
আরশাদ মাহমুদ
মানবজাতির জ্ঞানকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়- একটি অর্পিত জ্ঞান, অপরটি অর্জিত জ্ঞান। যুগে যুগে স্রষ্টা নবী-রসুল পাঠিয়ে মানুষকে মৌলিক কিছু জ্ঞান দান করে এসেছেন এই উদ্দেশ্যে যে, মানুষ যেন অজ্ঞতাবশত এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে যা তাদেরকে অন্যায়, অশান্তি, রক্তপাতের দিকে ধাবিত করে। নবী-রসুলদের মাধ্যমে আগত এই জ্ঞান মূলত সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ও বৈধ-অবৈধ’র পার্থক্য নিরূপণকারী জ্ঞান। যেমন ঐক্য শান্তি আনে আর অনৈক্য আনে অশান্তি। তাই মানুষকে সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত এবং এমন কথা-কাজ-আচরণ পরিহার করে চলা উচিত যাতে ঐক্য নষ্ট হয়। এই জ্ঞানটি স্রষ্টার অর্পিত জ্ঞান, কারণ মানুষকে শ্রম ও সাধনার মাধ্যমে এই জ্ঞান অর্জন করতে হয় নি, আল্লাহই স্বীয় অনুগ্রহে শিখিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে অর্জিত জ্ঞান হচ্ছে সেই জ্ঞান যা মানবজাতি স্বীয় প্রচেষ্টায় বা সাধনায়, গবেষণা করে, অনুসন্ধান করে, পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে লাভ করেছে। এই অর্জিত জ্ঞানকেই বর্তমানে বলা হয়ে থাকে বিজ্ঞান।
আজ আমরা চারদিকে বিজ্ঞানের যে জয়জয়কার দেখি তা কিন্তু একদিনে হয় নি। অধুনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমাদের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন দেখে অনেকে একটি ভুল ধারণা করে বসেন যে, ‘আধুনিক বিজ্ঞান কেবল পশ্চিমাদের একার সম্পদ। যেহেতু হালের অধিকাংশ প্রযুক্তিই পশ্চিমাদের তৈরি, সুতরাং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অভিনব উৎকর্ষতা অর্জিত হয়েছে, তার কৃতিত্বের দাবিদার শুধু পশ্চিমারাই, অন্য কোনো জাতির কোনো কৃতিত্ব এখানে নেই।’ এমন মনোভাব পোষণ করেন যারা তাদেরকে বুঝতে হবে, মানবজাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান একটি ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। উড়োজাহাজ, বৈদ্যুতিক বাল্ব, রেডিও-টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়েছে সেদিন, কিন্তু এগুলো আবিষ্কারের পটভূমি রচিত হচ্ছিল পৃথিবীর প্রথম মানুষটি থেকেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে বিস্ময়কর উন্নতি আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি- এর সাথে বিগত হাজার হাজার বছরের লাখো মানুষের সঞ্চিত জ্ঞান, সাধনা, শ্রম ও চিন্তা-ভাবনা মিশে আছে। বিষয়টি একটি সিড়ির বিভিন্ন ধাপের মতো। প্রথম ধাপ আছে বলেই আপনি দ্বিতীয় ধাপে পা রাখতে পারছেন, দ্বিতীয়টি আছে বলে তৃতীয়টিতে যেতে পারছেন। এই একেকটি ধাপকে যদি একেকটি জাতি-গোষ্ঠী হিসেবে কল্পনা করা হয়, তাহলে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো জাতি, গোত্র, গোষ্ঠী ও দেশের মানুষের শ্রম ও সাধনার ভিত্তিতে বিজ্ঞানের যে সিড়িটি তৈরি হয়েছে, আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা সেই সিঁড়িটির সর্বোচ্চ ধাপটিতে অবস্থান করছে মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। একটি চারার পরিচর্যা করা হচ্ছিল সেই প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে। আজ সেটা ডালপালা মেলে বিরাট আকার ধারণ করেছে। তাতে সুস্বাদু ফল ধরতে শুরু করেছে। আর পাশ্চাত্য সভ্যতা সেই ফলটাই পেড়ে খাওয়াচ্ছে আমাদের।
ইতিহাস সচেতন মানুষমাত্রই জানেন মাত্র কয়েক শতাব্দী আগেও ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বলে কিছু ছিল না। বাইবেলবিরোধী সত্য বললে আগুনে পুড়িয়ে মারা হত। তখন আবার জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিস্ময়কর উৎকর্ষ অর্জন করেছিল আরবরা। আরবদের কাছে বিজ্ঞান শিখতে যেত অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীগুলো। পরবর্তীতে ধর্মের উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলায় জ্ঞানকে কেবল ধর্মীয় শাস্ত্রের জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেললে আরব তথা সারা পৃথিবীর মুসলিমরা বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে পড়ে। বিজ্ঞানের অসমাপ্ত ইমারত তখন লুফে নেয় পাশ্চাত্য। ফলে আজ তারা পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের কর্ণধার, যার ভিত্তি মজবুত করেছিল মুসলমানরা।
কোনো সভ্যতাই চিরস্থায়ী হয় না। হয়ত একদিন পাশ্চাত্যও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে পড়বে। তাদের উৎকর্ষতাকে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করবে অন্য কোনো জাতি, গড়ে উঠবে অন্য কোনো সভ্যতা। তবে উত্থান-পতন যা-ই হোক, বিজ্ঞান কিন্তু থেমে থাকবে না। তাকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। পূর্ণতা পাবে বিজ্ঞান নামক ইমারতটি, যা হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-মুসলমানের একার সম্পদ নয়, পাশ্চাত্যের বা প্রাচ্যেরও নয়, মেরু বা মরু অঞ্চলের নয়, সেটা হবে সমগ্র মানবজাতির সম্পদ।