন, কিন্তু বশির (রা.) বিষক্রিয়ায় কয়েকদিন অসুস্থ থাকার পর মৃত্যুবরণ করেন। নবীজি জয়নবকে এ কাজের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, “আপনি রাজা বা বাদশাহ হলে বিষক্রিয়ায় মারা যাবেন আর আমরা মুক্তি পাব, আর যদি নবী হন তাহলে আল্লাহ আপনাকে জানিয়ে দেবেন।”
আল্লাহর রসুল বললেন, “আল্লাহ তোমাকে আমায় হত্যা করার ক্ষমতা দেননি।” রসুলাল্লাহর হৃদয় ক্ষমার বিশালতায় আবৃত, তিনি জয়নবকেও ক্ষমা করে দেন। কিন্তু বশির (রা.)-কে হত্যার অপরাধে জয়নবকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এ ঘটনায় রসুলাল্লাহ নিজের উপর করা হত্যাচেষ্টার অপরাধকে ক্ষমা করে দেন এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁর সাহাবির হত্যাকারীর ফায়সালা করেন। কিন্তু একজনের অপরাধে পুরো গোত্রকে দোষী সাব্যস্ত করেন নি।
হাব্বার ইবনে আসওয়াদ রসুলাল্লাহর কন্যা জয়নাবকে (রা.) হিজরতের সময় এমন জোরে ধাক্কা মেরেছিল যে তিনি উটের হাওদা থেকে ছিটকে পাথুরে প্রান্তরে গিয়ে পড়ে যান। এতে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। মক্কা বিজয়ের পরে হাব্বার ইবনে আসওয়াদ ইসলাম গ্রহণ করেন, রসুলাল্লাহ (সা.) তাকেও ক্ষমা করে দেন।
আব্বাাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলাল্লাহ একদিন নাজরানের চাদর পরিহিত ছিলেন, যার প্রান্তদেশ ছিল মোটা। পথে এক বেদুইন আরবের সাথে দেখা হতেই সে নবীজীর চাদর ধরে এত জোরে টান দিল যে তাঁর গলায় দাগ পড়ে গেল। এরপর সে বলল, “আল্লাহর যে মাল আপনার কাছে রয়েছে তা আমাকে দেওয়ার হুকুম দিন।” রসুলাল্লাহ তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং তার প্রার্থিত বস্তু তাকে দেওয়ার জন্য বললেন। (হাদিস বোখারী, কিতাবুল জিহাদ)
রসুলাল্লাহকে কাফের কোরায়েশদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে জন্মভূমি মক্কা থেকে হিজরত করতে হয়েছিল। আট বছর পর তিনি আবার ১০ হাজার সাবাবিকে নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হন। এ অভিযানে আল্লাহ তাঁকে বিনা যুদ্ধে বিজয় দান করেন। তিনি কাবাঘরে প্রবেশ করে মানব স্রোতের সামনে ভাষণ দেনÑ “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই, তিনি এক অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা সত্যি করে দেখিয়েছেন। তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই সব বিরুদ্ধশক্তিকে পরাজিত করেছেন।”
এরপর জিজ্ঞেস করলেন, “হে কোরাইশগণ! তোমাদের কী ধারণা, আমি তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করব বলে তোমরা মনে করো?”
সবাই বলল, “আপনি ভালো ব্যবহার করবেন এটাই আমাদের ধারণা, আপনি দয়ালু ভাই, দয়ালু ভাইয়ের পুত্র।”
রসুলাল্লাহ (সা.) বললেন, তাহলে আমি তোমাদের সে কথাই বলছি যে কথা ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের বলেছিলেন, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তোমরা মুক্ত।” ইতিহাস সাক্ষী হয়ে রইল, যে মানুষটির উপর ও তাঁর অনুসারীদের উপর সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে, বিনা উস্কানিতে তেরটি বছর দিনে রাতে লোমহর্ষক অত্যাচার চালানো হয়েছে, আজ তিনি পূর্ণ প্রতিশোধের ক্ষমতা পেয়েও চরম শত্রুকে ক্ষমা করে দিলেন। উম্মাহর জন্য কেয়ামত পর্যন্ত তিনি সহনশীলতার এই দৃষ্টান্ত, এই সুন্নাহ তিনি স্থাপন করে গেলেন।
রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর পথে আমাকে যতটুকু ভয় দেখানো হয়েছে, ততটুকু অন্য কাউকে দেখানো হয়নি। আল্লাহর পথে আমাকে যতটুকু নির্যাতিত করা হয়েছে, ততটুকু অন্য কাউকে করা হয়নি। একবার ত্রিশটি দিবা-রাত্র আমার এমন অতিবাহিত হয়েছে, যখন আমার ও বেলালের জন্যে এমন কোনো আহার্য বস্তু ছিল না, যা কোনো প্রাণী খেতে, সেই বস্তু ছাড়া, যা বেলাল তার নিকটে লুকিয়ে রেখেছিল। (মা’আরিফুল হাদীস; শামায়েল)।
এ ধরনের ক্ষমা, উদারতা, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতার শত শত উদাহরণ মহানবীর পবিত্র জীবনী থেকে দেওয়া যায়। তিনি জেহাদ করেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, নিপীড়িত মানুষকে রক্ষা করার জন্য, মানুষের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিকসহ সর্বরকমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করা তাঁর জেহাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাই মহানবীর প্রকৃত উম্মত হিসাবে আমাদের কর্তব্য হবে যাচাই বাছাই না করে কোনো প্রচারণায় কান না দেওয়া, একের অপরাধে অন্যের ক্ষতিসাধন না করা, কেউ অপরাধ করলে কেবল তাকেই বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দণ্ডিত করা।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭১৪৬৫১, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]