
রাকীব আল হাসান:
আল্লাহর শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) যাঁকে আল্লাহ সমগ্র মানবজাতির উপর দায়িত্ব অর্পণ করলেন তার জীবনের দিকে চাইলে আমরা কি দেখি? আমরা দেখি তাঁর সমস্ত নবুয়তি জীবন ভর সংগ্রাম। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রচারের সংগ্রাম তো ছিলই, তার উপর মাত্র দশটি বছরে আটাত্তরটি যুদ্ধ, অভিযান ইত্যাদি সংগঠন করেছেন, যার মধ্যে আটাশটিতে নিজে সেনাপতিত্ব করেছেন, আর স্বয়ং যুদ্ধ করেছেন নয়টিতে। একটি মাত্র যুদ্ধের পেছনে কতখানি সংগঠন, প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন হয় তা সামরিক বাহিনীর কাউকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। অর্থাৎ নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, বিশ্বনবীর (দ.) জীবনের প্রধান ভাগ ব্যয় হয়েছে সংগ্রামে, সংঘর্ষে। ভাবলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয় যে, ঐ নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের পরও একটা মানুষ কি করে অন্যান্য কাজ করেছেন, আর সেই অন্যান্য কাজও কী বিরাট বিপুল কাজ। পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদদের মধ্যে যাদের অন্তরের কিছুটা প্রসারতা আছে, সত্যের প্রতি কিছুটা শ্রদ্ধা আছে তাদের মধ্যে অনেকেই তার (দ.) জীবনী পড়ে মানব জীবনের উপর তার (দ.) প্রভাব দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেছেন। এমনি অবাক বিস্ময়ে ফরাসী ইতিহাসবেত্তা লা মার্টিন লিখেছেন- “দার্শনিক, বাগ্মী, নবী, আইন প্রণেতা, যোদ্ধা, ধারণাকে জয় ও প্রতিষ্ঠাকারী, বিচারবুদ্ধিসহ বিশ্বাসকে পুনর্জীবনদানকারী, মুর্তিহীন ধর্মের পুনঃপ্রবর্তক, বিশটি জাগতিক সাম্রাজ্যের ও একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা-এই হচ্ছেন মোহাম্মদ। মানবীয় মহত্ব ও বিরাটত্ব মাপার যতগুলি মাপকাঠি আছে সেসবগুলি দিয়ে মাপলে আমরা প্রশ্ন করতে পারি- তার চেয়ে বড়, মহীয়ান আর কোন মানুষ আছে?” (History of Turkey- Alphonse de Lamartine) দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, মানুষের সামগ্রিক জীবনের দিক-নির্দেশনা প্রদানকারী, পৃথিবীর অন্যতম সমরনায়ক ও সফল বিপ্লবী মহানবী মোহাম্মদ (সা.) এর আগমনের উদ্দেশ্য কী ছিল এই ব্যাপারে বর্তমানের মুসলিম নামক জাতির সদস্যদের কাছে প্রশ্ন করলে একেক জনের কাছে একেক রকম জবাব পাওয়া যাবে। কিন্তু রসুলাল্লাহর মাত্র ২৩ বছরের সাধনায় ও সংগ্রামে যে অপ্রতিরোধ্য, দুর্নিবার ও দুর্ধর্ষ জাতিটি তৈরি হয়েছিল তাদেরকে যদি প্রশ্নটা করা হত নিঃসন্দেহে সবার কাছেই একই জবাব পাওয়া যেত। কারণ তারা আকীদা শিক্ষা করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহর রসুলের কাছে থেকে।
কোর’আনের অন্তত তিনটি আয়াতে আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন তিনি কেন রসুল প্রেরণ করেছেন। সুরা ফাতাহ ২৮, সফ ৯ ও তওবা ৩৩- এই তিনটি আয়াতে আল্লাহ তাঁর রসুল সম্পর্কে আকীদা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই তাঁর রসুলকে হেদায়াহ ও দীনুল হক্বসহ প্রেরণ করেছেন অপর সমস্ত দীনের উপর এটাকে জয়যুক্ত করার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ এই আয়াতে উল্লেখিত ‘হেদায়াহ, দীনুল হক্ব এবং দীনুল হক্ব প্রতিষ্ঠা (লিইউজহিরাহু) এই শব্দত্রয়ের মধ্যেই নিহিত আছে আল্লাহর রসুলের সংগ্রামী জীবনের আকীদা। কাজেই শব্দ তিনটিকে ভালোভাবে বুঝে নেবার প্রয়োজন আছে।
হেদায়াহ:
বর্তমানে নামাজ পড়েন না বা রোজা রাখেন না এমন ব্যক্তি ঠিকমত নামাজ-রোজা শুরু করলে, সত্যবাদী হয়ে উঠলে ও সততার পন্থা অবলম্বন করলে বলা হয় লোকটা হেদায়েত হয়েছে। এই ধারণা ভুল। নামাজ রোজা করা, সত্য কথা বলা, সততা, আমানতদারী ইত্যাদি হচ্ছে তাকওয়ার পরিচয়, হেদায়াহর নয়। হেদায়াহ শব্দের অর্থ হচ্ছে সঠিক পথ বা জরমযঃ উরৎবপঃরড়হ. সঠিক পথ মানুষকে সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যায়, ভুল পথ নিয়ে যায় ভুল গন্তব্যে এটা জানা বিষয়। আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসুলদের মাধ্যমে মানবজাতিকে হেদায়াহ বা সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন, তার মানে নিশ্চয়ই এর কোনো গন্তব্য আছে, তাই নয় কি? সেই গন্তব্যকে জানতে হবে, কারণ আদম (আ.) থেকে শেষ রসুল পর্যন্ত যত নবী-রসুল প্রেরিত হয়েছেন সবার জীবনের উদ্দেশ্যই নিহিত আছে এখানে, তারা সবাই হেদায়াহ বা সঠিক পথ-নির্দেশনা নিয়ে এসেছেন। সকল নবীই মানুষকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দিকে আহ্বান করেছেন যার মর্মার্থ প্রকাশ পেয়েছে কলেমার ঘোষণা তথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর মধ্য দিয়ে। এর অর্থ আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কোনো হুকুমদাতা, কোনো সার্বভৌমত্ব স্বীকার করি না। জীবনের কোনো অঙ্গনে আল্লাহর কোনো বক্তব্য থাকলে, বিধান থাকলে, অন্য কারোটা মানব না। এই সিদ্ধান্তটুকু নিলেই মানুষের কোনো ভয় নেই, চিন্তা নেই। যুগে যুগে ইবলিশের প্ররোচনায় পড়ে মানুষ যখনই পথ হারিয়ে ফেলেছে, তখনই নবী-রসুলরা এসে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন- হে মানুষ! তোমাদের সামনে দু’টি পথ রয়েছে। একটি আল্লাহর দেওয়া পথ, হেদায়াহ; অপরটি দালালাত, ইবলিশের পথ। আল্লাহর দেওয়া পথ তোমাদেরকে দুইজীবনে সফল করবে, ইহকালে শান্তি দিবে, পরকালে জান্নাত দিবে, পক্ষান্তরে ইবলিশের তৈরি পথ তোমাদেরকে ইহকালে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাতে নিমজ্জিত করবে, পরকালে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। এই হেদায়াহ বুঝলে দীনুল হক্ব বোঝাও সহজ হয়ে যায়। কারণ দীনুল হক্ব আর কিছু নয়, হেদায়াহ বা তওহীদের ভিত্তিতে প্রণিত জীবনব্যবস্থাটাই দীনুল হক্ব বা সত্যদীন।
দীনুল হক বা সত্যদীন:
দীন শব্দের অর্থ জীবনব্যবস্থা, দীনুল হক্ব বা সত্যদীন হলো আল্লাহর প্রেরিত সত্য জীবনব্যবস্থা, যাতে কোনো ভুল নেই, ত্রুটি নেই, যেই জীবনব্যবস্থা কোনো সমাজে কায়েম করা হলে তার অবশ্যম্ভাবী ফল হবে ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা, এক কথায় শান্তি (ইসলাম)। যুগে যুগে প্রত্যেক নবী-রসুল যেমন তওহীদ নিয়ে এসেছেন (সুরা আম্বিয়া ২৫) তেমনি নিয়ে এসেছেন তওহীদভিত্তিক দীন। তার ধারাবাহিকতায় আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে আল্লাহ যখন তাঁর শেষ রসুলকে পাঠালেন যথারীতি তাঁকেও হেদায়াহ তথা তওহীদের সাথে তওহীদভিত্তিক দীনও প্রদান করলেন। তবে এইবার একটু ব্যতিক্রম হলো, অন্যান্য নবীদের আনীত দীনের সাথে শেষ নবীর আনীত দীনের বিশেষ একটি পার্থক্য তৈরি হলো। অন্যান্য নবী-রসুলগণ দীন আনতেন যার যার অঞ্চলের জন্য, কিন্তু শেষ রসুল তো কোনো গোত্র বা জনপদের নবী নন, তিনি সারা বিশ্বের নবী, রহমাতাল্লিল আলামিন। কাজেই আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে যেই দীন পাঠালেন সেটাও কোনো নির্দিষ্ট জনপদের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য। সমগ্র মানবজাতির জন্য। এই সময় আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আর ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় নবী-রসুল পাঠাবেন না, আখেরী নবী, খাতামুন নাবিয়্যিনের মাধ্যমে এমন দীন পাঠাবেন যেটা কেয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য হবে। মেরু অঞ্চল, মরু অঞ্চল, এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকা সর্বত্র যেটা প্রযোজ্য ও ফলপ্রসূ হবে, সবাইকেই শান্তির সুশীতল ছায়ায় সিক্ত করতে পারবে। প্রকৃতির নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে এই দীনের অপর নাম হলো দীনুল ফেতরাহ, প্রাকৃতিক দীন।
তাহলে আল্লাহর রসুলের সংগ্রামী জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সন্ধান করতে গিয়ে কোর’আনে আমরা যে তিনটি শব্দ পেলাম তার মধ্যে প্রথমটি হেদায়াহ, যার অর্থ হচ্ছে সঠিক পথ, তওহীদের পথ, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে জীবনের সর্বাঙ্গনে আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসেবে গ্রহণ করা। আর দ্বিতীয় বিষয়টি অর্থাৎ সত্যদীন হলো আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসেবে গ্রহণ করে নেবার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা হুকুম-বিধানের সমষ্টি। অর্থাৎ কোনটা করব কোনটা করব না, কোনটা হালাল কোনটা হারাম, কোনটা উপকারী কোনটা ক্ষতিকর, কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায়, কোনটা করণীয় কোনটা বর্জনীয়, কোনটা বৈধ কোনটা অবৈধ ইত্যাদি। বাকি রইল লিইউজহিরাহু, অর্থাৎ দীন প্রতিষ্ঠা। এই ‘প্রতিষ্ঠা’ শব্দটি ভালোমত বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন আছে।
দীন প্রতিষ্ঠা:
কোনো আদর্শ যত নির্ভুলই হোক, সেটাকে প্রতিষ্ঠা করা না গেলে ওই আদর্শের কোনো মূল্য থাকে না। শেষ ইসলামের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আল্লাহ তাঁর আখেরী নবীকে দুইটি মহামূল্যবান সম্পদ দান করলেন, হেদায়াহ ও সত্যদীন, যা সূর্যের মত আলোকময়। এই সত্যের আলোয় সারা পৃথিবী আলোকিত হবে, কেটে যাবে অজ্ঞানতার অন্ধকার, বন্ধ হবে দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা, শাসিতের উপর শাসকের অবিচার, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, এটাই লক্ষ্য। কিন্তু সেই সত্য যদি প্রতিষ্ঠাই না পায় তাহলে এই মহামূল্যবান সম্পদ দুনিয়াতে থাকা আর আসমানে থাকা সমান কথা হয়ে যায় না কি? সেজন্যই আল্লাহ যখন তাঁর রসুলের দায়িত্বের কথা বললেন তখন সুস্পষ্টভাবে বলে দিলেন তিনি তাঁকে হেদায়াহ ও দীনুল হক্ব দিয়েছেন এই জন্য যে, বিশ্বনবী যেন সেটা সারা পৃথিবীতে অন্যান্য সমস্ত দীনের উপর জয়যুক্ত করেন, প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইতিহাস সাক্ষী আল্লাহর রসুল এক মুহূর্তের জন্যও সেই দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হননি। হেরা গুহায় নব্যুয়ত লাভের মুহূর্ত থেকে ওফাত পর্যন্ত আল্লাহর রসুলের ২৩ বছরের জীবন- সংগ্রাম ও বিপ্লবের জীবন। অত্যাচারী শাসকদের ধারালো তলোয়ারকে উপেক্ষা করে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিতেন- ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম চলবে না’। নিশ্চিত মৃত্যুঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েও তিনি শত্রুকে পরোয়া করেননি, সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে এক চুলও সরে দাঁড়াননি। তিনি বলেছেন, ‘আমার এক হাতে চন্দ্র আরেক হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি সত্য প্রচারে পিছপা হব না, এতে হয় আমার ধ্বংস হবে নয়তো বিজয়!’’ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বন্ধুর পথে তিনি ছুটে চলেছেন সুস্থির লক্ষ্য অভিমুখে। কত বাধা, কত প্রতিবন্ধকতা, নির্মম নির্যাতন, অপমান, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, হুমকি, প্রলোভন, রক্তপাত ও যুদ্ধের সাইক্লোন বয়ে গেছে তাঁর পথের উপর দিয়ে। কিন্তু তিনি থেকেছেন অটল, অনড়, আপসহীন, অবিচল! শুধু তাই নয়, যেই সময়ে তিনি আরব উপদ্বীপে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময়ে তিনি আরও একটি কালজয়ী ইতিহাস রচনা করে চলেছেন মহান এক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। তিল তিল করে এমন একটি জাতি তিনি গড়ে তোলেন যাদেরকে ‘জাতি’ না বলে দুর্ধর্ষ ‘সামরিক বাহিনী’ বলাই যুক্তিসঙ্গত হয়। ওই জাতিকে দৈহিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে এমনভাবে গড়ে তুললেন ও আকীদা শিক্ষা দিলেন যেন তারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্বের কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে না যায় এবং নেতার অবর্তমানেও তাঁরই মত করে সংগ্রাম চালিয়ে সারা পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত মানবজাতিকে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার উপহার দিতে পারে। ইবলিস যে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল ‘তোমার আদম সন্তানদের দিয়ে আমি হেদায়াহ অস্বীকার করাব, তারা তোমার হুকুম মানবে না’ সেই চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করতে পারে।
[লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ;
ইমেইল: opinion.hezbuttawheed@gmail.com
ফোন: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১২৩০৯৭৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]