Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / পতনের মাইলফলক: মুসলিম উম্মাহ যেভাবে শ্রেষ্ঠত্বের আসন হারালো! - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

পতনের মাইলফলক: মুসলিম উম্মাহ যেভাবে শ্রেষ্ঠত্বের আসন হারালো!

June 26, 2024 03:06:58 PM   মোহাম্মদ আসাদ আলী
পতনের মাইলফলক: মুসলিম উম্মাহ যেভাবে শ্রেষ্ঠত্বের আসন হারালো!

মোহাম্মদ আসাদ আলী
একটা সময় আসমানের নিচে ও জমিনের উপরে এমন কোনো জাতি ছিল না যারা মুসলিম উম্মাহর দিকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলতে পারে। মুসলিমরা ছিল বিশ্বের অপ্রতিরোধ্য জাতি, শাসক জাতি। কিন্তু সেই উম্মাহ আজ পৃথিবীর সর্বত্র অপমানিত হচ্ছে, অত্যাচারিত হচ্ছে, গণহত্যার শিকার হচ্ছে। কোথাও বিচার পাচ্ছে না। প্রশ্ন ওঠে, কীভাবে ঘটল তাদের এতবড় অধঃপতন? আর যখন এই উম্মাহর এতবড় অধঃপতন ঘটতে থাকে, তখন উম্মাহর কাণ্ডারি বলে পরিচিত আলেম ওলামাদের ভূমিকাই বা কী ছিল! সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে আজকের লেখায়।

রসুল (সা.) এর যুগে ইসলামের মডেল কেমন ছিল?

পাঠক, ইসলামের ইতিহাস না জানলে আজকের বিষয়টি বোঝা একটু কঠিন হবে। সেজন্য শুরুতেই সংক্ষেপে ইতিহাস নিয়ে দুটো কথা।

৬১০ খ্রিষ্টাব্দে রসুল (সা.) নবুয়্যত লাভ করেন এবং মানুষকে তওহীদের দিকে ডাকতে শুরু করেন। তখন পৃথিবীতে ইসলামের কোনো দৃশ্যমান কাঠামো ছিল না। ইসলামটা আসলে কী, এটার বাস্তব চেহারা কী হবে, তা কেউ জানত না। কিন্তু যখন ২৩ বছরের সংগ্রামী জীবন শেষ করে রসুলাল্লাহ (সা.) ইন্তেকাল করলেন, ততদিনে পুরো বিশ্বের সামনে ইসলামের মডেল পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তিনি যখন বিদায় হজের ভাষণে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? লোকেরা সাক্ষ্য দিল, হে আল্লাহ! হ্যাঁ। এই কথার মানে হলো- ইসলামের পূর্ণাঙ্গ মডেল প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বনবী তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব শেষ করেছেন।

সংক্ষেপে সেই ইসলামের মডেলটা ছিল এরকম-
১. জাতি হবে একটা। (ঐক্যবদ্ধ)
২. জাতির নেতা হবেন একজন। (খলিফা বা আমিরুল মু’মিনিন বা ইমাম)
৩. জাতির জীবনবিধান হবে আল্লাহর হুকুম। (আল কোর’আন)
৪. জাতির ইমাম আল্লাহর হুকুমকে মানদণ্ড বা মূলনীতি হিসেবে ধরে জাতিকে পরিচালনা করবেন। 
৫. লক্ষ্য উদ্দেশ্য হবে সর্বাত্মক সংগ্রাম (জেহাদ) করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা বিশ্ব থেকে অন্যায় অবিচার যুদ্ধ রক্তপাত নির্মূল করে মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা তথা শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। (ফাতাহ ২৮, তওবা ৩৩, সফ ০৯)

এই মডেলের উপর সাহাবীদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে রসুল (সা.) ইন্তেকাল করেছিলেন। আর বলে গিয়েছিলেন- “যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।” সাহাবীরা সেই মোতাবেক এক নেতা, এক উম্মাহ, এক বিধান, এক লক্ষ্য- ইসলামের এই নকশাটি আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। কোনো কারণে এই মডেল ভেঙে যাবার অবস্থা হলে সাহাবীরা জীবন দিয়ে হলেও তার মোকাবেলা করতেন। যেমন, তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.) এর হত্যাকাণ্ডের পর মুয়াবিয়া (রা.) যখন আলী (রা.) এর হাতে বায়াত নিলেন না, তখন জাতির নেতা দুইজন হয়ে গেল, যা সাহাবীরা মেনে নিলেন না। কারণ তারা ভালোভাবেই জানতেন- জাতির নেতা হবেন একজন। আর সেই একজন নেতার নির্দেশেই পরিচালিত হবে মুসলিমদের জাতীয় জীবন। তাই সাহাবীরা বাধ্য হয়ে উস্ট্রের যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন কিন্তু ইসলামের এই মডেলকে নষ্ট হতে দেননি। তারা ঠিকই একজাতি, এক নেতা, এক বিধান- এই সুন্নাহ অটুট রেখেছেন। আর সেই মডেল অটুট রেখেছেন বলেই তারা ছিলেন পৃথিবীর সেরা জাতি। সুপার পাওয়ার। তাদের দিকে চোখ তুলে কথা বলার মতো কোনো শক্তি পৃথিবীতে ছিল না।

কিন্তু এখন কী দেখা যাচ্ছে?
পাঠক! এখন একবিংশ শতাব্দী। পৃথিবীতে এখন ১৮০ কোটি মুসলমানের বসবাস। মুসলমানদের ঘরে ঘরে এখন ঝকঝকে হরফের কোর’আন। লক্ষ লক্ষ মসজিদে প্রতিদিন আজান হচ্ছে, নামাজ হচ্ছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ হাজী মক্কায় গিয়ে হজ্ব করে আসছেন। কোটি কোটি আলেম, মুফতী মাওলানা, মুহাদ্দিস, আল্লামারা দীনের খেদমতে নিয়োজিত আছেন। সমস্যা কেবল একটাই। রসুল (সা.) ইসলামের যে মডেল তৈরি করে গিয়েছিলেন, বর্তমান মুসলিম উম্মাহর দিকে তাকালে সেই মডেল দেখা যায় না। এখন ইসলামের ভিন্ন আরেকটি চেহারা দেখা যায়, যার সঙ্গে আল্লাহ-রসুলের ইসলামের মিল নেই বললেই চলে। যেমন:

১. রসুলাল্লাহর যুগে মুসলিমরা ছিলেন একজাতি। কিন্তু এখন মুসলিমরা ৫৭টার মতো ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত।  
২. রসুলাল্লাহ ও সাহাবীদের যুগে জাতির নেতা ছিলেন একজন। কিন্তু বর্তমানে মুসলমানদের একক কোনো অবিসংবাদিত নেতার অস্তিত্ব নেই। ছোট্ট একটা দেশ কুয়েত। বাংলাদেশের একটা বিভাগের সমানও না। কিন্তু সেই দেশেরও আছে আলাদা নেতা, আলাদা শাসন।
৩. রসুলাল্লাহ ও সাহাবীদের যুগে জাতির জীবনবিধান ছিল আল কোর’আন। কিন্তু বর্তমানে মুসলমানদের জীবন চলছে মানুষের তৈরি বিধি-বিধান ও আইন-কানুনে।
৪. রসুলাল্লাহ ও সাহাবীদের যুগে পবিত্র কোর’আনের বিধানকে মূলনীতি হিসেবে রেখে জাতির ইমাম জাতিকে পরিচালনা করতেন। আর প্রত্যেক মো’মেন-মুসলমান জাতির ইমামের আনুগত্য করতেন। কিন্তু বর্তমানে জাতির তো ইমামই নাই। তাই একক কোনো নেতার প্রতি অনুগত থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
৫. রসুলাল্লাহ ও সাহাবীদের যুগের মুসলিম উম্মাহ ছিলেন শাসক জাতি, যারা মানবজাতিকে সৎ কাজের আদেশ দিতেন ও অসৎ কাজে নিষেধ করতেন। কিন্তু বর্তমানের মুসলিম নামক জনগোষ্ঠীর পক্ষে তাদের নিজেদের পিঠ রক্ষা করাটাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তারা নিজেরাই অত্যাচারের শিকার, সুতরাং অন্যদেরকে অত্যাচার থেকে মুক্ত করবে কীভাবে? 
অর্থাৎ একথা পরিষ্কার যে, রসুল (সা.) যেটাকে ইসলাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন, সেই মডেলের ধারেকাছেও আমরা বর্তমানে নাই।

এখন প্রশ্ন হলো দুইটা। প্রথমত- ইসলামের সিস্টেমে এতবড় ওলট-পালট হয়ে গেল কীভাবে? দ্বিতীয়ত- এতকিছু হয়ে গেল আমাদের আলেম সাহেবরা কী করলেন?

ইসলামের মডেল ভেঙে পড়ল যেভাবে:
১. রসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের একমাত্র মিশন ছিল- সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা। (সফ ৯, তওবা ৩৩, ফাতাহ ২৮) সেই মিশন বাস্তবায়নের জন্য তারা একদেহ একপ্রাণ হয়ে কেবল যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। ছুটে গেছেন রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে। তাদের দুর্ধর্ষ সংগ্রামের ফলে অর্ধপৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

২. কিন্তু সাহাবীরা দুনিয়া থেকে চলে যাবার পর তাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কাছে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের গুরুত্ব কমে যেতে থাকে। এদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও শাসকরা দীন প্রতিষ্ঠার চেতনা ভুলে ভোগ-বিলাসিতায় মেতে ওঠে। ফলে জেহাদ বন্ধ হয়ে যায়।

৩. জেহাদ যখন বন্ধ হয়ে গেল, তখন মুসলিমরা কী করবে? বেকার তো বসে থাকা যায় না। একটি শ্রেণি শুরু করল দীনের অতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। তারা ইসলামের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে শরিয়তের লক্ষ লক্ষ মাসলা-মাসায়েল রচনা করা শুরু করল এবং এটাকেই ইসলামের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলল।

৪. হাদিস নিয়ে, ফিকাহ নিয়ে, তাফসীর নিয়ে চুলচেরা গবেষণা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই যখন উম্মাহর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়ালো, তখন সেই কাজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আলেমদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হতে লাগলো। এসব আলেমদের অনুসরণ করতে গিয়ে সাধারণ মুসলিমরাও বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়লেন, পরবর্তীতে যা ফেরকা মাজহাবে রূপ নিলো।

৫. এদিকে আরেকদল সুফি-দরবেশের আবির্ভাব হলো, যারা ইসলামের মূল স্পিরিটকেই পরিবর্তন করে দিলেন। তারা মারেফতি সাধনাকেই মুসলিমদের মুখ্য কর্তব্য হিসেবে প্রচার করলেন। তারা মিথ্যা হাদিস প্রচার করলেন যে, আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদই হলো বড়। অথচ কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ হলো জেহাদে আকবর, বড় জেহাদ। (সুরা ফোরকান ৫২) আসল জেহাদ বাদ দিয়ে রিপুর বিরুদ্ধে জেহাদকেই বড় জেহাদ বানিয়ে ফেলার পরিণতি হলো ভয়াবহ। উম্মাহর সামনে রসুল (সা.) সারা বিশ্বে দীন প্রতিষ্ঠার যে মিশন দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মিশন পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ল।

৬. এভাবে ঐক্য হারিয়ে, লক্ষ্য হারিয়ে, অযোগ্য নেতৃত্বের অধীনে ও আলেমদের মাসলা-মাসায়েলের জালে আটকা পড়ে জাতি যখন স্থবির হয়ে পড়ল, তখন ইউরোপীয়রা আক্রমণ করে সহজেই এই উম্মাহর হাত থেকে রাষ্ট্রশক্তি ছিনিয়ে নিল এবং এদেরকে গোলাম বানিয়ে দিল। যেমন- আমাদের ভারতবর্ষের মুসলিমদেরকে গোলাম বানালো ব্রিটিশরা। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যকেও ফরাসি, ব্রিটিশসহ বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি দখল করে নিয়েছিল।

৭. ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা তো আর কোর’আনের বিধান দিয়ে মুসলমানদেরকে পরিচালিত করবে না। স্বভাবতই তারা কোর’আনের বিধান বাতিল করে দিয়ে মুসলমানদের জাতীয় জীবনে পশ্চিমাদের তৈরি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রযোগ করল। ফলে মুসলমানদের ইলাহ বা বিধানদাতা আর আল্লাহ রইলেন না, ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা তাদের ইলাহ হয়ে গেল। মুসলিমরা ব্যক্তিজীবনে আল্লাহর বিধানে নামাজ রোজা করলেও জাতীয় জীবনে তখন ব্রিটিশের হুকুম-বিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি কার্যকর হলো, আল্লাহর বিধান অকার্যকর হয়ে গেল।

৮. ব্রিটিশদের গোলামী যাতে মুসলমানদের মনে মগজে ভালোভাবে গেড়ে যায়, সেজন্য ব্রিটিশরা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলিমদেরকে শেখালো ব্রিটিশ শাসনই উত্তম ও ব্রিটিশদের তৈরি বিধানই উত্তম। সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যারা বের হলেন তারা কেবল গায়ের চামড়ার রঙে ভারতীয় ছিলেন, কিন্তু চিন্তা ভাবনায় তারা ছিলেন ব্রিটিশ। তারা ইসলাম ও মুসলিম জাতি নিয়ে প্রচণ্ড হীনম্মন্যতায় ভুগতে লাগলেন আর ব্রিটিশদের সবকিছুকেই সেরা জ্ঞান করতে লাগলেন।

৯. ধূর্ত ব্রিটিশরা ভালোভাবেই জানত- মুসলমানদের সকল শক্তির উৎস ইসলাম। আর ইসলামের সবচাইতে বিপদজনক বিষয় হলো- তওহীদ ও জেহাদ। তওহীদ মানে হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, কাজেই তওহীদ থাকলে ব্রিটিশের হুকুম চলবে না। আর জেহাদ থাকলে ব্রিটিশদের পালানো ছাড়া উপায় নেই। তাই খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদরা অনেক গবেষণা করে তওহীদ ও জেহাদহীন মাসলা-মাসায়েল সর্বস্ব একটি নখদন্তহীন ইসলাম আবিষ্কার করল। আর সেই ইসলাম শেখানোর জন্য তারা ১৭৮০ সালে কলকাতায় স্থাপন করল- কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসার ইতিহাস যারা জানেন তাদেরকে বলে দিতে হবে না- এই মাদ্রাসায় শুরুর দিকে ২৬ জন খ্রিষ্টান পণ্ডিত ৭৬ বছর যাবৎ অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। খ্রিষ্টানরা যখন মুসলমানদেরকে মাদ্রাসা বানিয়ে ইসলাম শেখায়- তখন বুঝতে হবে সেই ইসলাম আর যাই হোক আল্লাহ-রসুলের ইসলাম নয়।

১০. এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমাদের দেওবন্দ ঘরানার আলেমরা চিন্তা করলেন- হায় হায়! সবই তো গেল। রাষ্ট্রব্যবস্থা গেল, অর্থব্যবস্থা গেল, বিচারব্যবস্থা গেল, সমাজব্যবস্থা গেল, শিক্ষাব্যবস্থাও গেল। ব্রিটিশরা সব জায়গা থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করে দিচ্ছে। ইসলামের তো কিছুই রইল না। আলেম বলে পরিচয় দেওয়াই তো লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই তারা লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করলেন। তখন এই আলেমরা শুধু ইসলামের তাহজিব-তমদ্দুন বা মুসলিমদের কৃষ্টি কালচার রক্ষার জন্য ভারতে ১৮৬৬ সালে দেওবন্দ মাদ্রাসা স্থাপন করলেন। সেখানে মূলত হাদিসের জ্ঞানকেই প্রাধান্য দেওয়া হলো এবং উর্দু, ফার্সি ইত্যাদি কিতাব পড়ানো শুরু হলো। ওখান থেকে পড়াশোনা করে বের হয়ে হাজার হাজার আলেম পরবর্তীতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় দেওবন্দ মাদ্রাসা বা কওমী মাদ্রাসা স্থাপন শুরু করলেন। উদ্দেশ্য একই- ইসলামের তাহজিব তামদ্দুন রক্ষা করা।

১১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা যখন মুসলিমদেরকে তথাকথিত স্বাধীনতা দিয়ে গেল, তখন তারা ক্ষমতা ছেড়ে গেল তাদের তৈরি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় মগজ ধোলাই করা ঐ শিক্ষিত শ্রেণিটির হাতে, যারা মনে মগজে ব্রিটিশদের গোলাম ছিল। কাজেই ব্রিটিশরা স্বাধীনতা দিয়ে গেলেও এই শিক্ষিত শ্রেণিটি ক্ষমতা পেয়ে ব্রিটিশ প্রভুদের শেখানো রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থাই মুসলিম দেশগুলোতে চালু রাখলো। আল্লাহর বিধান প্রত্যাখ্যাত হয়েই থাকলো।  

১২. সেই থেকে আমাদের জাতীয় জীবন চলছে মানুষের তৈরি বিধানে, আর আমাদের মাওলানা সাহেবরা মাদ্রাসা বানিয়ে উম্মাহকে ওজুর মাসালা, গোসলের মাসালা, ঢিলা কুলুখের মাসালা শেখাচ্ছেন, আরবি ব্যাকরণ ও সহিহভাবে কোর’আন তেলাওয়াত করা শেখাচ্ছেন, পুরুষদেরকে টাখনুর উপর প্যান্ট পরা শেখাচ্ছেন, নারীদেরকে আপাদমস্তক কালো কাপড় পরা শেখাচ্ছেন অর্থাৎ কৃষ্টি কালচার শেখাচ্ছেন। যা ফল হবার তা-ই হয়েছে। দীর্ঘদিনের অনুশীলনের ফলে আমাদের মুসলিম সমাজ এখন রাষ্ট্রহীন, খেলাফতহীন ব্যক্তিগত ইসলামে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মুসলিম জনসাধারণ এখন মনে করে ইসলাম মানে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, মসজিদ মাদ্রাসার জন্য দান খয়রাত করা, হুজুরদের সোহবত আর বিবিদের মুহব্বত করা ইত্যাদি। এগুলো করলেই ইসলাম পালন হয়ে যায়। জাতীয়/রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা বা ইসলামের বিধানে রাষ্ট্র পরিচালনা করার চিন্তাই তাদের মাথায় আসে না।

১৩. আমি আগেই বলেছি- মুসলিমদের ধর্মীয় জীবন ও রাজনৈতিক জীবন আলাদা নয়। কারণ রসুল (সা.) কেবল ধর্মনেতা ছিলেন না, রাষ্ট্রনেতাও ছিলেন। কিন্তু এখন মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় জীবন থেকে রাজনৈতিক জীবন আলাদা হয়ে গেছে। তারা ব্যক্তিগত জীবনে নামাজ রোজা করছেন আল্লাহর বিধানে, আর রাষ্ট্র চালাচ্ছেন মানুষের তৈরি বিধানে। তাদেরকে ধর্মীয় মাসলা-মাসায়েল বলে দিচ্ছেন ধর্মীয় নেতারা, আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাষ্ট্রীয় নেতারা। ইসলামে যে ধর্ম ও রাষ্ট্র আলাদা নয়, মুসলিমদের একজন নেতা থাকবেন, খলিফা থাকবেন, কোর’আনের বিধানে রাষ্ট্র চলবে, কোর’আনের বিধানে অর্থনীতি চলবে, কোর’আনের বিধানে বিচার চলবে, এই ধারণা মুসলিমরা ভুলে গেছে।

হ্যা, মুসলিমরা ভুলত না, যদি আমাদের আলেম সাহেবরা সত্যিকারের আলেমের দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আলেমরা মুসলিম উম্মাহকে পথ দেখানোর বদলে, দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার বদলে যেন ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

তারা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এই কথাটা বলছেন না যে, তোমরা আল্লাহর বিধানকে তসলিম না করে মানুষের তৈরি বিধানকে তসলিম করে নিয়েছো, কাজেই আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমরা মুসলিমই নও। তোমরা দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বাদ দিয়ে রসুলাল্লাহর সুন্নাহ থেকেই বের হয়ে গেছো, কাজেই তোমরা রসুলের দৃষ্টিতে উম্মতে মোহাম্মদী নও। তোমরা কোর’আনের ব্যক্তিগত বিধান মানো কিন্তু জাতীয়/রাষ্ট্রীয় বিধান মানো না- কাজেই তোমরা মো’মেনই নও।

এভাবে সত্যের আঘাতে জাতির কালঘুম ভাঙানোর বদলে আলেমরা নিজেরাও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন, জাতিকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। শিরক-কুফরে ডুবে থাকা মুসলমানদেরকে তারা ১০০বার সোবহানাল্লাহ পড়ে জান্নাতে যাওয়ার সহজ রাস্তা দেখাচ্ছেন। কোর’আনের প্রতি হরফ তেলাওয়াত করে দশটা করে নেকি কামাইয়ের স্পেশাল অফার দিচ্ছেন। পীরের হাতে বায়াত নিয়ে হাশরের দিন সরাসরি জান্নাতে চলে যাবার আশ্বাস দিচ্ছেন। মসজিদ মাদ্রাসার জন্য দানকারীকে মা-বাবাসহ জান্নাতের লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছেন। আরবের খেজুর খেয়ে, আরবীয় জোব্বা পরে, ডান কাতে শুয়ে, আর খাবার পরে মিষ্টি খেয়েই রসুলের পাক্কা উম্মত হবার উপায় বাতলে দিচ্ছেন।

তাহলে কে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নামতে যাবে বলুন? আপনি যদি একশবার সোবহানাল্লাহ পাঠ করেই জান্নাতে চলে যেতে পারেন, তাহলে কেন জীবনের ঝুঁকি নিতে যাবেন? কেন দীন প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গিয়ে মার খাবেন, গালি খাবেন, নির্যাতিত হবেন?

পাঠক, আমি আর লেখা দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছি না। আজকের এই প্রবন্ধে আমি যে কথাটা জোর দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম তা হলো- ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত বিষয় না যে, ব্যক্তিগতভাবে কিছু মানুষ চাঁদা দিয়ে মাদ্রাসা বানিয়ে, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে ইসলামের মাসলা-মাসায়েল শিখে ফেললেই ইসলাম পালন হয়ে গেল। কখনই না, ইসলাম হলো রাষ্ট্রীয় জীবনবিধান। যা রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা হলে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে নিরাপত্তা কায়েম হবে। মানুষ ঘরের দরজা খুলে ঘুমাবে। এই যে শান্তিটা আসবে, সেই শান্তির নামই ইসলাম। সেজন্যই বিশ্বনবী তাঁর নবুয়্যতি আন্দোলন শুরু করার তেরো বছরের মধ্যেই মদীনা নামক রাষ্ট্রশক্তি কায়েম করেছিলেন ও পরবর্তী দশ বছরে পুরো আরব উপদ্বীপে রাষ্ট্রীয়ভাবে দীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার ফলে আরব সমাজে অকল্পনীয় শান্তি নেমে এসেছিল। কিন্তু রসুলের রেখে যাওয়া সেই ইসলামের মডেল বাদ দিয়ে আমরা বর্তমানে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রহীন, খেলাফতহীন, কর্তৃপক্ষহীন নতুন আরেকটা ইসলামের মডেল আবিষ্কার করে নিয়েছি, যেটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আমল-আখলাকের বিষয়, যার সঙ্গে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক নেই এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠারও সম্পর্ক নেই। বলা বাহুল্য- যেহেতু এই বিকৃত মডেল আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবৎ দেখে আসছি, তাই এটাতেই গভীরভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের মন-মগজে, চিন্তা-ভাবনায় মেকী ধর্মটাই আজ প্রতিষ্ঠিত। মিথ্যাই এখন শতভাগ বিজয়ী। কেউ প্রকৃত ইসলাম তুলে ধরলে তাকে বরং মারার জন্য তেড়ে আসেন সবাই। আমরা উল্টো পথে হাঁটছি, তাই সোজা পথ কেউ দেখিয়ে দিলে সেটাকেই উল্টো পথ মনে হয়। কিন্তু কথায় আছে, উল্টো পথে হাজার কদম আগানোর চাইতে সঠিক পথে এক কদম আগানো অনেক উত্তম। আজকের লেখা থেকে যদি একজনও সেই সঠিক পথের সন্ধান খুঁজে পান তাহলে ওটাই হবে আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার আসল সার্থকতা ইনশা’আল্লাহ।

[লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক, যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]